ভাসমান
জাহান্নামের পথে
মুআম্মার আল-গাদ্দাফী
মানুষের এই সমাজের যে দৃশ্যগুলো আমি একই সাথে খুব পছন্দ করি এবং ভয় পাই, তার অন্যতম : গণমানুষের বিক্ষোভ, সংঘবদ্ধ মানুষের বিদ্রোহ। গণবিক্ষোভের একটা দৃষ্টিনন্দন এবং অপর দিকে একটা নির্দয় দিক আছে। গণ মানুষের বিক্ষোভ সামনের দিকে এগিয়ে যায় বাঁধ ভাঙ্গা পাগলা জোয়ারের মত, আক্রান্ত কারো করুণ আর্তনাদের প্রতি কর্ণপাত করে না, অসহায় আর্ত কারো দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় না, গণবিক্ষোভ বরং এগিয়ে যাই বেপরোওয়াভাবে অনুভূতিহীন পায়ে সব কিছু মাড়িয়ে, ভেঙ্গে-চুড়ে। বিক্ষোভের সব চেয়ে দুর্বল রূপ হচ্ছে ব্যক্তির বিক্ষোভ। কারণ ব্যক্তি সব কিছুর পরে ব্যক্তিই, তার বিক্ষোভকে অনায়াসে থামিয়ে দিতে পারে গোষ্ঠী বা সাধারণ কোনো মানুষ।
কিন্তু গণ বিক্ষোভ সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ গণবিক্ষোভ। গণবিক্ষোভ মানে সর্বনাশা পাগলা ঢল, সংঘবদ্ধ অন্ধ শক্তি, সাধারণ কোনো শক্তির পক্ষে যাকে থামানো সম্ভব নয়।
আমি পাগলের মত ভালবাসি গণমানুষের স্বাধীন, শৃঙ্খল ভাঙ্গা এই গণবিক্ষোভকে, ভালবাসি কান্না ও বেদনার পর তাদের এই সমবেত হল্লা ও মাতাল গান। কিন্তু সাথে সাথে আমি খুব ভয়ও পাই জিনিসটাকে।
একটা গ্রাম্য শিশু যেমন গ্রামীণ পরিবারের একমাত্র প্রতাপী কর্তা তার বাবাকে একই সাথে ভয় পায় ও ভালবাসে। আমি গণবিক্ষোভকে একই সাথে ভালবাসি ও ভয় পাই, যেমন আমি ভালবাসি ও ভয় পাই আমার প্রতাপশালী বাবাকে।
মুখরিত উৎসবের মুহূর্তে গণমানুষ খুব আবেগ উদ্বেলিত ও উদার হয়ে যায়। তখন তারা তাদের নেতাদের মাথায় করে নাচে। এই জনগণ হ্যানিবাল, প্যারেক্লিস, ........... দের মাথায় করে নেচেছে।
কিন্তু ক্ষেপে গেলে এই নাচুনে জনগণই তাদের নেতাদের নির্দয়-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা কর্তে হ্যানিবলকে বিষ খাইয়ে মারে, লোহার খাচায় বন্দী করে ছাফুনারোলার গায়ে আগুন দেয়, .... এর মুখ থেতলে দেয়, মোছেলিনীর লাশ হেঁচড়ে পথে পথে ঘুড়ায়, কিসোনের মুখে থুথু ছিটিয়ে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে আনে (যাকে এই জনগণই একদিন করতালি দিয়ে তাতে ঢুকিয়ে ছিল) !!
হায়রে খোদা !! অনুভূতিহীন কাওকে কি বুঝিয়ে সুজিয়ে অনুভূতিশীল বানানো সম্ভব, বিমূর্ত গণ একটা মাথাকে কি বুঝানো সম্ভব ?.. কে যাবে কোটি কোটি হাতগুলো ধরে ঠিক পথে নিয়ে যেতে ? কে শুনবে কোটি কোটি মুখের, একই সময়ে উচ্চারিত কোটি কোটি শব্দ ? কে কাকে বুঝাতে যাবে ? ... এই দলবদ্ধ আগুনটা সত্যিই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। এই সমাজ, যা তোমাকে ভালাবাসে কিন্তু তোমার উপর বিন্দুমাত্র দয়া করে না, তার সামনে আমি খুব বিব্রত বোধ করি। এই জনগণ, যারা ভালভাবে জানে তোমার কাছে তারা কি চায় কিন্তু তুমি তাদের কাছে কি চাও তার তোয়াক্কা করে না, তোমার কাছে তাদের পাওনা হকগুলো মুখস্ত করে রাখে কিন্তু তাদের কাছেও যে তোমার কিছু পাওনা থাকতে পারে তা বেমালুম ভুলে যায়.. এই জনগণ যারা হ্যানিবলকে বিষ খাইয়ে মেরেছে, .... কে পুড়িয়ে মেরেছে, ...এর মাথা থেতলে দিয়েছে... যারা তোমাকে ভালবাসে কিন্তু তোমার জন্য সিনেমাহলে একটা চেয়ার বা চায়ের দোকানে একটা টেবিল ছাড়তেও রাজি নয়... এই জনগণের সামনে আমি খুব অসহায় বোধ করি। আমি একজন সাধারণ, নিরীহ গ্রাম্য ছেলে। এই আধুনিক উন্মাদ নগরটায় আমার খুব দিশেহারা লাগে।
তার নাগরিকরা আমাকে ক্রমশ পাগল করে দিচ্ছে, ওরা আমাকে বাগে পেলেই নির্দয়ভাবে দংশন করতে থাকে : এই বাড়ি ঘর আমাদের পছন্দ হচ্ছে না, আমাদের নতুন বাড়ি বানিয়ে দাও, পথগুলো আরো চওড়া কর, গাড়ি কিনে দাও, সমুদ্র বন্দর বানাও, মাছ ধরে খাওয়াও, এই কুকুরটাকে মার, একটা বিড়াল কিনে আন আমাদের জন্য.... তারা বিরামহীনভাবে আমাকে এভাবে দংশন করে যায়। হায় খোদা !! আমি কি আর তাদের সাথে কুলোতে পারি, আমি তো অসহায় বুদ্ধ একটা গ্রাম্য ছোকরা, যার এমনকি বার্থ সার্টিফিকেট পর্যন্ত নাই, যে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সড়কের আলোর সংকেতগুলো দেখে থামে না, পায়ের সামনে কিছু পড়লে মহা আনন্দে লাথি হাকায়, তা ছুটে গিয়ে শহুরে কোনো দোকানের কাঁচ ভেঙ্গে দিল বা সুন্দর শুভ্র কোনো প্রাসাদ বাড়ির শার্সিতে গিয়ে পড়ল, বা কোনো বুড়ির মাথা ফাটাল .. তার কোনো তোয়াক্কা করে না, যে রাস্তায় পুলিশদের সাথে যখন তখন ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়, যে হাত না ধুয়েই খাবার পাতে হাত দিয়ে বসে, যে জানে না পেপসি কোলা বা বিয়ার খেতে কেমন লাগে, যে ময়দানুশ শুহাদায় গিয়ে উট খুঁজে, ছাহা খাদরায় গিয়ে ঘোড়ার তালাশ নেয়, মায়দানুশ শাজারায় গিয়ে মেষ তাড়ায়... এই গ্রাম্য বুদ্ধ ছেলেটা কি পারবে এই জনগণের সাথে, যারা এমনকি তাদের উদ্ধারকর্তাদের পর্যন্ত দয়া করে না ? আমার খুব ভয় লাগে, মনে হয় তারা সবসময় আমাকে তাড়া করে ফিরছে... ওরা আমাকে পুড়িয়ে ফেলবে.. এমনকি ওরা যখন আমার উদ্দেশ্যে করতালি দেয় তখনও মনে হয় ওরা আমাকে তাক করে গুলি ছুড়ছে... আমি একটা সাধারণ গ্রাম্য বুদ্ধ ছেলে, কায়দা করে পোষাক-আশাক পরতে জানি না, সাজ সজ্জা বুঝি না, ম্যাকাপ নিতে জানি না, এমনকি ড্রেনের মানে জানি না.. আঁজলা ভরে অনায়াসে বৃষ্টি ও কূপের পানি খেয়ে ফেলি.. বুকে পিঠে কোনোভাবে সাঁতার কাটতে জানি না.. ঠিক মত দিনার চিনি না, নানা মানের নোটগুলোর মাঝে গোল পাকিয়ে ফেলি.. কিন্তু ওরা সবাই আমার কাছে এই সবই চায়.. ওদের কে বুঝাবে যে আমি সাধারণ একটা গ্রাম্য ছেলে, আমি এই সব পারি না, আমার কাছে এগুলো নেই ? তবে আমি চোরদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইঁদুর ও কুকুরগুলোর মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে তাদের মাঝে এই সব বিলিয়ে দেই, বলি আমি 'মরু ত্রাণকর্তা', 'শৃঙ্খল থেকে তোমাদের মুক্তিদাতা'। হিংস্র সেই সব নখরগুলো তাদের কাছ থেকে যা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং যুগ যুগ ধরে আত্মসাৎ করে যাচ্ছে তা পুনরুদ্ধারের জন্য দীর্ঘ সময় ও শ্রম দরকার এবং এটা কোনোভাবেই কারো একার কাজ নয়। কিন্তু এই আধুনিক উন্মাদ শহরটার নগরবাসীদের দাবি আমাকে চোখের পলকে এই সব হাজির করতে হবে। আমি খুব দিশেহারা বোধ করি।
এক সময় আমার মনে হয় আমিই এই নগরের সবচেয়ে অসহায়, নি:স্ব এবং সাধারণ মানুষ, তাদের মত আমার সেনিটারী মিস্ত্রি, পার্লার বা নাপিতের দরকার পরে না। কিন্তু তাতেও তাদের হবে না। আমি তাদের মত চলি না, আচরণ করি না বলে এই নগরে আমার এক ধরনের অপাংক্তেয় দশা ঘটে। প্রায় পুলিশের সাথে আমার ঝগড়া বেঁধে যায় এবং সেটা নগরবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, কেউ হাত তালি দেয় কেউবা মুখ উপচে গালাগাল ছিটায়। সব জায়গায়, প্রায় প্রতি মুহূর্তে আমি একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পরে যাই।
তবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে আমার এই শোচনীয় দশা উদ্ভবের পিছনে আমার নিজরও ভুমিকা আছে : আমি নিজেই তো মুসার লাঠি চুরি করেছি এবং তা দিয়ে আঘাত করে এই মরুতে বিশাল একটা কূপ সৃষ্টি করেছি (কূপই বললাম, কারণ আমি আগেই বলেছি আমি ড্রেনের মানে বা সেনিটারি পেশার কিছুই জানি না) তারপর আমিই তো এই নগরবাসীদের মাছ শিকার ও মাছ খাওয়া শিখিয়েছি। আমার আশা ছিল এর ফলে তারা কিছুটা শান্ত হবে, তাদের বিরামহীন দাবিদাওয়াগুলো থেকে আমাকে আপাতত মুক্তি দিবে ! কিন্তু হায়রে আমার কপাল ...
তারা কি আমাকে আমার মত করে থাকতে দিতে পারে না.. সাধারণ নিরীহ একজন মানুষ ...। আমি কোনো রাজ বংশের সন্তান নই, আমি বরং সাধারণ একটা গ্রাম্য পরিবারের ছেলে .. আমার কোনো ডক্টরেট ডিগ্রি নেই, আমি বরং ওই শব্দটাকেই অপছন্দ করি.. এমনকি চিকিৎসকদের তারা 'ডক্টর' বলে বলে আমি চিকিৎসকদেরও দেখতে পারি না। ডাক্তার বেটাদের আমি আমার কাছে ভিড়তে দেই না। তাই তারা এখনো কোনো 'এ্যন্টি ইমোশান' টিকা দিয়ে আমার আবেগ মেরে ফেলতে পারে নি।
আমি খুবই আবেগপ্রবণ। কিন্তু নগরবাসীদের এই সব আগেব-ফাবেগ নেই। অনেক আগেই তাদের আবেগনাশাক টিকা দেওয়া হয়ে গেছে, রোমান, তুর্কি, সর্বশেষে মালিকান .. ইতিহাসের এই সব পর্বেই তাদেরকে ভাল করে এই সব টিকা দেওয়া হয়েছে। তোমরা শুনে হয়তো হাসবে .. আমি তোমাদের মত 'আমরিকা' বা আমরিকান' শব্দটা 'র' দিয়ে উচ্চারণ করতে পারি না। আমি তা উচ্চারণ করি 'ল' দিয়ে।
কারণ আমি 'আমরিকা' শব্দটার অর্থ জানি না। তবে আমি জানি, কলম্বাস নামের লোকটা আমরিকা আবিষ্কার করে নি, আমেরিকা আবিস্কার করে ছিল এক আরব রাজা। তবে আমি জানি আমেরিকার অনেক শক্তি, বিপুল ক্ষমতা, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টগুলোতে সে তার নিজস্ব সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে, ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার জন্য যখন যা খুশি করে ফেলতে পারে.............. আমরিকা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বিকট সাম্রজ্যবাদ। তবে আমি 'আমরিকা' বলি না বলি 'আমলিকা'। আমার ফুফু ইজ্জতের ছেলে হাজি মুজাহিদ আমাকে এমনই শিখিয়ে ছিলেন।
আসলে স্বেচ্ছায় এই নগরে এসে আমি আমার নিজের উপর ভয়ংকার একটা অপরাধ করেছি। কেন তা করতে গেলাম ?.. তার কায়কারণ খোলাসা করার মত যথেষ্ট সময় এখন নেই। সংক্ষেপে বলতে পারি, কঠিন একটা পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমি এই নগরে এসেছিলাম। তোমাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ : তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আবার গ্রামে ফিরে যাব, আবার উপত্যকায় উপত্যকায় ঘুড়ে মেষ চড়াব।
আমার মেষগুলোকে আমি মায়ের কাছে রেখে এসেছিলাম। কিন্তু আমার মা এখন আর নেই, তিনি মারা গেছেন, তার সাথে সাথে মারা গেছেন আমার বড় বোনও। বর্ষীয়ান আত্মীয় স্বজনের মুখে শুনতে পাই : আমার নাকি অনেকগুলো ভাই বোন ছিল। কিন্তু নির্দয় 'মশাগুলো' তাদের সবাইকে এক সাথে খুন করেছে... আমাকে আমার এই সব দু:খ-বেদনা, স্বপ্ন-দু:স্বপ্ন নিয়ে একা একা থাকতে দাও। কেন তোমরা আমাকে এমন তাড়া করে ফের, তোমাদের বাচ্চাদের লেলিয়ে দেও আমার পিছনে ? তোমরা কি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না ? এমনকি তোমাদের নগরের পথেঘাটেও বের হতে দিবে না ? আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ এবং আমি আপেল খেতে খুব পছন্দ করি।
তোমরা কি আপেল কেনার জন্য বাজারেও যেতে দিবে না আমাকে ? তাছাড়া ... প্রসঙ্গত মনে পড়ল, তোমরা আমাকে পাসপোর্ট দিচ্ছ না কেন ?.. পাসপোর্ট দিয়ে আমি কি করব ? .. তাও ঠিক। আমি তো নিছক ঘুড়তে.. গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে বা চিকিৎসার জন্য বাইরে কোথাও যেতে পারি না। সেটা নিষেধ। আমার শুধু বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে যখন তোমাদের বড় কোনো কাজ আমাকে করতে হয়... আমার আর কিচ্ছু ভাল লাগে না..তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি জাহান্নামে পালিয়ে যাব।
একটু বস, আমি তোমাদের আমার জাহান্নামে পালিয়ে যাওয়ার গল্পটা শোনাব : জাহান্নামে কিভাবে যাওয়া যায়, জাহান্নামে যাওয়ার পথ কি.. জাহান্নাম দেখতে কেমন .. এই সব এবং কোন পথে আমি জাহান্নামে গেলাম কিভাবে গেলাম এবং কিভাবে আবার একই পথে ফিরে এলাম .. এই সব আমি তোমাদের বিস্তারিত শোনাব।
আমার বিশ্বাস তোমরা ভালই মজা পাবে। সত্যিই আমার জাহান্নামযাত্রা প্রায় মহান কোনো অভিযাত্রার মত। না .. এটা কোনো কাল্পনিক গল্প নয়। খোদার কছম খেয়ে বলছি.. একেবারে সত্য ঘটনা। আমি দুইবার জাহান্নামে গিয়েছি।
পালিয়ে গিয়েছি জাহান্নামে, তোমাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য। তোমাদের অস্তিত্ব আমাকে খুব বিব্রত করে, আমার নি:স্বঙ্গতা ধ্বংস করে দেয়.. এমনকি আমার কাছ থেকে আমার যাবতীয় নিজস্বতা, আমার অস্তিত্ব ছিনিয়ে নিতে চায়.. ভয়ংকর নিষ্ঠুরভাবে আমাকে নিংড়ে যাবতীয় জীবনী রস চেটেপুটে খেয়ে ফেলে। তোমাদের অস্তিত্বগুলো সারাক্ষণ আমাকে পাগলা কুত্তার মত তাড়া করে ফেরে.. বিকট একটা পাগলা কুত্তা, যার বিশ্রী লালা অবিরাম ঝড়তে থাকে তোমাদের আধুনিক উন্মাদ নগরটার পথে পথে। আমি পালানোর চেষ্টা করলেই, মাকড়সা যেমন জাল বেয়ে তার বন্দী শিকারের দিকে ছুটে যায় তেমনি আমার দিকে তেড়ে আসে কুকুরগুলো। তাই সংগোপনে আমি জাহান্নামে পালিয়ে গেছি।
তোমরা যেমন কল্পনা কর.. বা দাজ্জাল মোল্লারা তাদের অসুস্থ কল্পনা থেকে তোমাদের সামনে জাহান্নামের যে চিত্র তুলে ধরে বাস্তবে জাহান্নামের পথ কিন্তু তেমন কিছু নয়। হা.. আমি তোমাদের বলছি, আমি তা ভালবাবেই জানি। কারণ আমি দুইবার জাহান্নমে গিয়েছি, বিশুদ্ধ গভীর এক বুক প্রশান্তি নিয়ে তার বুকে দুই রাত কাটিয়েছি এবং আমি মনে করি স্বপ্নমুখর সেই দুই রাত আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও সুখকর মুহূর্ত, তোমাদের সাথে বাস করার চেয়ে জাহান্নামে থাকা আমার কাছে হাজার হাজার গুণ ভাল.. তোমরা তো কেবলই আমাকে তাড়া করে ফের.. আমাকে কখনই একা শান্তিতে একটা মুহূর্ত কাটাতে দাও না। তাই আমি তোমাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য জাহান্নামে পালিয়ে গেছি। শুরুতে তার পথে পথে সবুজ প্রাকৃতিক গালিচা বিছিয়ে জাহান্নাম তোমাকে স্বাগত জানাবে... কার্পেট মোড়া পথটা শেষ হলে শুরু হবে নরম বালি ঢাকা একটা নির্জন পথ।
সেই বালি পথে নেমেই আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম : ঝাক ঝাক পাখি উড়ছে.. এদিক সেদিক কিছু কিছু গৃহপালিত পশু চড়ে বেরাচ্ছে। সেই চারণভূমিটা পার হতেই অতর্কিত এবং খুবই ভীষণভাবে পথটা নিচে নেমে গেছে। সেই খাড়া উপত্যকার কিনারায় দাঁড়িয়ে থমকে গেলাম ... কারণ সেখানে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে জাহান্নাম। না.. জাহান্নামের ভয়ে আমি থেমে যাই নি। আমি জাহান্নামকে খুব পছন্দ করি.. তোমাদের এই শহুরে জীবনে আমি যখন অতিষ্ঠ হয়ে যাই তখন এই জাহান্নমই তো আমার একমাত্র আশ্রয় হয়।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে জাহান্নাম... না আগুনের মত লাল নয় জাহান্নাম... জলন্ত অঙ্গারের মত কিছু নয়। আমার চোখের সামনে জাহান্নাম ভেসে ওঠতেই আনন্দে আমার উড়াল দিতে ইচ্ছে করল। লাফিয়ে ওঠে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ ধরে ছুটে যেতে লাগলাম জাহান্নামে দিকে। মোল্লারা তোমাদের বলে কয়েক হাজার বছর ঘোড়ার পথের দূরত্ব থেকেই নাকি জাহান্নামের বিকট ক্রুদ্ধ চিৎকার এবং জাহান্নামবাসীদের করুণ আহাজারি শোনা যায়। কিন্তু আমি কোনো বিকট চিৎকার বা আর্তনাদ শুনতে পেলাম না।
ভীষণ নীরব শান্ত এলাকা জাহান্নাম, তাকে ঘিরে থাকা পাহাড়গুলোর মতই নিস্তব্ধ গম্ভীর। গাম্ভির্য ও প্রশান্তি মোড়া একটা অদ্ভুত আবহ ছড়িয়ে আছে জাহান্নাম জুড়ে। কোথাও লকলকে টাইপের কিছু নজরে পরল না। তবে তার আকাশে ঝুলে আছে এক রাশ ধুঁয়া। অধীর আগ্রহে এবং দ্রুত পায়ে জাহান্নামের দিকে ছুটে গেলাম।
সূর্য ডুবার আগে এবং তোমাদের নরকের প্রহরীরা আমাকে ধরে ফেলার আগেই আমাকে জাহান্নামের উষ্ণ বিছানায় গিয়ে পৌঁছতে হবে... এই তো জাহান্নাম... আমি এখন দাঁড়িয়ে আমার প্রিয় জাহান্নামের মুখোমুখি, তার খুব কাছে... আর একটু দাঁড়াও ! তোমাদের আমি, জাহান্নাম কেমন দেখলাম সে গল্প বলব। জাহান্নাম সম্পর্কে যে যা জানতে চাও আমি তার বিস্তারিত উত্তর দিতে পারব। কারণ আমি জাহান্নামে গিয়েছি, তার ভেতরে বসে মুগ্ধ হয়ে তার রূপ দেখেছি।
আদিম, কালো কালো পোড়া পাথরে গড়া কয়েকটি অন্ধকার, কুয়াশাচ্ছন্ন দুর্গম গিরিপথ ঘিরে আছে জাহান্নামকে... সেই গিরিপথ পেরিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করার সময় আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেলাম পশু-পাখি-গাছ-পালা.. আমার মত এরা সবাইও জাহান্নামে যাচ্ছে দলে দলে। সবাই জাহান্নামে পালিয়ে যাচ্ছে তোমাদের নাগরিক মানুষদের হাত থেকে বাঁচার জন্য।
জাহান্নামে প্রবেশ করার সাথে সাথে আমার আশ-পাশ থেকে সব কিছু উধাও হয়ে গেল, শুধু থাকলাম আমি এবং আমার একান্ত 'আমি'। জীবনে আর কখনো, আর কোথাও আমি আমার নিজেকে এত ঘনিষ্টভাবে পাই নি। এমনকি সূর্য.. সূর্যও এখানে আমার নাগাল পেল না, এখানে কিছু নেই.. সব যেন অস্তিত্বহীন। শুধু আমি এবং আমার সাথে আমার 'আমি'। সেই 'আমি'ও সম্পূর্ণ মিশে গেল আমার মাঝে, আমিও ক্রমশ মিশে যেতে লাগলাম তার অস্তিত্বে।
এক সময় মনে হল এই প্রথম আমরা দুইজন অভিন্ন কোনো অস্তিত্ব হয়ে গেছি। আমার 'আমি' এতদিন আমার বাইরে ছিল, ব্যাপারটা তেমন নয়। কিন্তু এতদিন তোমরা আমাকে তার সাথে একান্তে মিশতে দাও নি, তাকে একটু সময় দিব, সোহাগ করব, একান্তে কানে কানে পরাণের কথা কইব.. তোমরা আমাকে কখনো সে সুযোগ দাও নি। আমরা_আমি এবং আমার আমি'_ তো তোমাদের এই নগরে ভয়ংকর দুই অপরাধী। দীর্ঘ তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদের পর ্ত কোনো অপরাধ প্রমাণ না হলেও্ত তোমরা আমাদের জেলে পুরে রাখ, আমাদের দু'জনকে মিলিত হতে দাও না।
কারণ সেটা তোমাদের নিজেদের সুখের জন্য জরুরী, সেটা তোমরা বুঝে গেছ... আহ কি সুন্দর জাহান্নাম !! জাহান্নাম তোমাদের এই পাগলা নগর থেকে অনেক সুন্দর। তোমরা কেন আমাকে আবার ফিরিয়ে আনলে ?.. আমি আবার জাহান্নামে ফিরে যেতে চাই... বরং আমি স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থেকে যেতে চাই... তোমাদের পাসপোর্ট তোমরা রেখে দাও, আমাকে পাসপোর্ট দিতে হবে না। কারণ জাহান্নামে যেতে পাসপোর্ট লাগে না। তোমরা শুধু আমার কাছে আমার 'আমি' কে ফিরিয়ে দাও... যথেষ্ট হয়েছে.. তোমরা তাকে আর বিকৃত-নষ্ট কর না, আমাদের ছেড়ে দাও .. আমরা দু'জন একাকি জাহান্নামে চলে যাই।
তোমরা আমার 'আমি' কে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়ে ছিলে।
কিন্তু জাহান্নামের আশ্রয় নিয়ে আমি তাকে রক্ষা করতে পেরেছি। ব্যাস আমার ওতেই হবে। তোমাদের কাছে আমার আর কোনো দাবি নেই। ডাস্টবিন ভরা এই সব কাগজ পত্র তোমাদের জন্য থাকল। সেগুলোর ভালভাবে হেফাজত কর, তোমাদের কাজে লাগবে।
আর আমার সোনালী রাজ মুকুট্তযা আমি উকিলের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছিলাম্ত আমি কায়রোতে রেখে এসেছি। তোমরা তা নিয়ে নিও। আর সে যে স্বর্ণখচিত আংটি 'লাব্বাইক শাব্বাইক' তাও তোমাদের দিয়ে দিচ্ছি। ওই আংটি যে পরবে সে সাথে সাথে সম্রাট হয়ে যাবে, বিনা হুজ্জতে রাজাসনে গিয়ে বসতে পারবে, পৃথিবীর সব সম্রাট, রাজ-রাষ্টপতিরা তার সামনে নতজানু হয়ে তাকে কুর্নিশ করবে.. সে মৃত কন্যা মুঈতিকাকে আবার জীবিত করতে পারবে, আমার পুনর্জীবন দান করতে পারবে ওমর মুখতার, সাদুন আব্দুস সালাম আবু মিনয়ার সহ অজ্ঞাত সব জাতীয় শহীদদের। ওই আংটি পরার সাথে সাথে তুমি পাবে চার মিলিয়ন দিনার কিংবা তার চেয়েও বেশী কিংবা চার মিলিয়ন দিনার থেকে কয়েক দিনার কম।
ওই আংটি পরার পর তুমি যা চাইবে তাই পাবে : যে কোনো ধরনের অস্ত্র চাইবে, এমনকি যদি দুরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র বা আনবিক বোমাও চাও, তোমার সামনে এসে হাজির হবে চাহিবা মাত্রই, সুমুদ্র মরুভূমি.. সব তোমার অধীনে চলে আসবে, ........... এর তোয়াক্কা না করে যে কোনো ইংরেজকে বন্দী করতে পারবে বা মুক্তি দিতে পারবে... অনুরূপ ওই জাদুর রাজমুকুট তোমার শিরস্ত হওয়ার সাথে সাথে তুমি অবাধ অবিরাম আলসেমির সুযোগ পাবে, যখন তখন ঘুমিয়ে পড়তে পারবে এমনকি যখন দেখবে তোমার চোখের সামনে তোমার মেষ পালে বাঘ পড়েছে তখনও তুমি নিশ্চিত ঘুমিয়ে পরতে পারবে, রাশি রাশি আবর্জনার উপর শুয়েও তোমার ঘুমাতে কোনো কষ্ট হবে না। সুতরাং ঘুমাও .. তোমরা এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাও .. আরব কন্ঠস্বরে শুনেছি তোমাদের নাকি এই সৃষ্টিশীল ক্ষমতাটা নাই... সংবাদপত্রে পড়লাম ১০ নম্বারধারী শয়তান নাকি সেই লোহার মুকুট.. দু:খিত সেই সোনালী জাদুর রাজমুকুটটা বাগিয়ে নিয়েছে এবং সে প্রেক্ষিতে নিজেকে সম্রাট দাবি করেছে এবং চার্চিল ও টরম্যানও নাকি তা মেনে নিয়েছে ? !!
আর তোমরা এই রূপকথায় বিশ্বাস করে ইবলিসের ফাঁদা জালে পা দিলে। পরিণতি যা হবার তাই হল। তোমাদের দুর্দশা দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। শুনতে পেলাম তোমাদের মসজিদে মসজিদে খতিব সাহেবরা বুক ভাসিয়ে খোদতালার কাছে ফরিয়াদ করছেন : হে আল্লাহ ! আমাদের অবস্থা আপনার অজানা নেই.. আমাদের দুর্বলতার কথাও আপনি জানেন.. আপনি ছাড়া আমাদের আর কোনো আশ্রয় নেই .. আমীন .. আমীন ..
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।