আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাবলো নেরুদা ও কবি মাহবুব উল আলম মিলিত মোহনার নাবিক / মুহম্মদ সবুর



পাবলো নেরুদা ও কবি মাহবুব উল আলম মিলিত মোহনার নাবিক মুহম্মদ সবুর ======================================== ’৪৫ সালেই কলকাতায় আয়োজিত ফ্যাসিবাদবিরোধী শিল্পী লেখক সম্মেলনে কবিয়াল রমেশ শীলকে নিয়ে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে নানাভাবে জড়িত নেরুদা ও মাহবুব উল আলম। খনি শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী আইন প্রণয়নের প্রতিবাদ করায় চিলি সরকারের কোপানলে পড়েছিলেন নেরুদা ’৪৫ সালেই। ১৯৪৭ থেকে ’৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাটান।

এরই একপর্যায়ে ’৫০ সালে দিল্লি এসেছিলেন। অবশ্য ১৯৫২ সালে চিলিতে ফিরে যান। ১৯৭৩ সালে নেরুদা চিরবিদায় নেন, যখন আয়েন্দেকে হত্যা করা হয় ‘আমার স্বাধীনতা পতাকায়/আবার যদি বাড়াও তুমি হাত/আমার আজন্ম লালিত গানে/করো যদি গোপন আঘাত/লুব্ধ যাযাবর এইবার/পাবে না নিস্তার/’ (জারজেরা সবশোন) এই সতর্ক সংকেতদাতা কবি মাহবুব উল আলম। একুশের প্রথম কবিতার এই কবিকে মোহিত করেছিলেন বিশ্বখ্যাত চিলির কবি পাবলো নেরুদা। তেজস্বী কবিকে কাছ থেকে দেখা ও কথা বলার আগ্রহে উঠতি তরুণ দ্রোহী কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম থেকে সুদূর নয়াদিল্লি ছুটে গিয়েছিলেন সেই ১৯৫০ সালে।

বাংলা ভাষার কবিকে নিজের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটিও উপহার দিয়েছিলেন ল্যাটিন আমেরিকার কবি। নেরুদা তার কবিতায় যে দেশপ্রেম, বিদ্রোহ, স্বাধীনতা, সাম্য শাশ্বতের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন শিল্পীত সুষমায়, মাহবুব উল আলম সেই ধারাটিতে পরবর্তীতে নিজেকে প্রকটিত করেছিলেন। পাবলো নেরুদা বিশাল প্রভাব ফেলেছিলেন কবি মাহবুব উল আলমের সাহিত্য ও জীবন দর্শনে। নেরুদার কথা শ্রোতা হিসেবে তার কাছেই প্রথম শোনা। শুধু নেরুদা নয়, প্রায় সমবয়সী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং অকাল প্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রভাবও ছিল তার সাহিত্যচর্চায়।

এই দুই কবির সঙ্গে তার গভীর সখ্যও গড়ে উঠেছিল। উপরের কবিতায় এই স্বর স্পষ্ট। ‘একথা নিশ্চিত জেনো/অসম্ভব ইতিহাসের সম্মুখ গতি পেছনে ফেরানো’। / এই কবিতার কবি মাহবুব উল আলমের কাব্য পাঠ এই তিন কবিকে মনে করিয়ে দেয় অজান্তেই। সুর ও স্বর প্রায় একই রকম।

একুশের প্রথম কবিতাটির সুর পাবলো নেরুদার আরেক বিখ্যাত কবিতাকে মনে করিয়ে দেয়। নেরুদা লিখেছিলেন, “আমাদের সব মৃতদের নামে আমি শাস্তি দাবি করছি/ যারা চৌরাস্তায় গুলি করে হত্যা করেছে আমার ভাইকে। /” ‘আর কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’/ কবিতায়ও ‘সেই সব মৃতদের নামি’/ ‘আমি ফাঁসি দাবি করছি’ উল্লেখ পাওয়া যায়। শুধু নেরুদা নয়, কিশোর থেকে পড়ন্ত বয়স পর্যন্ত কবি মাহবুব উল আলম যেসব কবিতা লিখেছেন, তাতে চল্লিশ দশকের ‘প্রগতিশীল কবিতার ধারাটিই’ বাহিত হয়েছে। ১৯৪৫ সালেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা।

তারাও দারুণ প্রভাব ফেলেছিলেন তার জীবন, সাহিত্য ও রাজনৈতিক দর্শনে। ‘প্রিয়তমাসু’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ শিরোনামে সুকান্তের দুটি কবিতা রয়েছে। অনুরূপ শিরোনামেও লিখেছেন মাহবুব উল আলম। কোন কোন কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে পাওয়া যায় অন্তর্গত স্বরে ও বাচনভঙ্গিতে। মূলত তার কবিতায় এই তিন কবির প্রচ্ছন্ন প্রভাব দেখা যায়।

কবির ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী এদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের অংশীদার ছিলেন এবং এ বিশ্বাসকে কবিতায় সমর্পণ করার অঙ্গীকার তিনি করেছিলেন; আর কারো কাছে না হোক, নিজের কাছে। ’ পাবলো নেরুদার বিপ্লবী চেতনার মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিতগুলো মাহবুব উল আলম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন গভীরভাবেই। তার কবিতা বা কাব্য চেতনায় পাবলো নেরুদা সাহস জোগাতেন। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের পর দীর্ঘবিরতি দিয়ে যখন নব্বই দশকে কাব্যাঙ্গনে ফিরে আসেন এবং সৃষ্টি করেন নতুন নতুন কবিতা, তাতেও চল্লিশের সেই ধারাটিই বহাল ছিল। সমসাময়িক বিষয়গুলো তাকে নাড়া দিত, আর সেসবই কবিতাকারে হতো লিপিবদ্ধ।

পাবলো নেরুদা অবশ্য নিজেকে রাজনৈতিক কবি মনে করতেন না। আবার নিজেকে ভাবাদর্শিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ কবিতার প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করে শ্রেণীভুক্ত করার সমালোচকদের প্রচেষ্টার নিন্দাও করেছেন। অপরদিকে মাহবুব উল আলম তার ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় (১৯৮৮) নিজেকে চিহ্নিত করেছেন এভাবে “আমরা যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে সাহিত্য চর্চা করেছি, তারা সাহিত্যকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির হাতিয়ার হতে হবে এ ধরনের দাবিও এক সময় তুলেছিলাম। এ দাবি যারা সাহিত্যের বিশুদ্ধতা ও নন্দনতাত্ত্বিক সম্পূর্ণতায় বিশ্বাসী তারা অগ্রাহ্য করেছিলেন বটে। তবে আমাদের বুকের তলায় সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে যে আগুন জ্বলছিল তার উত্তাপ কেউ অস্বীকার করতে পারেনি।

এ উত্তাপ নিয়েই আমি চল্লিশ দশকে কলম হাতে নিয়েছিলাম। ” ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই চিলির পারাল শহরে জন্মেছিলেন নেফতালি রিকার্ডো রেস বাসোয়ালতো ওরেফে পাবলো নেরুদা। ১৯২০ সালে ষোল বছর বয়সে পত্রিকায় নেরুদা নাম নিয়ে লেখালেখি শুরু। আর ১৯৫০ সালে যখন দিল্লি আসেন, তখন বয়স ৪৬ বছর। অর্ধেক বয়সী ২৩ বছরের তরুণ মাহবুব উল আলম তার সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন।

উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন কবির কাব্যগ্রন্থ। আর নেরুদার বয়স যখন ২৩, সেই ১৯২৭ সালে চট্টগ্রামের রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন মাহবুব উল আলম। ২০ বছর বয়সেই ১৯৪৭ সালে প্রকাশ করেন মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সীমান্ত’। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নেরুদা চিলির ডিপ্লোম্যাট হিসেবে মিয়ানমার (বার্মা), শ্রীলংকা (সিংহল), জাভা (ইন্দোনেশিয়া), সিঙ্গাপুর, বুয়েন্স আয়ার্স, বার্সেলোনা ও মাদ্রিদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৫ সালে বাম রাজনীতিতে যোগদান করেন।

তার আগেই লিখেন ‘কান্টো জেনারেল’ নামক আলোচিত গ্রন্থ। মাহবুব উল আলম ১৯৪৩ সালেই বাম রাজনীতিতে যোগদান করেন। ’৪৪ সালে চট্টগ্রাম থেকে ‘আবেগ ধারা’ এবং ’৪৫ সালে কলকাতা থেকে ‘ইস্পাত’ নামে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ’৪৫ সালে চট্টগ্রামে প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলন, রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের তিনদিনব্যাপী জন্মজয়ন্তী পালনের উদ্যোক্তা ছিলেন মাহবুব উল আলম। এই ’৪৫ সালেই কলকাতায় আয়োজিত ফ্যাসিবাদবিরোধী শিল্পী লেখক সম্মেলনে কবিয়াল রমেশ শীলকে নিয়ে তিনি যোগ দিয়েছিলেন।

ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে নানাভাবে জড়িত নেরুদা ও মাহবুব উল আলম। খনি শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী আইন প্রণয়নের প্রতিবাদ করায় চিলি সরকারের কোপানলে পড়েছিলেন নেরুদা ’৪৫ সালেই। ১৯৪৭ থেকে ’৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাটান। এরই একপর্যায়ে ’৫০ সালে দিল্লি এসেছিলেন।

অবশ্য ১৯৫২ সালে চিলিতে ফিরে যান। ১৯৭৩ সালে নেরুদা চিরবিদায় নেন, যখন আয়েন্দেকে হত্যা করা হয়। আর ক্ষমতায় আসে পিনোশে। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত মাহবুব উল আলমের পুস্তিকা ‘বিপ্লবী’ ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক কারণে বাজেয়াপ্ত করেছিল। নেরুদার বই অবশ্য সেসময় বাজেয়াপ্ত হয়নি।

আণবিক বোমা নিষিদ্ধকরণের দাবিতে শান্তির আবেদনপত্রে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য এসেছিলেন পাবলো নেরুদা ভারতে। তখন বিশ্বজোড়া খ্যাতি তার। কিন্তু নেহেরু সে আবেদনে সই করেননি। এ নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আণবিক বোমার ব্যবহার বিশ্ববাসীকে নাড়া দিয়েছিল।

এ বোমা নিষিদ্ধের দাবিতে বিশ্বের শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিকরা সোচ্চার হয়ে ওঠেছিলেন। বিশ্ব শান্তির অন্বেষায় সংগ্রহ করা হয় গণস্বাক্ষর। চট্টগ্রাম থেকে ৭ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন মাহবুব উল আলমের নেতৃত্বে গঠিত শান্তি পরিষদ নামক সংগঠন। বিশ্বশান্তির পক্ষে তখন চট্টগ্রামে গঠন করা হয় বিশ্বশান্তি পরিষদ। এ পরিষদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় নেরুদার সঙ্গে সাক্ষাতে বেগ পেতে হয়নি তাকে।

নিখিল ভারত বিশ্বশান্তি পরিষদের তখন অন্যতম নেতা চট্টগ্রামের চিত্ত বিশ্বাস ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাকে নিয়ে নেরুদার সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম থেকে দিল্লি যান। এ প্রসঙ্গে মাহবুব উল আলম বলেছেন, “এই জীবন্ত প্রবাদপ্রতিম কবিকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি তার একটি কাব্যগ্রন্থ ‘রেসিডেন্ট অন আর্থ’ উপহার দিয়েছিলেন। সেই সৌভাগ্যের কথা মনে পড়লে প্রভূত গৌরব অনুভব করি।

” নেরুদার গ্রন্থের বিপরীতে নিজের গ্রন্থ উপহার দিতে পারেননি। তবে ‘সীমান্ত’ পত্রিকার ‘শান্তি’বিষয়ক সংখ্যাটি দিতে পেরেছিলেন। মাহবুব উল আলমের নেতৃত্বে আণবিক বোমা নিষিদ্ধকরণের দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহে চট্টগ্রামে বিশ্বশান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে আবেদন প্রচার করা হয়। ‘বিশ্বশান্তির ডাকে স্বাক্ষর দিন’ শীর্ষক আবেদনে বলা হয়েছিল, “দুটি মহাযুদ্ধে আমরা তার বিধ্বংসী ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করেছি। অত্যন্ত উগ্র মারণাস্ত্রের প্রয়োগে হাজার হাজার জনপদ, শিল্পালয়, বিদ্যালয় প্রভৃতি মানব সভ্যতার অমূল্য সম্পদ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হতে দেখেছি।

দেখেছি কচি দুধের শিশুটিকেও বোমার আঘাতে রক্তাক্ত ঢলে পড়তে। যুদ্ধের বলি হতে দেখেছি শান্তিপ্রিয় মানুষ, ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার সুখী পরিবার। লাখ লাখ মানুষকে হত্যালীলায় মাতিয়ে তুলে মানবতাকে নির্মম পাশবিকতার জঘন্য স্তরে নামিয়ে নিতে বাধ্য করেছে এই বিশ্বযুদ্ধ। আবার দেখেছি যুদ্ধান্তের পরবর্তী অধ্যায়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম নগরের বুকে ঘনিয়ে আসতে করাল দুর্ভিক্ষ, রোগশোক, অনাহার ও সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট। অগণিত মানুষ তাই প্রশ্ন করে, বিশ্বযুদ্ধে কার লাভ? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংস ও ভয়াবহতা এখনো মিলিয়ে না যেতেই তৃতীয় মহাযুদ্ধের জন্য সমলিপ্সুরা মেতে উঠেছে।

অ্যাটম বোমার মতো সর্বাÍক ধ্বংসকারী মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ পাগল মানবতার শত্র“রা উল্লাস ধ্বনি তুলেছে। পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরাও সুতীক্ষ্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করছি বিশ্বযুদ্ধ কার জন্য, বিশ্বযুদ্ধে কার লাভ? সঙ্গে সঙ্গে আমরা এও ঘোষণা করছি- যারা অ্যাটম বোমার মতো ভয়াবহ মারণাস্ত্রের সাহায্যে সমস্ত সভ্যতাকে ধ্বংস করতে চায়; তাদের বিরুদ্ধে অগণিত শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের মিলিত শপথের সঙ্গে আমরাও হাত মিলাই এবং দাবি করি অ্যাটম বোমা সম্পূর্ণ বেআইনি ঘোষিত হোক। যারাই মানুষের ওপর প্রথম অ্যাটম অস্ত্র ব্যবহার করবে- তাদের আমরা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী, মানবতার শত্র“ ও শান্তির দুশমন বলে ঘোষণা করবো এবং তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রতিরোধে শামিল হবো আমরা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত সৎবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, বিশ্বশান্তির জন্য সজাগ হোন। বিশ্বশান্তি কমিটির আবেদনে অ্যাটম বোমা নিষিদ্ধকরণের দাবিতে স্বাক্ষর দিন। ” এই আবেদনে সংগ্রহ করা স্বাক্ষর স্টকহোম বিশ্ব শান্তি পরিষদে পাঠানো হয়।

যা এখনও সেখানে আর্কাইভসে সংরক্ষিত রয়েছে। কবি মাহবুব উল আলমের ‘দুঃসময় ১৯৭১’ কবিতায়ও পাবলো নেরুদার স্বর শোনা যায়। নেরুদা তখনও জীবিত। চিলিতে আয়েন্দে সরকার ক্ষমতায়; সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তৎপর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে এবং পরবর্তীতে লেখা মাহবুব উল আলমের কবিতায় যুদ্ধচিত্র উঠে এসেছে।

ঘাতকদের বিরুদ্ধে এখানেও তিনি সোচ্চার কণ্ঠ। “যারা আমার হƒদয়ের তলদেশ থেকে মুছে দিতে চায়/অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার অমর কাহিনী/ যারা আমার হৃদয়ের তলদেশ থেকে/উপড়ে ফেলতে চায়- অসংখ্য শহীদের স্মৃতির মিনার/সেইসব হত্যাকারীদের হাতে হাত মিলিয়ে/আমি বিস্মৃত হতে চাই না সেইসব দিনের কথা/যেসব কথা আর ঘটনা আমার চিরকালের প্রেরণার উৎস/আমার ভবিষ্যৎ বংশধরদের আÍমর্যাদার স্মারক। ’/ (দুঃসময় : ৭১) নেরুদার চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘাতকদের শাস্তি দাবির কথাও মনে পড়িয়ে দেবেই এই কবিতা। পাবলো নেরুদার প্রতি তার আগ্রহ জš§ানোর পেছনে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন। তার কাছ থেকেই নেরুদা সম্পর্কে জানা এবং কাব্যপাঠ।

১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামে আয়োজিত প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলনে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, গোপাল হালদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ভবানী সেন প্রমুখ বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্ব কবি মাহবুব উল আলমের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। একই বছর কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত ফ্যাসিবাদবিরোধী শিল্পী লেখক সম্মেলনের তৃতীয় বার্ষিকীতে চট্টগ্রাম প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন তিনি। সেখানে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে পরিচয় হয় খাজা আহমদ আব্বাস, কৃষণ চন্দর, মুলক রাজ আনন্দসহ আরও খ্যাতনামা সাহিত্যিকের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, বাংলার পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে লেখা কৃষণ চন্দের ‘অন্নদাতা’ পড়ে মুগ্ধ কবি তার সঙ্গে দেখা করতে বোম্বাইও যান। চট্টগ্রামের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী চিত্তপ্রসাদ তখন বোম্বাইবাসী।

তাকে নিয়ে মুলক রাজ আনন্দের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। পরবর্তীতে তাদের লেখা অনুবাদ করে সীমান্ত পত্রিকায় ছেপেছেন। এমনকি তাদের কপিও পাঠিয়েছেন। তারা ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠিও দিয়েছেন তাকে। কবি মাহবুব উল আলমের কাব্য মানস জগতে পাবলো নেরুদার মতো সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্যও জুড়ে আছেন।

তার কবিতা বা ছড়ায় সে সুরটি স্পষ্টও হয়। তার ছড়াতে, ক্ষোভের চিত্র বেশি প্রকটিত : “হাতে পায়ে শিকল দিলি/কেমন কর উড়বো। / বুকে জ্বালা মুখে তালা/কেমনে মুখ খুলবো। ”/ কিংবা “ভাই মেরেছিস-বোন মেরেছিস/কেমন করে হাসবো। / এবার যদি হাসতে বলিস/বজ হয়ে আসবো।

”/ আবার ১৯৭১ সালে লেখা অঙ্গীকার কবিতায় দেখি : “মৃত্যুর ভয়ে ভীরু ক্রন্দন আর না প্রাণ দিয়ে জীবনের দাম নে যারা কাপুরুষ পেছনেই তারা থাক না আমরা দাঁড়াবো বুলেটের ঠিক সামনে। ” ------------------------------------------------- দৈনিক যুগান্তর । ২১ নভেম্বর ২০০৮

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।