আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প - দূরের মাঠ



(আমি গল্প লিখতে পারি কিনা সন্দেহ আছে। একটি লিখলাম। অনুগ্রহপূর্বক মন্তব্য করুন ) বহুক্ষন ধরে সুযোগ খুঁজছে সে। মায়ের চোখ ফাঁকি দেয়া আসলেই কঠিন । আগে আরো কয়েকবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রতিবারই ধরা খেযেছে।

মায়ের চোখ যে কেন এত দেখতে পায তা বোঝেনা রানা। মাকে অনেকবার বলেছে -মা, একটু বাইরে যাই? -বাইরে যাই, বাইরে যাই.. কই যাবি ? জাহান্নামে যা। রাগ হয়ে বলে ওঠে মা। পেটে ভাত নাই উনি বাইরে যাইবো। বাইরে যাইয়া কি করবি? আয় কইরা আনবি? বয়স কত হইছে? - আট বৎসর হইছে মা।

একটু আহ্লাদী কন্ঠে জোর দিয়ে বলে সে - আরেকটু বড় হইয়া তোমারে আয় কইর্যাচ খাওয়ামু দেখবা। - চুপ। চেচিয়ে ওঠেন মা। আমারে আর আয় কইর্যায় খাওয়ান লাগবো না। বইস্যা থাক, রউদ উঠলে আমার লগে কামে যাবি।

মাথার উপরের ফাঁকটা পলিথিন দিয়ে আটকাতে আটকাতে বলে মা। গতকালের বৃষ্টির পানি ওখান দিয়ে ঢুকে এই ঝুপরি ঘরের মেঝে ভিজিয়ে দিয়েছিল। রাতে ঘুমাতে পারেনি ওরা। কামে যাওয়া মানে হচ্ছে মায়ের সাথে রাস্তার কাগজ কুড়াতে যাওয়া । রানা বোঝে মা যদি কামে না যায় তাহলে ওদের খাওয়া হবে না।

কিন্তু পাশের ঝুপড়ির ওর বয়সী ফারুক কি সুন্দর রাস্তায় খেলে । মাঝে মধ্যে ওকে ইশারায় ডাকে। তেমনি আজও ডেকেছিল কিছুক্ষন আগে। আর আকাশটাও পরিস্কার হচ্ছে ক্রমশ: । রোদ্দুর উঠবে মনে হচ্ছে ।

আজ খাওয়ার দরকার নাই- ভাবে রানা। মা পলিথিনটা দিয়ে বেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফাঁকাটা বন্ধ করার। ওর দিকে তাকানোর সময় নেই। এই সুযোগ- চুপ করে বেরিয়ে গেলো রানা। মা দেখতে পায়নি বোধহয়।

বাইরে এসেই আকাশের দিকে তাকালো । কত্ত বড় আকাশ । কালো ধুসর মেঘের ভেলাগুলো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে নীল আকাশটা উঁকি দিচ্ছে, যেন উকি দিয়ে রানাকেই দেখছে। আনন্দে ওর মনটা ভরে গেলো।

- রানা, রানা এদিক আয়, ফারুকের গলা শুনতে পেলো ও। উপরে দেখোস কি। চল ঐদিকে যাই। - ঐদিকে কই যাবা? মায় বকবো। - ঐদিকে একটা বড় মাঠ আছে, কি সুন্দর! - না, মায়ের লগে কামে যামু।

- ইতস্তত করছে রানা। - তোর মায়ে এত কাম করে ক্যা? আমার বাপে সব কাম করে । আর মায় রাইন্দা খাওয়ায়, জানস? একটু জোর দিয়ে কিছুটা গর্বের সাথে বলে ফারুক। - তোর বাপে কাম করে না? - আমার বাপ .. বাপ- বলতে গিয়ে একটু থামে রানা, বলবে কি বলবে না বুঝছে না- হে কাম করে না..না হে আমাগো কাছে আয় না- আমাগো লগে থাহে না.. । একটু মন খারাপ আস্তে আস্তে বলে ওঠে সে।

আর হের লাইগ্যাই তো আমার মায় কাম করে। মুখ নীচু করে কিছুক্ষন থামে রানা। তার পর হঠাৎই ঝট করে মাথাটা তুলে ধরে। সরাসরি ফারুকের চোখের দিকে তাকায়। তার পর জোর গলায় বলে ওঠে, - তয় আমি বড় হইয়া আমার মায়রে কাম কইর্যাম খাওয়ামু জানস? হেরে আমি অনেক কিছু কিইন্যা দিমু, হেরে আমি একটা অনেক বড় শাড়ি কিইন্যা দিমু।

একসাথে কথাগুলো বলে থামে রানা। ফারুকও সাথে সাথে বলে ওঠে- - আমিও বড় হইয়া কাম করমু । তোর চাইতেও বড় হমু। - আমি আরো বড় হমু , ঐ আকাশের মত বড়, আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলে রানা। সম্ভবত আকাশের চেয়ে কি বড় হতে পারে খুঁজে পায়না ফারুক, তাই সে আর জবাব দিতে পারে না।

তাই কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে ওঠে - চল ঐদিকে যাই। একটু ইতস্তত: করে রানা । মা কি বলবে ভাবে সে। তারপর আর কিছু না ভেবেই হাঁটতে শুরু করে। -কতদুরে যাইবা? জিজ্ঞাসা করে একবার।

এইতো ঐদিকে .. ফারুক বলে ওঠে। - চল চল , তাড়াতাড়ি চল। ওরা দুজনে তাড়াতাড়ি হাঁটতে চেষ্টা করে । বামদিকে একটা ছোট্র গলি ঢুকেছে। সেইদিকে গলিতে একটু ঢুকতেই চিৎকার করে উঠলো ফারুক, ঘুড্ডি , ঘুড্ডি, দেখ।

বলেই দৌঁড় দিল সে। সামনে লাইটপোস্টের নীচে একটা ঘুড়ি পরে আছে। তার সুতাটা উপরে তারের সাথে পেঁচানো। রানাও পিছে পিছে দৌঁড়ালো। ঘুড়িটা ধরে আনন্দে দু’জনেই চিৎকার করে উঠলো।

যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছে হাতে। তার থেকে টানিয়ে সুতাটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল ফারুক - চল উড়াই গিয়া , ঐ মাঠে। - আমার কাছে দাও, বলে রানা ঘুড়িটা ওর হাতে নিয়ে নিল। তারপর দ্রুত সামনের দিকে ছুটল। - এই খাড়া খাড়া, কই যাস।

তিনজন বড় বড় ছেলে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়েছে। ওরা থমকে গেলো। - এই তোরা কোন বস্তির রে? - ঐ..ঐদিকে...। হাত দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করলো রানা। - ও...।

ওদের মধ্যের হালকা মোছওয়ালা ছেলেটা ঝুঁকে এলো রানার দিকে। - ঘুড্ডিটা পাইলি কই? এদিকে দে। কঠিন গলায় বলল সে। - না.. আমরা উড়ামু... ঐ মাঠে। - চুপ।

আমরা উড়ামু.. ধমক দিল ছেলেটা। দুই আঙ্গুলের পোলা ঘুড্ডি উড়াইবো। দে কইলাম। জোর করে ঘুড্ডিটা নিয়ে নিল ওরা। তারপর হাসতে হাসতে চলে গেল সামনে।

মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা দু’জন। অনেক বড় একটা কিছু হাতছাড়া হল ওদের । কতদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ঔ ঘুড়ি উড়ানোর জন্য মন করেছে ওর। রানার মনে হল ঐ ছেলেগুলার মোছের মধ্যেই সব শক্তি। বড় হইলে আমারও মোছ হইবো।

তখন বুঝবা । ভাবতে ভাবতে চোখমুখ শক্ত করে ফেললো রানা। - রানা, চল আমরা মাঠে যাই । ঐখানে অনেক ঘুড্ডি আছে। রানার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল ফারুক।

ওরা বেজার মুখে হাঁটতে থাকে। গলিটা পার হয়েই আরেকটা রাস্তা। রাস্তার ওপারে একটু দূরে একটা বড় মাঠ দেখা যাচ্ছে। -ঐযে.. .. ঐযে মাঠ। আবার আনন্দ বেজে উঠছে রানার চিৎকারে।

আহারে কত ছেলেরা খেলছে ওখানে। কেউ ঘুড়ি উড়াচ্ছে। কেউ বল খেলছে। দু:খ ভুলে ওরা একত্রে সামনে পা বাড়ালো। - সোনার চান আমার এইখানে... আচমকা চিৎকারে হচকচিয়ে গেছে ওরা দু’জন।

ফিরে চাইলো ওরা । মা দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। - হারামজাদা , আমি খুইজ্যা শ্যাষ, আর উনি আইছে ঘোরতে। ঝট করে রানার হাতটা ধরে বললো মা। - চল , তোরে দেহামু মজা- জোরে জোরে বলছে মা।

- মা..মা..ঐ মাঠ.. ঐহানে একটু যামু মা, ঘুড্ডি উড়ামু। - হঠাৎ পাওয়া ভয় ছাপিয়ে মিনমিনিয়ে বলেই ফেলে রানা। - ও, ঘুড্ডি উড়াবা.. খাওয়া আছে প্যাটে হারামজাদা? চিৎকার করে ওঠে মা। আমি ওনার খাওয়ার চিন্তায় শ্যাষ, আর উনি লাট সাহেব ঘুড্ডি উড়াইবার যাইবো। কামে যাইবে কেডা? চল , আইজ তোরে না খাওয়ইয়া রাখমু.. চল...।

একরকম টানতে টানতেই রানাকে নিয়ে যায় মা। ফ্যালফ্যালিয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে ফারুক। রানা একবার পিছনে ফিরে ফারুককে দেখে দাঁড়িয়ে থাকতে। কোথা থেকে যেনো পানি এসে ভরে যায় রানার চোখ । টপ টপ করে পরতে থাকে নীচে।

দূরের মাঠটি এখনো দেখা যাচ্ছে। ঝাঁপসা , কিন্তু কি সবুজ... সুন্দর।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।