আমার ব্লগে আপনাকে ............... স্বাগতম
আমাদের সমাজের অনেকেই আছেন যারা অন্যের অনুকরণ করতে পছন্দ করে। এসব করতে গিয়ে তারা নিজেদের স্বকীয়তা এবং স্বাধীন চিন্তা ভুলে যেতে বসে। এরপর এক সময় তাদেরকে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে দেখা যায় । তো অন্ধ অনুকরণের পরিণতি সম্পর্কে আসুন আমরা একটি গল্প পড়ি।
এক দেশে ছিল এক সাদাসিধে ও ভবঘুরে ফকীর।
তার সহায়-সম্বলের মধ্যে ছিল কেবল একটি গাধা। গাধায় চড়ে তিনি গ্রামে-গঞ্জে ও শহর-বন্দরে ঘুরে বেড়াতেন। সারাদিন পথ চলতেন আর রাত কাটাতেন কোন খানকায় বা পীর-ফকিরের দরগায়। এরকম কোন স্থান পাওয়া না গেলে এই ভবঘুরে ফকীর কোন মসজিদ-মাদ্রাসায় রাতা কাটাতেন আর বলতেন, ‘ ফকীর দরবেশের যেখানেই রাত,সেখানেই কাত। ' ফকীরের কাজ ছিল মানুষকে উপদেশমূলক কবিতা পাঠ এবং হামদ,নাত ও গজল শোনানো।
মানুষ এসব শুনে তাকে যা দান-খয়রাত করতো তা দিয়েই চলে যেত তার একাকী জিন্দেগী।
একদিন এই ফকীর মরুপ্রান্তর পাড়ি দিয়ে গাধায় চলে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থায় এক গ্রামে এসে পৌঁছুলেন। গ্রামে পৌঁছার পর তিনি লোকজনের কাছে জানতে পারলেন যে, কাছেই একটি জঙ্গলের ভেতর ফকীরদের একটি আস্তানা আছে। সংসারত্যাগী ফকীর সেখানে গিয়ে দেখলেন, একদল ফকীর দরবেশ আসর জমিয়ে বসে আছে। ফকীর তার গাধাটি নিয়ে গিয়ে খোয়াড়ে বাধলেন এবং খানকার একজন খাদেমকে গাধাটি দেখাশোনা করার অনুরোধ জানিয়ে প্রবেশ করলেন ফকীরদের দরবারে।
ফকীরদের আস্তানায় সাধারণ ভাল খারাপ সবধরণের মানুষই আড্ডা জমায়। সত্যিকার সূফী দরবেশ থেকে দীনহীন ভিখারী, ফকীর, ভবঘুরে বেকারের দল, এলাকার মস্তানেরা সবাই আড্ডা জমিয়ে থাকে এসব আস্তানায়। এই আস্তানাতেও অনেক দুষ্ট লোক ছিল যারা নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে লোকজনের সবকিছু হাতিয়ে নিতো। সে যাই হোক, ফকীরকে দেখে আস্তানায় দরবেশরা মারহাবা,মারহাবা বলে স্বাগত জানালেন। তার সাথে মুসাফাহা ও কোলাকুলি করে তাকে নিজেদের মধ্যে বসতে দিলেন।
দরবেশদের ব্যবহারে ফকীর তার পথের ক্লান্তি ভুলে গেলেন এবং তাদের সাথে কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়লেন।
এদিকে আস্তানায় উপস্থিত গ্রাম্য মস্তানরা ফকীরের গাধাটি দেখে মতলব আঁটতে লাগলো। তাদের কয়েকজন এই ফকীরকে অন্য দরবেশদের চেয়েও বেশী সম্মান দিতে লাগলো এবংতার সাথেগল্প-গুজবে মেতে উঠলো। আর বাকীরা চুপি চুপি আস্তানা থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল। তারা খোয়াড় থেকে গাধাটি বের করে গ্রামের ভেতর এক পথিকে কাছে বিক্রি করলো।
তারপর ঐ টাকা দিয়ে বাজার থেকে যাবতীয় খানাপিনা যেমন- মিষ্টি, সন্দেশ, হালুয়া, পরোটা, কোর্মা এসব কিনে নিয়ে ফিরে এলো দরবেশের আস্তানায়। আস্তানায় ঢুকেই একজন ঘোষণা দিলো :" আজ আমাদের এই খানকায় খাজাবাবা হুজুরের আগমনে আমরা খুবই আনন্দিত ও যারপরনাই খুশী। আজ দরবারে উপস্থিত সবাই এই ফকীর হুজুরের সম্মানে সামান্য খানাপিনার দাওয়াত দিচ্ছি। আসুন, এ দাওয়াত কবুল করে হুজুর কেবলার সম্মান রক্ষা করুন। "
গাধার মালিক ফকীরটি আড্ডাবাজ মস্তানদের মেহমানদার ও তোষামোদে একেবারে আত্মহারা হয়ে গেলেন।
সবাই তৃপ্তিসহকারে খাওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী শুরু হলো গানের আসর। সবাই নতুন ফকীরকে ঘিরে গোল হয়ে বসে আসর গরম করে তুললো আর মাথা ঝুঁকিয়ে ফকীরের খেদমতে সম্মান প্রদর্শন করতে লাগলো। আর মস্তানরা তো ফকীরকে ‘হুজুর কেবলা' বলতেই অজ্ঞান। মস্তানদের ইশারায় তবলচী তবলায় টোকা মারছে। ইতিমধ্যে এই তবলচীও গাধা বিক্রির কাহিনী জেনে নিয়েছে।
তাই গাধার ঘটনার সাথে মিল রেখে তারা যে গজল বানালো তার প্রথম লাইন একরম :
"হুজুর এলো খুশী এলা, দুঃখ যত মুছে গেলা
বলো বলো সবাই বলো, গাধা গেলো গাধা গেলো। "
সবাই যখন তবলার তালে তালে ‘গাধা গেলো,গাধা গেলো' বলে চিৎকার করে গজল গাইছিল তখন গাধার মালিক ফকির ভাবলেন, এটা বোধ হয় এই এলাকার কোন কাহিনী দিয়ে তৈরী করা গজল। তাই তিনিও অন্য সবার সাথে কোরাসে যোগ দিলেন। শেষ পর্যন্ত তার অবস্থা এমন হলো যে, তার ‘গাধা গেলো গাধা গেলো' আওয়াজ অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেলো। এভাবে ঘন্টাদুয়েক গানবাজনার পর কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে আস্তানাতেই শুয়ে পড়লো আবার কেউ কেউ যার যার বাড়ী ঘরে ফিরে গেলো।
পরের দিন সকালে সবাই আস্তানা ছেড়ে যার যার কাজে চলে গেলে গাধাওয়ালা ফকির ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। জামাকাপড় গোছগাছ করে সফরের জন্য তৈরি হলেন। আস্তানা থেকে বের হয়ে তিনি সোজা চলে গেলেন গাধার আস্তাবলে। কিন্তু সেখানে তার গাধাকে দেখতে পেলেন না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আস্তাবলের খাদেমের সাথে তার দেখা হল।
খাদেমকে দেখেই ফকির রেগেমেগে বললেন :
ফকির : এই বেটা ! আমার গাধা কই ?
খাদেম : গাধা! কোন্ গাধা ?
ফকির : কোন্ গাধা আবার ! আমার গাধা। কেন তোর কি মনে নেই, গতকাল আস্তানায় ঢোকার সময় এখানে তোর জিম্মায় আমার গাধাটা রেখেছিলাম।
খাদেম : তা মনে থাকবে না কেন? কিন্তু আপনার কি মনে নেই, গতরাতে যখন এত মজার মজার খানাপিনা খেলেন তা কোত্থেকে এলো ? যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাহলে শুনুন, আপনার গাধা বিক্রির টাকা দিয়েই ওসব কেনা হয়েছে।
ফকির : কি বললি! আমার গাধা বিক্রি করে ওসব কেনা হয়েছে ! এই, এই বেটা, তোকে কে অনুমতি দিয়েছে আমার গাধা বিক্রি করার ? বল্, বল্ শিগগির।
খাদেম : আপনি আমার উপর ক্ষেপছেন কেন ? গাধা কি আমি বিক্রি করেছি নাকি ? গাধা তো বিক্রি করেছে মস্তানরা ।
ফকির : মস্তানরা বিক্রি করেছো ? কিন্তু তুই ওদেরকে গাধাটা দিতে গেলি ক্যান ? আমি কি গাধার মালিক ছিলাম না ?
খাদেম : আমি কি করবো? আমি কি জোরে ওদের সাথে পারি ? ওরা ছিলো ১০ জন। সবাই এসে আমাকে ভয় দেখিয়ে বললো , গাধাটা নিয়ে যাচ্ছি,যদি কোন কথা বলিস তোর একদিন, কি আমাদের একদিন! একথা শোনার পর আমি জানের ভয়ে চুপ করে ছিলাম। তারা গাধাটা নিয়ে চলে যাবার পর এখানে দুইজনকে পাহারায় রেখে যায় যাতে আমি আপনাকে খবরটা না দিতে পারি।
ফকির : তা না হয় মানলাম। কিন্তু ওরা চলে খাবার-দাবার কিনে আনার পরও তো আমাকে জানাতে পারতিস।
তাহলে নিশ্চয়ই ওদেরকে ধরতে পারতাম।
খাদেম : আমি তো এরকমই করতে চেয়েছিলাম। ঘটনার ঘন্টা দুয়েক পর যখন আস্তানায় গেলাম তখন শুনতে পেলাম সবার সাথে আপনি জোরেসোরে বলে যাচ্ছেন, গাধা গেলো,গাধা গেলো। আমি ভাবলাম, গাধা বিক্রির ঘটনাটা আপনি নিশ্চয়ই জেনেছেন। তাই কিছু না বলে ফিরে এসেছি।
খাদেমের কথা শুনে ফকিরের চেতনা ফিরে এলো এবং আমতা আমতা করে বললেন :
ফকির : তুই ঠিকই বলেছিস বাপু । এখন বুঝতে পারছি সবকিছু। আসলে সব দোষ আমারই। না জেনে, না বুঝে ওদের কার্যকলাপ অনুকরণ করে, ওদের তোষামোদে ফুলে গেছি আমি। যদি প্রথম থেকেই ভেবে দেখতাম, "গাধা গেলো,গাধা গেলো," শ্লোগানের অর্থ কি- তাহলে নিশ্চয়ই এমনটি হতো না।
এখন আর কিইবা করার আছে। আমার অন্ধ অনুকরণই আমার সাথে সাথে তোকেও ধোঁকা দিয়েছে। কবি ঠিকই বলেছেন :
"সর্বনাশ করে সবার অন্ধ অনুকরণ,
ধ্বংস হোক এ নীতির, হোক চির মরণ । "
সংগ্রহীত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।