আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খেলাটা কি বিলুপ্ত হয়ে গেল!!!!!!!!

তোমার অস্তিত্বে সন্দিহান, তবু্ও সদাই তোমায় খুঁজি

আমার জন্ম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। পড়ালেখার হাতেখড়িও হয়েছিল সেখানে। খানিকটা জন্মস্থানের প্রতি দৃর্বলতা থেকেই হোক অথবা শৈশবের স্মৃতির কারণেই হোক অথবা খানিকটা নিরপেক্ষ দৃষ্টি থেকেই হোক, এ কথা বলার মত যথেষ্ট সাহস আছে যে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি। যারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টকে কাছে থেকে দেখেছেন আমার মনে হয় তারা কিছুটা হলেও আমার সাথে একমত হবেন। শুধু সৌন্দর্য্যের কারণেই নয়, সামরিক ঘাটির গুরুত্ব বিবেচনায়ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের গুরুত্ব অসীম।

নানা-দাদাদের কাছে শুনতে পেয়েছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘাটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সৌন্দর্য্য বর্ণনা কিংবা সামরিক ঘাটি হিসেবে এর গুরুত্বকে উপস্থাপন নয়, ভিন্ন কিছু। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালিন সময়ে প্রতিদিন বিকালে সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের শরীরচর্চার অংশ হিসেবে বিভিন্ন খেলায় অংশ নিতে দেখতাম। সামরিক বাহিনীর লোকজন ছাড়াও সাধারন মানুষও সেসব খেলা উপভোগ করত। ছোট্ট ছিলাম, সব খেলার নাম জানতাম না।

তবে একটা খেলাতে বরাবরই লোকসমাগম বেশি হত। হাটিহাটি পা পা করে স্কুলে যাওয়ার কারণে আমি অবশ্য ততোদিনে এতটুকু বিদ্যা অর্জন করেছি যে, এটা আমাদের জাতীয় খেলা। সে কারণে আমিও খেলাটির প্রতি একটি বাড়তি টান অনুভব করতাম। খেলাটির জন্য বেশি জায়গা বা উপকরণের প্রয়োজন ছিলনা। জায়গা বা উপকরণ সামগ্রীর বাহুল্যতা না থাকলেও এর দর্শক সংখ্যায় কোন কমতি বা উত্তেজনার কোন অভাব ছিলনা।

খেলোয়ার ও দর্শনার্থীদের উত্তেজনার মাত্রাটা সময়ে সময়ে এতোই বেশি হত যে একটা সময় মনে করার কোন উপায় ছিলনা এটা কোন নিয়ন্ত্রিত এলাকা কিংবা এতে বিশেষ শ্রেণীর একদল মানুষ অংশগ্রহণ করছে যারা সাধারন মানুষ হতে আলাদা। দর্শক আর অংশগ্রহণকারীদের মাঝে আনন্দ আর উত্তেজনার একাকার হয়ে যেত সব ভিন্নতা, সব নিয়ন্ত্রণ। বছরের অন্তে নানা বাড়িতে গেলেও এই খেলাটার জৌলুস দেখতে পেতাম। ছেলে-বুড়ো সবাই সমানভাবে উপভোগ করত। একই গ্রামের বিভিন্ন পাড়ার মধ্যে অথবা বিবাহিত, অবিবাহিত এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে খেলাতে অংশগ্রহণ করত।

তবে সবচেয়ে বেশি মজা হত যখন বিভিন্ন গ্রামের মাঝে খেলাটি অনুষ্ঠিত হত। খেলার দু'তিন দিন আগেই মাইকিং করে প্রচার চালানো হত। সে সময়টাতে এটাই থাকত এলাকার প্রধান ইস্যু। দেশের নানাপ্রান্ত থেকে এলাকার বাসিন্দারা আসত খেলা উপভোগ করার জন্য। নিজ গ্রামকে সমর্থন করার জন্য।

গ্রামের সন্মানটা তখন বাচা-মরার চাইতে বেশি গুরুত্ব বহন করত। যে দল জয়ী হত সেই দলের খেলোয়ারদের কাধে নিয়ে গ্রামবাসী সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াত। যারা হারত তারা কয়েক সপ্তাহের জন্য ঘরের কোণে লজ্জায় মুখ লুকাত। এই উম্মাদনার রেশ ও আলোচনা পরের বছর একই রকমের প্রতিযোগিতার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত থাকত। বাবার চাকরী বদলিজনিত কারণে যখন কুমিল্লা থেকে বর্তমান স্থানে আসি তখন এখানেও খেলাটির প্রভাব লক্ষ্য করি।

যদিও তা পূর্ব অভিজ্ঞতার সমতুল্য ছিলনা। তবুও অন্যান্য খেলাগুলোর সাথে সমানতালে একেও লড়তে দেখেছি। শুধু এলাকাভিত্তিক নয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এ খেলাটি আলোচিত ছিল। সাফ গেমস বা এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ যে দুয়েকটা পদক পেত তা এই খেলার মাধ্যমেই পেত। নিজের ঐতিহ্য বা কৃষ্টিকে দূরে ঠেলার এবং অন্যেরটা গ্রহণ করার মত একটা উদার মানসিকতা আমাদের চিরদিনই আছে।

সে কারণেই সুদূর চীনের জায়ান্ট পান্ডা কিংবা এন্টার্কটিকায় বসবাসরত কোন প্রাণী অথবা ব্রাজিলের আমাজান বন নিয়ে আমাদের সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থাগুলো কিংবা গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রগুলো যতোটা হাহাকার করে সুন্দরবনের বিলুপ্তি বা কক্সবাজারের অব্যবস্থাপনা নিয়ে তার অর্ধেকও করেনা। একই সূত্র ধরে আমাদের সরকার অথবা মিডিয়া বিদেশী খেলাগুলোর যতোটা পৃষ্ঠপোষকতা অথবা প্রচার করে দেশীয় খেলাগুলোর ক্ষেত্রে তার শতভাগের একভাগও করেনা। গড়পরতা সব দেশীয় খেলার কথা না হয় বাদই দিলাম, যে খেলাটিকে আমরা জাতীয় খেলা হিসেবে গ্রহণ করেছি সে খেলাটির দিকে নজর দেয়ার মত সময় আমাদের সরকার বা মিডিয়াগুলোর একদমই নেই। নামকাওয়াস্তে একটি ফেডারেশন থাকলেও তার কোন কার্যক্রম নেই। খেলাটিকে ছড়িয়ে দেয়াতো দূরের কথা এটিকে বাচিয়ে রাখারও কোন প্রয়াস নেই।

এই কারণেই খেলাটি ধীরে ধীরে আজ বিলুপ্তির পথে। এখানে এ সুযোগে হয়ত কেউ বলতে পারেন আমি বিদেশী খেলাগুলোর বিরোধীতা করছি। বিষয়টা মোটেও তা নয়। বহির্বিশ্বে পরিচিতি, অংশগ্রহণ অথবা সমানতালে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিদেশী খেলাগুলো যেমন, ফুটবল, ক্রিকেট এগুলোর দিখে অবশ্যই নজর দিতে হবে, পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। সেই সাথে নিজের ঐতিহ্য এবং কৃষ্টিকে ধরে রাখার জন্য অবশ্যই দেশী খেলাগুলোকে বাচিয়ে রাখতে হবে, পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।

খেলাটির জনপ্রিয়তা বা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। একথা হয়তো ঠিক খেলাটির জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা বিদেশী খেলাগুলোর তুলনায় অনেকাংশেই কম। তবে এর জন্য খেলাটির প্রতি আমাদের উদাসীনতাই দায়ী, খেলাটির ফরমেট নয়। লন টেনিস, টেবিল টেনিস, কুস্তির মতো ব্যক্তিগত ইভেন্টের খেলাগুলো অথবা ক্রিকেটের মতো অলস খেলাগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে শুধুমাত্র পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রচারের কারণে। অথচ দর্শকের প্রাণে উত্তেজনা, উম্মাদনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় খেলাটি এগুলোর চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।

আমি অবশ্য এটা আশা করিনা যে সরকারের উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে খেলাটি উল্লেখিত বিদেশী খেলাগুলোর মতো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। তবে এতটুকু আশা করতে দোষ নেই যে, সরকারের উপযুক্ত সহায়তা পেলে খেলাটি আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে। এ সহায়তার অংশ হিসেবে সরকার ফেডারেশনকে শক্তিশালী করতে পারে। নিয়মিত জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে খেলাটির আয়োজন করতে পারে। তাছাড়া প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, চীন বা জাপান যেখানে অল্পবিস্তর খেলাটির চর্চা হয় সে সমস্ত দেশগুলোকে নিয়ে সময়ে সময়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারে।

এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে আশা করা যায় খেলাটি এদেশে তার হারানো আসন ফিরে পাবে। এমনকি বিদেশেও খানিকটা ছডিয়ে পড়বে। খানিকটা আবেগের বশেই হোক অথবা নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি মমতা দেখাতেই হোক আমরা খেলাটিকে আমাদের জাতীয় খেলা হিসেবে ঘোষণা করেছি। এ কারণে খেলাটিকে টিকিয়ে রাখার একটা দায়বদ্ধতা অবশ্যই আমাদের আছে। নচেৎ এমন দিনও হয়তো আসবে যখন কোন ছাত্রকে তার শিক্ষক সাধারন জ্ঞান পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে আমাদের জাতীয় খেলা কি তা জানতে চাইলে মুখস্থ বিদ্যার জোরে হয়তো সে সঠিক উত্তরটিই দিবে।

তবে পরক্ষণেই হয়তো শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করবে খেলাটি খেলতে কয়টা বলের দরকার হয়। শিক্ষক হয়ত স্বগর্বে বলে উঠবেন, এগারটা। পাদটিকা: একটি নাতিদীর্ঘ রচনা লিখে ফেললেও খেলাটির নাম একবারও মুখে আনার সাহস পেলাম না। পাছে ভুল নাম বলে আপনাদের উপহাসের পাত্র হই এই ভয়ে। হাজার হোক অন্যদের মতো আমিতো এদেশেরই একজন, বিচ্ছিন্ন কেউ নই।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.