আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অক্সিজেন‍!



গাজায় বিমান হামলায় এভাবেই শিশুদের অসহায় পিতা দৌড়াচ্ছে তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য। এই দৃশ্যটি প্রতিদিনই ঘটছে। আমার ছেলেটা বড় হয়ে রাজা হবে। তারপর সারা দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটাবে। বুঝলে? ঝুমু বলছে মিলনকে।

ঝুমু এমনিতেই খুব আবেগপ্রবণ। তারউপর রৌদ্র তাদের প্রথম সন্তান। এই রৌদ্র নামটাও ঝুমুর দেয়া। সব-সময় বলে, আমার ছেলে হবে রৌদ্রের মতো প্রখর। মানুষের জন্য সব-চাইতে দরকারী।

রৌদ্র ছাড়া যে পৃথিবী অচল। মিলন হাসতো। তাহলে রৌদ্র না দিয়ে এক কাজ করো, ছেলের নাম সূর্য দাও। সূর্য ছাড়া তো পৃথিবী টিকবে না। দুজনই হাসতো।

ঝুমু বলতো, নাহ, রৌদ্রই অনেক সুন্দর। আমার ছেলের নাম রৌদ্র। কিন্তু কিছুদিন ধরে তাদের দুজনের মন খুব একটা ভালো নেই। টিভির পর্দায়, পেপার-পত্রিকায় গাজায় ইসরাইলী বিমান হামলায় শিশুদের আর্তনাদ ওদের দুজনকেই বিমর্ষ করে তুলছে। - আচ্ছা, ওদের কি একটুও খারাপ লাগে না? রৌদ্রকে কোলে নিয়ে ঝুমু বলে ওঠে।

মিলনও টিভির দিকে তাকিয়ে বলে, পৃথিবীর মানুষগুলোর মোরালিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এইতো কিছুদিন আগেই তারা দেখলো, লাশের পর লাশ একটি হাসপাতালে। কতগুলো শিশুকে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে হাসপাতালের ফ্লোরে ফেলে রেখেছে। তাদের পিতা-মাতার আর্তনাদে ফেটে পড়ছিল গোটা হাসপাতাল। আবার রাস্তায়-রাস্তায় শিশুগুলোর দৌড়া-দৌড়ী।

মা'রা শিশুগুলোকে কোলে নিয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে যাওয়া। ইশ্ কি বিভৎস সে দৃশ্য!! ঝুমু বলে উঠে, মিলন, ওরা কেনো এমন করছে? এই বাচ্চাগুলার কি দোষ। আমার শিশুর মতো ওদেরও তো একটু শান্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই বলে ঝুমু কেঁদেই দেয়। মিলন ঝুমুর পিঠে হাত বুলায় আর বলে, কেঁদো না..কেঁদে কি হবে? এই যে সেদিন দেখলাম, একজন মা তার রক্তাক্ত শিশুকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে.....তুমিই বলো, এটা কি সহ্য করার মতো দৃশ্য? ঝুমু এগুলো বলছে আর কাঁদছে।

মিলন ঝুমুকে নিয়ে বেডরুমে যায়। রৌদ্র তখন ঘুমিয়ে। ঝুমুকেও সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। ঠিক যেনো ঝুমুও একটি বাচ্চা শিশু। শিশুদের মতই যেনো তার মন।

তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মিলন বলে, কেঁদো না সোনা। ঘুমাও। তোমার ঘুম দরকার। ইউ নিড রেস্ট। এসব টিভি দেখে দেখে তুমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছ।

এসব দেখা বাদ দাও। নিজেদের কথা ভাবো। আমাদের দেশেও কি শান্তি আছে বলো? আমাদের ছেলেটাও যে খুব একটা সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে সেটার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? হঠাৎ মিলন খেয়াল করলো ঝুমু ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত তখন ১২টার কাছাকাছি। মিলন বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরায়।

এই রাত বড় মায়াবী। আর যদি কোনো ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায় তাহলে তো আর কথাই নেই। রাতে মন হয়ে পড়ে আরও একাকী। প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় সমস্ত চেতনারা রাক্ষস হয়ে যায়। কুরে কুরে খাওয়া শুরু করে দেয়।

মিলন সিগারেটের ধোঁয়া উড়ায় আর ভাবে সেই অসহায় শিশুগুলোর কথা। যাদের কাছে এই পৃথিবীটা রাক্ষসের মতো। ভুত বলে যেই অজানা জিনিসটিকে আমরা আমাদের শিশুদের কাছে গল্পাকারে তুলে ধরি। সেই ভুততো তারা প্রতিনিয়ত সামনা সামনি দেখছে। বিমান থেকে কিছুক্ষণ পরপর দানবের বর্ষন তারপর কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়ায় চারিদিক; ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে যাওয়া সে জায়গা।

তারপর পুড়ে যাওয়া রক্তাক্ত লাশ। এতো ভুতই। ভুত ছাড়া আর কি! এই ভয়ঙ্কর ভুতদের তারা প্রতিনিয়ত দেখছে। রাতের আকাশে যখন চলন্ত বিমানগুলো সাঁই সাঁই করে উড়ে যায় তখন সেই অসহায় শিশুগুলোর আতঙ্কগ্রস্থ মুখ দেখলেই তো মনটা হুহু করে ওঠে। অনেক শিশু হয়তো কাঁদতেই ভুলে গেছে।

তারা এখন কাঁদে না; তারা শুধু অপেক্ষা করে পরবর্তী আরেকটি নির্মমতার। তাই তারা আর কাঁদে না। তারা যানে এটাই তাদের নিয়তি। হাসপাতালের বেডে কত শিশুকে অক্সিজেন দিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বাতাসে বারুদ ঘুরছে, লাশের গন্ধ ঘুরছে।

সেই বিষাক্ত বাতাস তারা গ্রহণ করতে পারছে না। তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাই সেই কৃত্রিম অক্সিজেন। এই মানবিক বিপর্যয় কি কেউ বুঝে না! এই বিভৎসতার মাঝে বেড়ে ওঠা শিশুগুলোর ভবিষ্যতই বা কি! যারা এই রক্তের বন্যা আর যুদ্ধ দেখে দেখে বেড়ে উঠছে তাদের মানসিক বিপর্যয় কি কেউ বুঝে উঠতে পারে না! বেঁচে থাকা শিশুরা তো ভয় জিনিসটাই আর বুঝবে না। তারাও যে ভুতের খেলা দেখতে দেখতে ভুত হয়ে উঠবে! কেউ কি তা বুঝে না।

এবার মিলনই কেঁদে উঠলো। হুহু করে ফঁপিয়ে ফঁপিয়ে কাঁদছে। বারান্দার গ্রিল ধরে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। হে খোদা, তুমি কি দেখো না! তুমি এই শিশুদের কান্নার আওয়াজ পাও না? আমার রৌদ্রের মতো নিরপরাধ শিশুগুলোর রক্ত ঝরছে। বিষাক্ত অক্সিজেন ওদের দেহে প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে আর আমাদের কিছু করার নেই।

আমরা তো অসহায়; তুমি কিছু করো খোদা.....কিছু একটা করো.....এই অসহায় শিশুদের পাশে অন্তত তুমি গিয়ে দাড়াও..... মিলনের এ কান্না থামার নয়। সে শুধু কেঁদেই চলছে। অজানা অসহায় শিশুগুলোর জন্য বাংলাদেশের একটি ছোট্ট দম্পতির দুজনই বিপর্যস্ত। পৃথিবীতো জানবে না। পৃথিবীর সেই হর্তাকর্তাদের হৃদয় কেনো এই দম্পতির মতো কেঁদে ওঠে না? হঠাৎ ভেতর থেকে ঝুমুর চিৎকারের আওয়াজ।

মিলন দৌড়ে যায় বেড রুমে। দেখে রৌদ্র জোরে শ্বাস নিচ্ছে। বুকের পাটি একবার উপরে উঠছে আবার নিচে নামছে। ঝুমু শুধু বলছে, ও আল্লাহ, আমার ছেলের কি হলো!!! পৃথিবীর ঐ প্রান্তের বিষাক্ত বাতাস আমার ছেলের নাকে কি করে গেলো। মিলন তাড়াতাড়ি রৌদ্রকে কোলে তুলে সিড়ি বেয়ে নামছে।

ঝুমুও দৌড়াচ্ছে। এতো রাতে কিছু নেই। মিলনের কোলে রৌদ্র আর সাথে ঝুমু তারা দৌড়াচ্ছে। শ্বাস কষ্টে ৩ বছরের রৌদ্র। তারা দুজনই আর্তনাদ করছে।

ছেলেকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে যে কোনো মূল্যে। ফাঁকা রাস্তায়, অন্ধকার ভুতুড়ে রাস্তায় এই দম্পতি দৌড়াচ্ছে হাসপাতালের দিকে। এ যেনো গাজার কোনো এক দম্পতির প্রতিচ্ছবি। হয়তো এমনই।

হঠাৎ একটি রিক্সা দেখতে পেলো। উঠে গেলো। কাছাকাছি ল্যাব-এইড হাসপাতাল। মিলন রিক্সাওয়াকে বলছে, ভাই তাড়াতাড়ি ল্যাব-এইড যাও। রৌদ্র তখনও মিলনের কোলে।

ঝুমু পাশে বসে হাপাচ্ছে। মিলনও হাপাচ্ছে। তাদেরও নিশ্বাসে তেজ আছে। বাতাসের অক্সিজেন তারা পাচ্ছে। কিন্তু শ্বাসকষ্টে বিপর্যস্ত রৌদ্রের জন্য অক্সিজেন যেনো কম।

চোখ বন্ধ করে অক্সিজেন ভেতরে নেয়ার এক আপ্রাণ চেষ্টা করছে শিশুটি। মিলন রৌদ্রের কপালে হাত রাখলো। তখন চারিদিকে ঠান্ডা বাতাস। নির্মল বাতাস। মিলন বলছে, বাবারে বাতাসে কত্ত অক্সিজেন; সবার জন্য আছে.....খালি তোর জন্য নাই রে....আল্লাহ খালি তোর জন্য দিলো না........


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.