ধুম ধাম ধুম।
১.
আমার নাম রবি।
আমার জন্ম ২০২১ সালের বর্ষায়, সাগর থেকে অল্প ইকটু দূরে একটা ছোট্ট মফস্বল শহরে। আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে, যখন ভাবি যে তখন শ্রাবণের বৃষ্টি হচ্ছিল সারা রাত ধরে.. যখন অনেকগুলো বৃষ্টির ফোঁটা টুপটুপ করে মাটিতে এসে পড়ছিল, তখন আমিও পৃথিবীতে টুপ করে এসে ঢুকে পড়েছিলাম..
কিন্তু হয়তো আমার পৃথিবীতে আসাটুকু সেরকম সুন্দর কিছু ছিল না । কিন্তু আমার এভাবেই ভাবতে ভালো লাগে।
একটু দূরের সবুজ মেঠো পথ দিয়ে ঘুরে একা একা অনেকদূর হেঁটে একই জায়গায় ফেরার মতো।
আমার নাম রবি, এবং আমার একটা গল্প আছে বলার মতো।
আমি সেজন্য চুপচাপ বসে আছি কি-বোর্ডে হাত রেখে। কারণ আমি জানি না গল্পটা কেমন শোনাবে, এবং আমি একটুও নিশ্চিত নই, আমার শব্দগুলোকে আমার কথাগুলোকে উচ্চারণ করবে কিনা। কিন্তু আমি আমার মতো করে তোমাকে গল্পটা বলব, কারণ আমার এভাবেই গল্প বলতে ভাললাগে।
তুমি জানতে হয়তো জানতে চাইবে, আমি কে? আমি হাসবো, মাথাটা দোলাবো মাটির দিকে তাকিয়ে। কারণ আমি নিজেকে কত শত শতবার জিজ্ঞেস করেছি প্রশ্নটা এবং কখনো কোন জবাব পাইনি। তারপর একটা দিন যখন সব প্রশ্নের উত্তরগুলো আমার উপর আষাঢ় এর বৃষ্টির মতো অবিরতভাবে ঝরতে শুরু করলো, তখন আমি জানলাম, আমি শুধুই ক্রুক্রুশের পৃথিবীর একটা চরিত্র। যাকে ক্রুক্রুশ খুব যত্ন করে বানিয়েছে।
কিন্তু আমি কখনোই জিনিসটা জানতাম না।
আমি বড় হয়েছিলাম খুব একা একটা মানুষ হয়ে। একা একা ঘুরে বেড়ানোর পৃথিবীতে। একা একা বসে থাকার ধানক্ষেতের পাশে, একা একা সাইকেলের পিঠে ছুটে বেড়ানো একগুচ্ছ শব্দ হয়ে। একা একা সন্ধ্যার আঁধার নামানোর জন্য আমি একা একা বসে থাকতাম দিগন্তর পাশে। তারপর সেখানটায় লাল সূর্যটা ডুব মারতো আর রূপালি চাঁদটা উঁকি মারতো, ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো গান ধরতো, আর শুধু আমি বসে বসে শুনতাম।
মাঝে মাঝে একা একা বই এর পাতাগুলো উল্টাতাম, আর বসে বসে আমার নিজের একটা পৃথিবী বানাতাম, যেখানটায় ছিল আমার সৃষ্টি করার স্বাধীনতা। তারপর এভাবে যখন আমি বড় হতে থাকলাম, আমার মনে হলো আমি ভীষণ একা, এবং আমার মনে হলো আমার কথাগুলো বলার জন্য পৃথিবীতে কোন মানুষ নেই, আমার কথাগুলো শোনানোর জন্য কোন শব্দ নেই পৃথিবীতে, এবং আমার পড়া রূপকথাগুলো আমাকে প্রতারিত করলো কাউকে ভালোবাসতে বলে .. কি হাস্যকর, তখন আমি আবিষ্কার করলাম, আমাকে ভালোবাসার জন্যও কোন মানুষ নেই। এবং অনেক অনেক সময় পার হবার পর, অনেক অনেক দূরে ভেসে যাবার পর আমি একদিন আবিষ্কার করলাম, আমি আসলে কোন মানুষের সীমাবদ্ধ ভালোবাসা খুঁজছি না ... কিন্তু আমি জানতাম না আমি আসলে কি খুঁজছি। সেটা ছিল আমার টিনএইজের শেষ সময়, যখন সবার জগত ভরে যায় অনেক অনেক প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে। যখন আকাশটা তার নীল রং হারায়, আর মেঘগুলো হারায় তাদের শুভ্রতা।
তারপর রোদগুলো গালে এসে পড়ে, একরাশ উত্তাপ দিয়ে যাবার জন্য। সেখানে কোন মিষ্টি সুর অবশিষ্ট থাকে না।
তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?
আমার এভাবেই কথা বলতে ভালো লাগে। নিজেকে হারিয়ে যাওয়া গল্পের হারিয়ে যাওয়া একটা বুড়ো মানুষ মনে হয়। আসলে আমরা সবাই কোন না কোন দিন তাই হয়ে যাবো, মহাকালের বিশাল সময়ের তুলনায় আমাদের সময়কাল কিছুই না.. হাজার বছর পর, তুমি কি বেঁচে থাকলে নিজেকে বুড়ো বলবে না?
আমি ঠিক তখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।
আমার ছোটবেলায় খুব শখ ছিল পাইলট হবো, আমার একটা প্লেন থাকবে আর আমি আকাশের সব মেঘগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে বেড়াবো, সব পাখিগুলোর সাথে ভেসে বেড়াবো, আর বন্ধু বানাবো আকাশটার উপরের মিষ্টি সব অনুভূতিগুলোকে। অনেক উপর থেকে সাগর দেখবো, সাদা স্রোত। কিন্তু সেসবের কিছুই হলো না। সেন্ট্রাল সিস্টেম আমার মেধা যাচাই করে আমাকে বিশুদ্ধ গণিতে ঢুকিয়ে দিলো .. যেটা ছিল আমার জন্য বিশ্রী একটা ব্যাপার । আমি বিশুদ্ধ গণিতে কোন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলাম না, অন্তত সেরকম কিছু না, যেরকম আমি চাচ্ছিলাম।
বিশুদ্ধ গণিতে কোন অ্যাডভেন্চার নেই, আকাশে ভেসে বেড়ানো নেই, একা একা বসে থাকার মতো ঝিঁঝিঁ পোকা নেই, পাহাড়ী ঝরনা নেই। আমি মোটা মোটা বইগুলো নিয়ে বসে থাকতাম, যেগুলোতে দস্তয়ভস্কি ছিলো না, যেগুলোতে রিতান্টার কবিতা ছিল না, যেখানটায় ভ্যান গখের ছবিও ছিল না। অনেক অনেক সমীকরণ ছিল, যেগুলোর কোন অর্থ আমার কাছে ছিল না। কিন্তু তারপর, হঠাৎ একটা সময় আমি অনুভব করলাম আমি জিনিসগুলো বুঝতে পারছি। আমি হঠাৎ করে এও বুঝতে পারলাম, আমার চিন্তা ভাবনা পাল্টে যাচ্ছে, এবং সেখানটায় একটা নতুন ডাইমেনশন তৈরী হচ্ছে।
আমি ম্যাটরিক্স সিস্টেমটা মুগ্ধ হয়ে শিখলাম, আমার মনে হলো আমি একটা নতুন জগতে ঢুকে যাচ্ছি যেখানটায় কোন সীমাবদ্ধতা নেই প্রকাশের, সেখানটায় কেউ থেমে যাচ্ছে না বাস্তব সংখ্যারা কাল্পনিক সংখ্যার সাবসেট এটুকু বলে, সেখানটায় গিয়ে হঠাৎ দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে, কারণ সব ধরণের সংখ্যারা একটা ম্যাট্রিক্স এর সাবসেট, একটা ম্যাট্রিক্স আরো বড় ধাঁচের জিনিস। যখন জিনিসগুলো হঠাৎ এভাবে পাল্টে যেতে শুরু করলো, তখন আমি আসলেই গণিতকে ভালোবাসতে শুরু করলাম, কারণ আমি বুঝতে পারলাম, কিছু সৌন্দর্য এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে, যেগুলো তুমি কখনো একজন কবির চোখ দিয়ে দেখতে পাবে না, এমন কি দেখতে পাবে না, কোন অ্যাডভেন্চারারের চোখ দিয়েও, যে পৃথিবীর সব অরণ্য, সব পথ চষে ফেলেছে সৌন্দর্য খুঁজতে গিয়ে, কিংবা কোন ড্রাগ এডিক্টের চোখ দিয়েও যে ক্রমাগত দাবি করছে, সে তোমার চেয়ে বেশি সংখ্যক রং দেখেছে। আমি এই অদ্ভূত অনুভূতিটুকু নিয়ে আমার জীবণটা যেন আবার শুরু করলাম। ঘুম ভেঙে হঠাৎ একটা সুন্দর ভোর দেখার মতো করে। যখন সূর্য তার সব রশ্নিগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সব অন্ধকারকে ধুলো ঝেড়ে দেবার জন্য।
আমার মনে হচ্ছিল, কেউ যদি কখনো অপূর্ব সুন্দর কিছু কখনো তৈরী করার চিন্তা করে, এবং সেটাকে যদি সে ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে চায়, তাহলে হয়তো সেটা হবে গণিতের মত একটা ভাষা, এবং আমি সেটা বুঝতে পারবো। সেটা ছিল প্রথম বর্ষের শেষে, এবং আমি যতই গণিতে ডুবে যাচ্ছিলাম, আমার ততই মনে হচ্ছিল আমি একজন উইজার্ড, কারণ গণিত আমাকে সেরকম ক্ষমতা দিচ্ছিল - যা ইচ্ছা তা করার। সে বছর আমাদের ক্যালকুলাস ছিল, আমি শিখলাম, কিভাবে আমি যেকোন কার্ভের ক্ষেত্র বের করে ফেলতে পারি। কিভাবে আমি অনেক বড় একটা জিনিসকে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভেঙে আবার একসাথে জোড়া লাগিয়ে দিতে পারি যাতে কোন ক্ষুদ্রতাই হারিয়ে না যায়। এই সবকিছু অনেক অদ্ভূত একটা অনুভূতি নিয়ে আসলো আমার মধ্যে, আমার মনে হতো এরা হচ্ছে আমার ক্ষমতা, এরা হচ্ছে আমার মন্ত্র, আমার স্পেল।
তারপর তিন বছর আমি পুরোপুরি ডুবে থাকলাম, আমার নতুন পৃথিবী নিয়ে।
তারপর একটা সময় ছন্দপতন হলো ... আমার নিজের জীবণটাকে খুব অর্থহীন মনে হওয়া শুরু করলো। আমার হঠাৎ করে মনে হলো, আমার আসলে বেঁচে থাকার কোন কারণ নেই। এবং আমি জানি না, আমি কাদের জন্য বেঁচে আছি, কিংবা কেউ অদৌ মাথা ঘামায় কিনা আমি বেঁচে আছি কিনা সেটা ভেবে। আমি কিছুদিন আমার সব ভাবনা চষে বেড়ালাম, নিজের প্রশ্নের খোঁজে।
কিন্তু কোন লাভ হল না। এবং তারপর আমার মধ্যে আমার পুরনো একাকীত্ব ফিরে আসলো, আরো গাঢ় হয়ে। আমি অনেক চেষ্টা করেও কিছু এড়াতে পারলাম না, আমার মাথার মধ্যে কেবলি ঘুরতে থাকলো আমি কত একা আর আমার অনুভূতিগুলো কতো মূল্যহীণ। পৃথিবীর কারো কিছু যায় আসে না আমার মন খারাপ থাকুক বা না থাকুক। এবং আমি কাউকে বোঝাতেও পারবো না, আমার কেমন লাগছে।
আমি এলোমেলো ঘুরে বেড়াতাম কনসার্টগুলোতে, সবাই যখন নাচতো, আমি তখন কোণায় খুব বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম, আমি জানতাম আমাকে সেখানে মানাচ্ছে না একদমই, কিন্তু আমি বের হয়েও যেতে পারতাম না, গানগুলো শক্ত করে আমাকে টেনে রাখতো, তাই আমি গানগুলো শুনতাম এবং আমার মনে হতো, আমি খুব নিঁখুতভাবে অনুভব করতে পারছি, আমি দৃশ্যকল্পগুলো স্পষ্ট দেখছি যেগুলোর কথা লোকটা শব্দ দিয়ে গাচ্ছে, এবং আমার চোখে পানি চলে আসতো, আমি চোখ পিটপিট করে পানিগুলো সরিয়ে দিতাম। তারপর হঠাৎ মনে হতো, কেন খামোখা পানি সরাচ্ছি, আমি কাঁদছি এটা দেখলে কার কি? কিন্তু তারপর খুব খুব বাজে লাগতো, যখন আমার মনে হতো আমি এই ভালোবাসার গানটা অনুভব করছি, খুব খুব তীব্রভাবে.. এবং তখন আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করতো চিৎকার করে, আমার খুব জোরে চিৎকার করে স্রষ্টাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করতো, যদি আমার সবকিছুই এভাবেই চলতে থাকবে, তাহলে আমাকে এত এত প্রচন্ড অনুভূতি দেয়ার অর্থ কি?
আমার এলোমেলো সময় থেকে আমি বের হতে পারলাম না, হঠাৎ একটা সময় আমি খুব অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমি ক্লাসের পড়াশুনার অনেক বাইরে .. আমার নিজেকে অনেক হারিয়ে যাওয়া একটা মানুষ মনে হলো, কারণ আমার ভার্সিটির শেষ পরীক্ষাটা আর এক সপ্তাহ দূরে, আর আমার কোন ধারণাই নেই এবছর কোর্সে কি ছিল।
আমার যা কিছু হারানোর বাকি ছিল, সবটুকু যেন একবারে হারিয়ে ফেললাম। আমি একগাদা হেরোইন একসাথে পুশ করলাম আমার রক্তে, শুধু ওভারড্রাগড হয়ে মরে যাবার জন্য। শান্তিপূর্ণ মৃত্যু।
সেটা আমার কাছে অপটিমাল মনে হচ্ছিল কারণ আমি আর কোন ভালো সহজ পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
কিন্তু.. আমি মরিনি। হাসপাতাল খুব দূরে ছিল না আমার ভার্সিটি থেকে। আর হাসপাতালে নেবার মত উৎসাহী মানুষেরও অভাব ছিল না ভার্সিটিতে। এই জিনিসটা আমার মাথায় কাজ করেনি শেষ মুহূর্তে।
তো, আমি বেঁচে গেলাম।
কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল না আমি বেঁচে আছি। আমার একটা বন্ধু ছিল, যে নিজেকে বলতো জলদস্যু নেসার।
আমার ওর কথা খুব মনে হচ্ছিল, কারণ সে প্রায় এরকম কথা বলতো, "আমি বেঁচে ছিলাম কবে ?"
আমার আর পরীক্ষা দেয়া লাগলো না।
আমি কিছুদিন আবার আগের মতো ঘুরে বেড়ালাম একা একা।
আমার চুল অনেক বড় হয়ে গেছে এর মাঝে, আর দাড়িগুলোও জঙ্গল হচ্ছে। তো আমাকে দেখতে নিশ্চই খুব অদ্ভূত লাগতো, কারণ পথে ঘাটে মানুষ আমাকে দেখে হচকিয়ে যেতো, তারপর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকতো। আমি তাকালে সবাই আবার নিজের কাজ করা শুরু করতো। ব্যাপারটা অদ্ভূত কোন সন্দেহ নেই, আমি সেজন্য বসে থাকতাম আমার একা একা পার্কে। লেকের ধারে, যেখানে সব ছায়াগুলো টলটল করতো পানিতে।
রোদ উঠতো, রোদ নামতো, আমি বসে থাকতাম। তারপর মাঝে মাঝে ঝিম ধরে বৃষ্টি নামতো, তখন সবকিছু মানবশূণ্য হয়ে পড়তো, তখনও আমি বসে থাকতাম। বৃষ্টিতে ভিজতে আমার খুব বেশি আপত্তি নেই, আমি বৃষ্টি ভালোবাসি। যখন অনেকক্ষণ টানা বৃষ্টি হয়, তখন আমার কেন জানি মনে হত আকাশের টাংকি কখন খালি হবে? এই চিন্তাটা খুবই হাস্যকর ছিল, তাই আমি একা একা হাসতাম। আমার মনে হয় এটা স্রেফ পাগলামি, স্রেফ অসুস্থতা, প্রতিবার এভাবে বৃষ্টি হতো, আর প্রতিবার আমার মনে হতো আকাশ খালি হচ্ছে না কেন।
আমি ভাবনার ভিতর তলিয়ে যেতে থাকলাম, আমার কখনো খুব বেশি ব্ন্ধু ছিল না, সেই দিনগুলোতে তো নয়, কিন্তু আমার মনে হত, যদি আমার খুব ভালো বন্ধুও থাকতো, কেউ হয়তো আমার কথাগুলো বুঝতে পারতো না। আমার মনে হচ্ছিল আমি কিছু একটা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি কি বুঝতে পারছি ।
আমার অনুভূতিগুলো প্রচন্ড তীক্ষ্ণ হতে থাকলো, আমার মনে হলো আমার ভেতরে কবিতারা ফিরে এসেছে, যেগুলো হারিয়ে গিয়েছিল হাইস্কুলে থাকার কোন এক সময়, চুপিচুপি আমাকে না বলে। আমার তখন মনে হতো, আমি কবিতা দেখতে পাই, আমি কবিতার গন্ধ শুঁকতে পাই.. আমি শূণ্য আকাশের দিকে চেয়ে থাকতাম, যে তার শূণ্যতা দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, তারপর অনন্ততা নিয়ে বারি ঝরায়.. আমি পানির হাল্কা মৃদু ঢেউর দিকে চেয়ে থাকতাম, ছোট্ট স্রোত, যে অনেক ক্ষুদ্র, কিন্তু পাড়ে গিয়ে বাড়ি খাবার আগে, সে একবারো মনে করতে চায় না সে কখনো হারিয়ে যাবে। সবকিছুর মধ্যে আমি কবিতা দেখতে পারতাম তখন।
আমার মনে হতো পৃথিবীটা কারো অনেক বড় একটা কবিতা, নিঁখুত ছন্দে বানানো। সেজন্য সব ছোট ছোট জিনিসকে আমরা কথায় বর্ণনা করতে পারি খুব সহজে, যখন আমরা আসলেই চাই সৎ হয়ে, এবং তখন সেসব চিন্তা আমাদের মাথায় ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে আসে.. যেই ভালোলাগাগুলো আসে বৃহত্তর কবিতাটা থেকে.. কিন্তু সেটার যেখানে থাকার সেখানেই পড়ে থাকে, কবিরা রসদ খুঁজতে আসার আগে এবং পরে।
এভাবে বর্ষাটা কেটে গেল। শরৎ আসলো, আর আমার চুলে জট বাধা শুরু করলো।
আমাকে দেখলে খুব গরিব মনে হতো, কিন্তু আমার পকেটে একটা এটিএম কার্ড ছিল।
এটা ভাবতেই আমার খুব হাসি পেত, আর আমি ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতাম, আর পার্কে প্রেম করতে আসা সুন্দরীরা ভয়ে দূরে সরে যেত। সেটা দেখে আমার আরো হাসি পেত আর আমি আরো জোরে হাসতে থাকতাম। এবং সেই শরৎ এ আমি বুঝতে পারলাম, আমি অনেক পাল্টে গেছি। আমি আর সবার মতো নেই, আর আমি কখনো স্বাভাবিক পৃথিবীতে স্বাভাবিক হয়ে ফিরে যেতে পারবো না। তবে তুমি কাকে স্বাভাবিক জীবণ বলবে? যে জীবণে তুমি নি:সঙ্গ? যে জীবণে তুমি নিজেকে পুরোপুরিভাবে প্রকাশ করতে পারো না, নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে রাখো নিজের মধ্যে? নিজের পাগলামিগুলো নিজের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে চাও? পৃথিবীকে মন খুলে দেবার মতো যথেষ্ট ভালোবাসা অবশিষ্ট থাকে না? আমার আর সেসবকে স্বাভাবিক মনে হতো না।
এবং সেই শরৎ এ আমার চিন্তাভাবনাগুলো মসৃণ হতে শুরু করলো।
আমি পুরোপুরি বুঝতে পারলাম অনেককিছু যেই চিন্তুাগুলো আমার মাথায় কুয়াশার মতো জমে ছিল অনেক দিন ধরে।
ধরো, আমার জীবণটা - আমি অনেক অনেক খুঁটিনাটি খেয়াল করে দেখলাম, সেখানে খুব ছোট্ট একটা জিনিস যদি ইকটু পাল্টাতো আমি খুব অন্যরকম একটা মানুষ হতাম । এবং আমি তখন পৃথিবীর দিকে তাকালাম, এবং আমার পৃথিবীর জন্য একই কথা মনে হল। আমি কখনোই খুব ভীষণ রকম বিশ্বাসী ছিলাম না ধর্মে।
সেজন্য, আমার কাছে এই চিন্তাটা অদ্ভূত লাগলো, খুব অদ্ভূত । আমার প্রথম দিকে পড়া জিনিসগুলোর কথা মনে হতো, শামুকের খোল, ফুল, পাতা, মানুষের গড়ন, ফিবোনাকি নাম্বার, গোল্ডেন রেশিও.. পাই.. আমার মনে পড়তে থাকলো সবকিছু, যেগুলো দেখে আমি খুব অবাক হতাম, জিনিসগুলো এত নিঁখুতভাবে গণিত মেনে চলে কেন। এবং কবিতারা আবার ফিরে আসলো, এবং সবকিছু আমার মাথায় জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলল। আমি প্রচন্ড ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম সব অনুভূতির বস্তা নিয়ে, আমার তীব্রভাবে মনে হচ্ছিল এই সবকিছু সাজানো, এই তুমি এই আমি, এই পার্ক, এই বৃষ্টির পানি, এই সময়টা। এবং কেউ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং সেখানে আমার কিছুই করার নেই।
বিশৃঙ্খলার গণিত আমার খুব প্রিয় ছিল। প্রিয় হবার একটা কারণ ছিল ফ্র্যাকটাল দিয়ে অসাধারণ মিউজিক কম্পোজ করা যেত, আর অসম্ভব সুন্দর ছবি আঁকা যেত। কিন্তু বিশৃঙ্খলার গণিতের আরো কিছু অংশ ছিল। সেটা বলতো সব ঘটনা সব ঘটনার সাথে সম্পর্কিত - প্রাচীন উক্তি, আমাজনে একটা পাখি ডানা ঝাপটাবে তার কারণে নিউইয়র্কে বৃষ্টি হবে। বিশৃঙ্খলার গণিত এর অনেককিছু আমার মাথায় একসাথে ঘুরতে থাকলো।
আমি যদি গ্রাফ থিওরি দিয়ে একটা বিশাল গ্রাফ মডেল তৈরী করতে পারি, যেখানে দুটো নোডের মধ্যে তখনই ডিরেক্টেড এজ থাকবে যদি একটা আরেকটাকে প্রভাবিত করে, এবং এজটা হবে দুটো নোডের দুটো প্রপার্টির উপর, তাহলে আমি যদি একটা শক্তিশালী কম্পিউটিং মেশিন দিয়ে সবগুলো রিলেশনগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, আমি একটা নিঁখুত জগত বানাতে পারবো, যেটা সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, আমি সব ইভেন্ট আমার মতো করে চালাতে পারবো, এবং ইভেন্টের সাথে জড়ানো অবজেক্টরা কখনোই জানবে না, কোন ছোট ছোট ঘটনাগুলো দিয়ে আমি তাদের জীবণ পাল্টে দিয়েছি, এবং সেজন্য কখনোই তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ হিসেব করতে পারবে না।
আমি যখন নিখুঁত ভাবে সব চিন্তা গুছিয়ে ফেলেছি, তখন আমার অন্যমনষ্ক সত্তা বের হয়ে আসলো, আমি প্রচন্ড জোরে হর্ণের শব্দ শুনলাম, এবং তাকিয়ে দেখলাম আমি একটা ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেই ড্রাইভারটা আমাকে একদমই খেয়াল করেনি, এবং যদিও সে ব্রেকে চাপ দিচ্ছে, গাড়িটা আমার গায়ে এসে লাগবে প্রচন্ড জোরে। আমি একজন গণিতবিদ, আমি মেকানিক্স খু্বই ভালো জানি, এবং হয়তো সেজন্যই ঠিক তার কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের মাথায় ট্রাকটা প্রচন্ড জোরে আমাকে আঘাত করলো।
তবে, এবার আমার আশেপাশে কোন হাসপাতাল ছিল না, হাসপাতালে নেবার মতো লোকও ছিল না। যদিও দোষটা পুরো আমারই ছিল তারপরও ট্রাকড্রাইভার ভাবলো সে আমাকে মেরে ফেলেছে, যদিও আমি তখনও মরিনি, এবং সে ভয় পেয়ে আমার উপর দিয়ে গাড়িটা নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল।
আমার স্নায়ুগুলো দূর্বল হয়ে যেতে থাকলো, আমি ভেবেছিলাম সব আঁধার হয়ে যাবে, তা না হয়ে সব ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমার একদম মরতে ইচ্ছে করছিল না, আমার খুব ইচ্ছে করছিল আমার চিন্তাগুলো সমাপ্ত করতে। আমার তখনো মনে হচ্ছিল আমাকে একটু সময় দিলে আমি একটা ম্যাথমেটিকাল মডেল বানিয়ে দিতে পারবো, এবং হয়তো আমি কিছু উচ্চ শ্রেণীর অ্যাবস্ট্রাক্ট গণিত দিয়ে জিনিসগুলোকে প্রমাণও করতে পারবো। আমি হয়তো মানুষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে একটা সত্য দেখাতে পারবো, যেটা আপাতত আমি ছাড়া আর কেউ দেখছে না।
এবং আমি ভাবিনি আমি মরে যাচ্ছি।
আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা সাদা জগতে হারিয়ে যাচ্ছি, আমার সবকিছু সাদা হয়ে সেখানটায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু, আমি মারা গেলাম।
যখন আমি মরতে চাইনি তখন।
ক্রুকুশ আমাকে আনপ্লাগড করলো।
পরের অংশ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।