ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....
সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রধানত মহাসাগরগুলোতে বিচরণ করে। এদের কিছু প্রজাতি ডিম পাড়ে পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি দ্বীপে। বর্তমানে সাতটি প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ পাওয়া যায়। আইইউসিএন-এর তালিকা অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ান ফ্ল্যাট ব্যাক ছাড়া অন্যান্য সব প্রজাতির কচ্ছপের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।
সরীসৃপ প্রজাতির অতি প্রাচীন এবং সামুদ্রিক জীব-বৈচিত্র্যের একটি স্বতন্ত্র অংশ হচ্ছে সামুদ্রিক কচ্ছপ।
জানা যায়, এরা সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ১০ কোটি বছরেরও আগে। সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রাপ্তবয়স্ক হতে প্রায় ৩০ বছর সময় নেয়। এরা ১৮৯ বছর পর্যন্ত বেচে থাকে।
বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সঙ্গে এদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এ কারণেই দক্ষ নাবিকের মতো বহু বছর পরও এরা নিজেদের জন্মস্থান খুজে ডিম পাড়ার জন্য ফিরে আসে।
এরা উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক পুষ্টির যোগান দিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। এদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য পানি থেকে বাতাসের সংস্পর্শে এবং ডিম পাড়ার জন্য বালুকাময় সৈকতে আসতে হয়। জেলি ফিশ, কাকড়া, শামুক, ঝিনুক, নুইন্যা, স্পঞ্জ, সামুদ্রিক গাছগাছড়া এদের খাদ্য। এদের কিছু মাংসাশী এবং কিছু তৃণভোজী।
স্ত্রী কচ্ছপ বালুচরে ৫০ থেকে ১০০ সে. মি. গর্ত করে ডিম পাড়ে এবং ৪৫ থেকে ৭০ দিন পরে বালির উত্তাপে ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়।
প্রতিটি স্ত্রী কচ্ছপ এক সঙ্গে ৫০-১৮০টি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার পরে কচ্ছপ মা এগুলোর আর কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না। কচ্ছপের বাচ্চারা তাপমাত্রার ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল থাকে।
সামুদ্রিক কচ্ছপ সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ করে খাদ্য শৃঙ্খল বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জেলি ফিশ হলো সামুদ্রিক কচ্ছপের অন্যতম খাদ্য।
অন্যদিকে জেলি ফিশ মাছের পোনার অন্যতম খাদ্য। কচ্ছপ জেলি ফিশের সংখ্যা কাঙ্খিত পর্যায়ে রাখে। সামুদ্রিক কচ্ছপ এক উপকূল থেকে অন্য উপকূলে সামুদ্রিক গাছগাছড়ার বিস্তার ঘটায়। এরা পর্যটকদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। প্রতি বছর বিদেশি পর্যটকরা সামুদ্রিক কচ্ছপ দেখতে আমাদের দেশে আসে।
অনিয়ন্ত্রিত ভাবে মাছ ধরার কারণে সামুদ্রিক কচ্ছপ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের জাল যেমন, ভাসা জাল, শীল জাল ও চিংড়ি ট্রলার প্রচুর পরিমাণে কচ্ছপের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এদের মধ্যে সব থেকে মারাত্মক হচ্ছে বাণিজ্যিক চিংড়ি জাল। তিনকোনাকার এ জালগুলোর মধ্যে কচ্ছপসহ যা কিছু প্রবেশ করে কোনো কিছুই রক্ষা পায় না। পৃথিবীর বহু দেশে কচ্ছপ রক্ষা করার জন্য চিংড়ি জালে টিইডি (Turtle Excluder Device-TED) লাগানোর নিয়ম আছে।
তবে টিইডি ব্যবহারের কোনো আইন আমাদের দেশে নেই। তাই কোনো চিংড়ি ট্রলারকেই টিইডি ব্যবহার করতে দেখা যায় না। এর ফলে অসংখ্য শিশু ও পূর্ণবয়স্ক কচ্ছপ বঙ্গোপসাগরের পানিতে ডুবে মারা যায় এবং শেষে সমুদ্রচরে এদের লাশ ভেসে ওঠে।
বাংলাদেশের জলসীমায় ৫ প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ বিচরণ করে। এরা হচ্ছে অলিভ রিডলে কচ্ছপ, সবুজ কচ্ছপ, হকসবিল কচ্ছপ, লেদার ব্যাক কচ্ছপ ও লগার হেড কচ্ছপ।
সুন্দরবন থেকে সেন্ট মার্টিন্স পর্যন্ত প্রধানত অলিভ রিডলে ডিম পাড়ে এবং সবুজ কচ্ছপ গুটিকয়েক জায়গায় দেখা যায়। দেশের মধ্যে সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপই একমাত্র জায়গা যেখানে হকসবিল কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। মানব সৃষ্ট হুমকির কারণেই কচ্ছপের সংখ্যা আজ সঙ্কটাপন্ন।
সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার মৌসুম আরম্ভ হয় জুলাই-আগস্ট মাসে এবং তা এপ্রিল পর্যন্ত চলে। তবে ব্যাপকভাবে ডিম পাড়ে অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে।
অলিভ রিডলে এবং সবুজ কচ্ছপ প্রতিবছর ডিম পাড়ে তবে হকসবিল কচ্ছপ মাঝে মাঝে ডিম পাড়তে আসে। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের তুলনায় এখানে ডিম পাড়া স্ত্রী কচ্ছপের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কম। অলিভ রিডলের ডিম পাড়তে সময় লাগে ৪৫-৬৫ মিনিট তবে কখনো কখনো ১০০ মিনিটেরও বেশি সময় লাগে। সাধারণত স্ত্রী কচ্ছপ রাত ৮টা থেকে ২টার মধ্যে ডিম পাড়তে ওঠে এবং অন্ধকার রাতে ডিম পাড়তে পছন্দ করে।
সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপের সৈকতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪ কি. মি. যার মধ্যে প্রায় ২ কি. মি. কচ্ছপের ডিম পাড়ার জন্য উপযুক্ত।
পাথর এবং পাথরের বাধ কচ্ছপের ডিম পাড়ার প্রক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে এবং স্ত্রী কচ্ছপকে প্রায়ই ডিম পাড়ার জন্য কয়েকটি গর্ত করতে হয়। বিগত রেকর্ড অনুযায়ী দেখা যায়, পশ্চিম উপকূলের বালুকাময় শিলবনিয়া সৈকতই হলো কচ্ছপের ডিম পাড়ার প্রধান স্থান যেখানে আনুমানিক ৭০% কচ্ছপ ডিম পেড়েছে বলে জানা যায়।
সেন্ট মর্টিন্স দ্বীপে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মেরিন পার্ক স্থাপন বিষয়ে একটি প্রকল্প আছে। প্রকল্পের অধীনে সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণ এবং পর্যটক আকর্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের কাজের মধ্যে রয়েছে, কচ্ছপের ডিম পাড়া পর্যবেক্ষণ করা, হ্যাচারির মাধ্যমে ডিম সংরক্ষণ করা, কচ্ছপের ডিম পাড়ার সৈকত সংরক্ষণ করা, কচ্ছপ সংরক্ষণে গণসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণ প্রকল্প অফিস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের জলসীমায় কচ্ছপের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণ করার জন্য তারা কাজ করছেন। কচ্ছপের জীবন-যাপনসহ অন্যান্য অজানা তথ্য সংগ্রহ এবং সাধারণভাবে দ্বীপের পরিবেশ বিশেষ করে কচ্ছপের পরিবেশ বিনষ্টকারী বিষয়গুলো শনাক্ত করা, স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার এবং পরামর্শের সমন্বয় সাধন করা এবং স্থানীয় জনগণকে কচ্ছপ সংরক্ষণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা তাদের উদ্দেশ্য। সামুদ্রিক কচ্ছপের উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ এবং মাছ ধরা জালে টিইডির ব্যবহার আরম্ভ করা, প্রকৃতি সংরক্ষণ শিক্ষা কার্যক্রম আরম্ভ এবং স্থানীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উচ্চ প্রযুক্তির মাধ্যমে সামুদ্রিক কচ্ছপ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিও এই প্রজেক্টের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বলে জানা যায়। যদিও কচ্ছপ সংরক্ষণের চেয়ে অন্যান্য বিষয়ে প্রকল্পের কর্মকর্তাদের আগ্রহ বেশি বলে স্থানীয় লোকজন জানায়।
মানুষের দ্বারা সৃষ্ট পাথরের বাঁধ সাগর সৈকতে কচ্ছপের ডিম পাড়ায় বাধার সৃষ্টি করে।
মাছ ধরার জালে প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক কচ্ছপ আটকা পড়ে মারা যায়। তাছাড়া সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রায়ই প্লাস্টিক জাতীয় জিনিস খেয়ে মারা যায়। অনেক সময় কুকুর ডিম পাড়তে আসা স্ত্রী কচ্ছপকে খেয়ে ফেলে। স্থানীয় লোকেরা অবৈধভাবে ডিম সংগ্রহ করে। ডিম পাড়ার সৈকতে টুরিস্ট মোটেল স্থাপন।
রাতে সৈকতে গান-বাজনা, টর্চ লাইট জ্বালানো, আগুন জ্বালানো ইত্যাদির ফলে স্ত্রী কচ্ছপ ভয় পেয়ে ডিম না পেড়েই চলে যায়।
আপরাতে সমুদ্র সৈকতে হাটার সময় আপনি সামুদ্রিক কচ্ছপের মুখোমুখি হতে পারেন। তখন সমুদ্র সৈকত ত্যাগ করা বা নীরবতা পালন করে কচ্ছপের ডিম পাড়া পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। কিন্তু কচ্ছপের ডিম পাড়ায় কোনো রকম বিঘ্ন সৃষ্টি থেকে বিরত থাকুন, নীরবতা পালন করুন, পেছন থেকে দেখুন এবং কুকুরের হাত থেকে কচ্ছপকে রক্ষা করুন। টর্চের আলো বা আগুন জ্বালাবেন না।
ফ্লাস লাইট ব্যবহার করে ছবি তুলবেন না। ডিম পাড়ার আগ পর্যন্ত কচ্ছপের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকুন নাহলে সে ভয়ে চলে যেতে পারে। বাচ্চা কচ্ছপ সমুদ্র সৈকতে উঠতে দেখা গেলে কুকুর ও কাঁকড়ার হাত থেকে রক্ষা করে বাচ্চাগুলোকে সমুদ্রের পানিতে চলে যেতে সাহায্য করুন। সমুদ্র সৈকতে রাতে বারবিক্যু করা, আগুন জ্বালানো, জোরে গান-বাজনা করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন। এগুলো কচ্ছপের ডিম পাড়ার জন্য বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
কচ্ছপের ডিম হাতে ধরবেন না, কচ্ছপের পায়ের দাগ মুছবেন না। গবেষকরা এ থেকে কচ্ছপের জাত ও ডিম পাড়ার তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়তে দেখা একটি বিরল সুযোগ। সামুদ্রিক কচ্ছপ পর্যবেক্ষণ করা যে কোনো মানুষের এমনকি অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের জন্যও একটি উত্তেজনাকর মুহূর্ত হিসেবে বিবেচ্য।
[ম্যাপ: লেখক]
[তথ্য ও ছবি: Saving Marine Turtles, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পুস্তিকা ও ওয়েবসাইট]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।