... ... ... ...
১.
আমরা সাধারণ মানুষেরা মনে সুখ-দুঃখ পুষে রাখি, ভালোবাসার স্মৃতি পুষে রাখি। কখনো কখনো সে স্মৃতি বের করে নষ্টালজিক হতে চেষ্টা করি। অরূপ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ছিল না। হাজারটা মানুষের মাঝে যদিও তাকে আলাদা করতে পারবে না, তবু খুব কাছে থেকে দেখলে হয়তো যে কেউ বুঝতে পারতো সে অসাধারণ। তবু কেন কেউ পারেনি কে জানে?
কেউ কেন বুঝতে পারেনি তা মাঝে মাঝে আমি অনুমান করতে চেষ্টা করি।
হয়তো নিত্যিদিনের ভিড় ঠেলে যাতাযাতি করে ওঠা, লোকাল বাসটার রড ধরে কোনোমতে ঝুলে থাকা লোকটার দিকে তাকাবার ফুরসত কারো হয় না। কিংবা নিশুতি রাত্তিরে বাড়ি ফেরা ক্লান্ত চোখগুলো হয়তো শুধু প্রিয়জনদের অপেক্ষায় থাকে, পাশের সীটে বসে থাকা নিতান্তই সাধারণ ছেলেটার দিকে চোখ তুলে তাকাবার অবকাশ কোথায়? সাড়ে পাঁচফুটি মানুষটাকে কেউ দেখেও যেন দেখে না...
ভলভো বাসের বিশেষত্ব কি জানতে চাইলে যে কেউ হয়তো বলতো ব্রান্ডের কথা কিংবা ১০ চাকার কীর্তন... আমাদের অরূপ হয়তো বলতো অন্য কিছু। একমাত্র ভলভো বাসেই দুটো সীট আছে ট্রেনের মতো, মুখোমুখি। মুখোমুখি সীটগুলোতে বসতে আমার অস্বস্তিই লাগে, অচেনা অজানা কেউ উলটা পাশে বসে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে ব্যাপারটা ভাবতে সুখকর কিছু না। কিন্তু অরূপকে আমি প্রতিরাতে ওই সীটটাতেই বসে থাকতে দেখতাম।
প্রায় মধ্যরাতে ওটা হয়তো ভলভোর শেষ ট্রিপ, এদিকে ওদিকে দু-একজন যাত্রী ছিটকে পড়ে থাকে, ঘুমে ঢুলু ঢুলু সবার মাঝে অতি উৎসুক একজোড়া জাগ্রত চোখে বসে থাকে অরূপ।
২.
বহু বছর আগে যখন এ শহরে চাকরীর খোঁজে এসেছিল, সম্বল বলতে ছিল তার মফস্বলের কলেজের বিএ সেকেন্ড ক্লাস ডিগ্রী। ঢাকার চাকরীর বাজারে সে ডিগ্রীর কতোটুকু দাম, হর্তাকর্তারা ভালো বলতে পারবেন। বেশ কিছু মাস এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে শুধু জুতার সুখতলিই ক্ষয় করেছিল। অবশেষে মতিঝিলের এক মার্চেন্ডাইজিং কোম্পানিতে কেরাণীর চাকরী পেয়েই তাই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল অরূপ।
মাসে মাসে দেশে কয়েকটা টাকা পাঠানো যেত ছোট বোনটার কাছে, এটুকুই তাকে স্বস্তি দিতো। বাবা-মা না থাকায় ঐ ছোটবোনটাই যা একমাত্র পিছুটান। স্বামীর বাড়িতে তার দেয়া কয়েকটা টাকা হয়তো বোনটাকে সুখ কিনে দিতো।
পিছুটান নেই এমনটা হয়তো এ ব্যস্ত নগরজীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ আমরা অনেকেই কল্পনা করি। সত্যি যদি না থাকতো তাহলে কেমন হতো বলা কঠিন।
হয়তো অরূপের মতোই নিজেকে মাঝে মাঝে অদৃশ্য মনে হতো, ভাউচারে ভুল হলে কিংবা লগের হিসাবে কোনো গোলমাল হলে বসের ঝাড়ি আর কলিগদের মুচকি মুচকি ব্যঙ্গ হাসিতে মাঝে মাঝে মনে হতো যে...নাহ, এখনো বেঁচে আছি! সেই অরূপ ধীরে ধীরে পালটে গেলো। নিজেকে প্রতিদিনই একটু একটু করে হারিয়ে ফেলা অরূপকে ঘুমের মাঝে এক রাতে একটা হাত ছুঁয়ে গেলো, খুব মায়া মায়া একটা হাত, যেন তাকে ছুঁতে চাচ্ছে... আর সে খুব দ্রুতগতিতে হাতটাকে পিছনে ফেলে রেখে যাচ্ছে... ... ...
বিড়ালটার ঢাকনা উল্টানোর আওয়াজে লাফিয়ে বিছানা থেকে পড়লো সে রাতে অরূপ। ধুপধাপ করে ছুটে গেলো পাকঘরে, তারপর বিড়ালের লঙ্কা কান্ড দেখে কিছুটা হতাশ হয়েই যেন বিছানায় ফিরে এলো। তখন আস্তে আস্তে স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। স্রষ্টার খেলা বলতে পারেন কেউ, স্বপ্নে কোনো কমতি রাখেন না যেন তিনি।
সাতাশ বছরের জীবনের প্রায় পুরোটা সময় যে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেই সন্দিহান ছিল, তার স্বপ্নে কোনো একটা মেয়ের হাত নিতান্তই গরীবের ঘোড়ারোগ। সে স্বপ্ন যদিবা মনের ভুলে একরাতের কাহিনী হতো তাহলে হয়তো অরূপ বদলে যেতো না, আমাকেও সাধারণের অসাধারণ কোনো গল্প লেখতে হতো না। সে স্বপ্ন অরূপ রাতের পর রাত দেখতে লাগলো। একটা বাড়িয়ে দেয়া হাত...মুখোমুখি বসে থাকা একটা কেউ...যার মুখের ওপর আছড়ে পড়ে ছিল এলোমেলো চুল... ...
ধীরে ধীরে স্বপ্নের চারপাশটা তার খুব চেনা হয়ে গেলো। তখন থেকেই হয়তো ভলভো বাসের অস্বস্তিকর সেই মুখোমুখি সীটে দখল নিল অরূপ।
এবার শুধু স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা... ...
৩.
এক রাতের কথা। সেই চিরচেনা ভলভো বাস...ঘুমে ঢুলু ঢুলু কয়েকজোড়া চোখ...ব্যস্ত ড্রাইভারের বাড়ি ফেরার তাড়া...আর সেই অস্বস্তিকর মুখোমুখি সীটটাতে অরূপ। প্রতিবার বাসটা স্ট্যান্ড ছেড়ে আসার পর ঘাড়টা একটু কাত করে পিছু ফিরে মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছিল অরূপ। ততোদিনে সেটা অভ্যেসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। ঠিক স্বপ্নের মতো করে সে রাতে আধাঁর ফুড়ে একটা হাত এগিয়ে এলো বাসটির দিকে...সেই মায়া মায়া হাত, হাতে দুটি চুড়ি।
হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো অরূপ। আর মেয়েটি চিৎকার করতে লাগলো বাসটি থামানোর জন্য। বিরক্তিমুখে ব্রেক চাপলো ড্রাইভার, সামনের দরজা দিয়ে মেয়েটি বাসে উঠলো। মুখে অনিচ্ছাকৃত দেরি হেতু লজ্জিত হাসি। সিনেমাতে অনেকসময় স্লো-মোশনে কিছু বিশেষ দৃশ্য এগোয়...অরূপ তখন সেরকম স্লো-মোশনে স্বপ্ন আর বাস্তবের জগাখিচুড়িতে হারিয়ে যাচ্ছে।
অবাক হওয়ার তখনো অনেকটুকু বাকি ছিল। মুখের উপর আছড়ে পড়া চুল আর ব্যাগ সামলাতে সামলাতে মেয়েটি ঠিক অরূপের মুখোমুখি বসলো। অরূপ তখন স্বপ্নটাকে মিলিয়ে দেখছে বাস্তবের সাথে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল...লজ্জিত হাসি...অস্থির অস্থির ভাব...সবটুকু স্বপ্নের সাথে মিলে যায়। কিন্তু তারপর কি? স্বপ্নের বাকিটুকু তো তার জানা নেই...
“অফিস থেকে বের হতে হতে দেরি হয়ে গেলো,” লজ্জিত কন্ঠে বললো মেয়েটি।
ঘোর ভাঙলো অরূপের। স্মিত হেসে মাথাটা একটু নাড়ালো সে, কিছু বললো না। তাতে মেয়েটি একটুও নিরাশ হলো না। উচ্ছ্বল ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগলো নিজের মতো করে, অরূপের সামান্য মাথা ঝাঁকানি, একটু হাসিই যেন তার কথা বলায় নীরবে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ ব্রেক কষায় সে আলাপনে ব্যাঘাত ঘটলো।
ড্রাইভারের চোখ-মুখে আরেকবার বিরক্তির ভাঁজ পড়লো...মুহূর্তের মাঝে সে ভাঁজ আতংকে পরিণত হলো। যে জায়গায় ঝাঁকি দিয়ে গাড়ি থামলো, সেটা কোনো ভলভো বাসের স্টপ নয়। অরূপও বুঝতে পারলো না ড্রাইভারের থামানোর কারণ। বুঝতে অবশ্য দেরিও হলো না যখন এক দঙ্গল লোক হুড়মুড় করে উঠে পড়লো বাসে...বসনে ভূষনে তাদের খুব সুবিধার বলে মনে হলো না। তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুমে ঢুলু ঢুলু লোকগুলোও একটু নড়েচড়ে বসলো।
হাবেভাবে ওদেরকে খানিকটা মাতাল বলেও মনে হচ্ছিল অরূপের...মুখোমুখি বসে থাকা স্বপ্ন কন্যার কথা বন্ধ হয়ে গেছে ততোক্ষণে। হুড়মুড়িয়ে ওঠা দলটার সবাই হঠাৎ চুপ মেরে গেলো। একটা হঠাৎ নীরবতা যে কতোটা ভয়ংকর, তা অরূপের মাথায় খেললো না। মাতাল লোকগুলোর দৃষ্টি তখন মুখোমুখি সীটটায়...অরূপের মুখোমুখি বসে থাকা মেয়েটির উপর।
মাতালদের মধ্যে যে দলনেতা গোছের বলে মনে হলো, সে এগিয়ে এসে বসলো অরূপের পাশে, বোটকা একটা দুর্গন্ধ নাকে হানা দিলো অরূপের।
মুখোমুখি মেয়েটা ভয়ে একটু যেন সংকুচতি হলো। অরূপ অবাক হয়ে , খানিকটা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির চোখে। মেয়েটিও সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে বাসে একমাত্র আপনজন ভেবে অরূপের পানে তাকালো। হঠাৎ কয়েকটা শক্তিশালী হাত অরূপের কলার ধরে ওকে টেনে পাশের সীটে আছড়ে ফেললো। যে বুড়োটার গায়ে আছড়ে পড়লো অরূপ, সে বুড়োটাও বাসের জানালার সাথে ভয়ে প্রায় মিশে গেলো।
নেতাটা চিৎকার করে উঠলো, “ওই শালা ড্রাইভার, ***** পুত...লাইট নিভা। ” সুইচের দিকে হাত বাড়ালো ভীত ড্রাইভার। পুরো বাসে আধাঁর নেমে আসার আগে অরূপের চোখ পড়লো লোলুপ কয়েকটা হাতের ফাঁকে হারিয়ে যেতে থাকা মেয়েটার অসহায় চোখ...ওকে কি কিছু বলছিলো তখনো? আধাঁরে মেয়েটির অসহায় আর্ত চিৎকারে সে ভাবনাও এলোমেলো হয়ে গেলো অরূপের।
পরিশিষ্ট
আমরা সাধারণ মানুষেরা মনে সুখ-দুঃখ পুষে রাখি, ভালোবাসার স্মৃতি পুষে রাখি। কখনো কখনো সে স্মৃতি বের করে নষ্টালজিক হতে চেষ্টা করি।
অরূপ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ছিল না। এখনো মাঝে মাঝে ভলভো বাসের শেষ ট্রিপটাতে কোকড়া চুলের হালকা পাতলা গড়নের ছেলেটাকে দেখতে পাবেন সেই মুখোমুখি সীটে বসে আছে। চোখে তার অদ্ভূত ঘোর... নিশুতি রাত্তিরে ঘরে ফেরা ক্লান্ত চোখগুলো তা বুঝতে পারতো না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।