আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রঙ্গীন কাগজের হাতে বন্দি

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

ছুটির দিনে ঘুমের আমেজ তখনও লেগে আছে শরীরে, শহরে হালকা শীত পড়েছে, এমন সব দিনে ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়তেও আলস্য লাগে। তবে কেউ দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালে দরজা খুলতেই হয় বিছানা ছেড়ে। কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখলাম একজন দাঁড়িয়ে আছে, আমি চিনি না, খালাম্মাকে ডাকেন। আমি আম্মাকে ডাকলাম। আম্মাও চিনতে পারছে না তাকে।

অবশেষে সে তার পরিচয় দিলো। আমিও তাকে চিনতে পারলাম। গত বছর এমনই কোনো সময়ে রিকশা করে বাসায় ফিরছি দুপুরে, রিকশা ভাড়া দেওয়ার পরও দেখি রিকশাওয়ালা তাকিয়ে আছে। এমনিতেই রিকশা চড়লে তার পোশাক এবং চেহারার দিকে তাকানোর অবসর হয় না। মোটামুটি নিজস্ব ভাবনায় মগ্ন থাকি সবটা সময়।

বাসার গলিতে আসলেই শুধু সচেতন হয়ে, ভাই ডাইনে, ভাই বামে, ভাই সোজা সামনে গিয়ে রাখেন। এই সাধারণ কথাটুকুর বাইরে তেমন কথাও হয় না। রিকশাওয়ালা পেছন থেকে ডাকলো, ভাই একটা কথা ছিলো। আমি ফেরত এসে তাকে দেখলাম, বয়েস খুব বেশী হলে ২২-২৩। থুতনিতে সামান্য দাড়ি, হুমম, বলো।

আমার শার্ট ছিড়ে গেছে, দেখেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আসলেই তার শার্টের অবস্থা বিশেষ ভালো না। যদি সচেতন হয়ে তার পিঠের দিকে তাকাতাম তবে পিঠটা দেখতে পেতাম। আপনি যদি একটা শার্ট দেন- আমি শার্ট তেমন পরি না। শার্ট কেনাও হয় কম, তবে পুরোনো শার্টের কমতি নেই, চোখের নেশায় কেনা হয়েছে, তবে পড়া হয় নি তেমন এমন শার্ট বাসায় খুঁজলেই পাওয়া যাবে।

বাসায় এসে তাকে একটা শার্ট দেওয়ার পরে আনন্দিত হয়েই সে চলে গেলো। আজ কেনো এসেছে সেটাও জানা নেই। নিজের পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই মনে হয় তার। সে একজন মানুষ যাকে আম্মা কোনো এক আসন্ন শীতের আগে আগে একটা শার্ট দিয়েছিলো। এইটুকু পরিচয় নিয়েই মানুষটা সামনে দাঁড়ানো।

তার ছোটো বোনের বিয়ে। নীচে রিকশা রেখে এসেছে সে। আমার সামর্থ্য কম। অন্তত তেমন উদার রাজার মতো কারো প্রয়োজনের কথা শুনে নিজের রাজকোষ খুলে দিয়ে বলবো ঠিক আছে তোমার যতটুকু প্রয়োজন নিয়ে যাও, এতটা সামর্থ্য আমার নেই। আমার সীমিত সামর্থ্যে যতটুকু মনে হলো ততটুকুই দিলাম।

দরজা বন্ধ করার আগে ছেলেরও মনে হলো সে কিছু দিবে। সুতরাং সেও কিছু দিলো। খালাম্ম এখনও দিলো না- লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো। বোধ হয় আম্মা কিছু দিবে না এখন। তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে মনে হলো তার প্রত্যাশা মনে হয় পুরণ হলো না।

যে যতটুকুর আশা নিয়ে এসেছিলো সেই প্রত্যাশা পুরণ হলো না, এই লজ্জা নিয়ে বাইরে ছুটে তাকে দিয়ে আসা যেতো আরও কিছু টাকা। যদিও তার প্রয়োজন জানা নেই, তবে অন্য আরেকজনের জন্য কিছু টাকা তুলে রাখা ছিলো, সেখান থেকেও তাকে দিয়ে দিতে পারতাম। মনটা এরপর থেকেই খারাপ, তার প্রয়োজনের সবটুকু হয়তো পুরণ করতে পারতাম না আমি। আমার সীমিত সামর্থ্যে আরও বেশী দেওয়ার ক্ষমতা ছিলো। হয়তো অন্য কোনো মানুষ হলে তখনই ছুটে গিয়ে দিয়ে আসতে পারতো।

আমার দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পরের এই বিষন্নতাই সম্বল। মানুষের জীবন এর চেয়েও অনেক তুচ্ছ তুচ্ছ কারণেই বিপদাপন্ন হয়ে যায়। মানুষ সামান্য ২ টাকা ৫ টাকার জন্যও খুন হয় এখানে। এখানে স্বপ্ন নির্মাণ ও স্বপ্ন ভঙ্গের ব্যবধাণ নির্মান করে কয়েকটি রঙ্গীন কাগজ। আমাদের যাবতীয় মানবীয় লেনদেন রঙ্গীন কাগজের হাতে বন্দি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।