দাউ দাউ করে পুড়ছে একটা বাস, দোজখের আগুনের মতো, ‘সিলেট-হবিগঞ্জ সুপার এক্সপ্রেস’ লেখাটা স্পষ্ট আর সৌকর্যময়। জানালা দিয়ে বেরিয়ে আছে একজোড়া পা, মানুষের দুটো পা, জুতো পরা। পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে ওই মানুষটা। সকালবেলা তিনি বের হয়েছিলেন জুতামোজা পরে; নাশতা করেছিলেন, প্রিয়জনের কাছে বিদায় নিয়েছিলেন, কাজে যাচ্ছিলেন কিংবা যাচ্ছিলেন আপন ঠিকানাতেই। তাঁরও জনক-জননী আছে, তাঁরও জন্মের সময় মুখে মধু বা কানে আজান দেওয়া হয়েছিল।
ওই মানুষটিও স্কুলে গেছেন, লেখাপড়া শিখেছেন; তাঁরও আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব আছে, তিনিও ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে গেছেন। একটা মানুষ। একটা জলজ্যান্ত মানুষ। বিবাহিত হলে তাঁর স্ত্রী-সন্তান আছে, হয়তো। তাঁর কী অপরাধ? কেন তাঁকে জ্বলন্ত বাসের মধ্যে কাবাবের মতো পুড়তে হলো?
এ কোন রাজনীতি? এ কোন মানবিকতা? এ কোন আদর্শ? রাজনীতি মানে না নীতির রাজা? নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে মারার নাম নীতির রাজা? মানুষ মেরে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা?
১৮ ডিসেম্বর ২০১১ ঢাকাসহ সারা দেশে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো কী ঘটতে দেখলাম আমরা! সারা দেশে একযোগে বাসে আগুন, গাড়িতে আগুন, বাস ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ।
ককটেল বিস্ফোরণে ঢাকার মতিঝিলে মারাও গেছেন এক তরুণ।
এ তো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ নয়। রাস্তায় আন্দোলন আমরাও করেছি, নব্বইয়ের দশকের উত্তাল গণ-আন্দোলনের দিনগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে পুলিশের সঙ্গে ঢিল ছোড়াছুড়ির অভিজ্ঞতা আমাদেরও কিছু আছে। বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা ছিল ওই দিন, তাতে আসার পথে পুলিশ বাধা দিয়েছে। তাতেই একযোগে সারা দেশে এতগুলো ককটেল সকালবেলাতেই ফুটতে পারে না, এতগুলো বাসে আগুন জ্বলে উঠতে পারে না, যদি না আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে, প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে থাকে।
একটা ঠান্ডা মাথার পূর্বপরিকল্পনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আগে থেকেই নির্দেশ দিতে হয়েছে, ককটেল বানাও। গাড়ি পোড়ানোর সিদ্ধান্তটাও কাউকে না কাউকে নিতে হয়েছে এবং সেটা সারা দেশের কর্মীদের জানিয়ে দিতে হয়েছে।
জনাব পরিকল্পনাকারী ও হুকুমদাতা, অভিনন্দন! আপনার পরিকল্পনা আমাদের কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। আজ আপনি যখন নাশতা করছেন, প্রথম আলোর ১৯ ডিসেম্বর ২০১১-এর কাগজটা হাতে নিন।
ওই যে মানুষটা বাসের জানালা দিয়ে পা বের করে দিয়ে ভেতরে দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাচ্ছেন, যাঁর মাংসের পোড়া গন্ধে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের চণ্ডীপুলে বদিকোনার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে, তাঁর মৃত্যুর গন্ধ, পোড়া মাংসের গন্ধে আপনার আজকের ব্রেকফাস্ট কি আরও জমে উঠল?
পত্রিকায় নানা কথাই লেখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতের পরিকল্পনা ছিল মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনার নাম করে সারা দেশ থেকে লক্ষ মানুষকে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জড়ো করে সেখান থেকে সচিবালয়ের দিকে যাত্রা করে রাজধানী অচল করে দেওয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগেই সেটা টের পেয়ে গিয়ে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা সমাবেশে প্রবেশে বাধার প্রতিক্রিয়া ককটেল-বোমার গণবিস্ফোরণ নয়, হতে পারে না। যাত্রীভরা চলন্ত বাসে আগুন দেওয়াটাকেও গণ-আন্দোলন বলে না।
একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল চ্যানেল আইয়ের সংবাদ থেকে। ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ হলো তারই প্রতিক্রিয়া। গোলাম আযমের কথিত গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়া দেখাতে এত বিপুলসংখ্যক গাড়ি ভাঙচুর, গাড়িতে আগুন আর বোমা ফাটানোর মহড়া!
হরতালের আগের দিন গাড়িতে আগুন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এখন হরতালের দিনে গাড়ি চলে নিরাপদে, কিন্তু হরতালের আগের সন্ধ্যায় গাড়ি পাওয়া যায় না, রাজধানীর রাজপথে অফিসফেরত মানুষ ভোগান্তির শিকার হয় চরম।
আর এইভাবে গাড়ি পোড়াতে গিয়ে, গাড়িতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে মানুষ মারা হয়েছে অতীতে, এই শহরেই। বেবিট্যাক্সিতে আগুন দিয়ে এর চালককে জীবন্ত কয়লা বানানো হয়েছে একাধিকবার। পুরো শরীরের দগদগে ক্ষত নিয়ে বেবিট্যাক্সিচালক কয়েক দিন অকল্পনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন হাসপাতালে, তারপর একসময় ঢলে পড়েছেন মৃত্যুর কোলে—এই সব খবর আমরা ভুলতে পারি না। হরতালের আগে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিতে হবে, এটা কোন ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি? এ তো স্রেফ বর্বরতা। যাত্রী কিংবা চালকসমেত বেবিট্যাক্সিতে আগুন দিতে হবে—জ্বলন্ত শরীর নিয়ে কাতরাবে, গড়াগড়ি খাবে মানুষ; এই দৃশ্য দেখার মধ্যে কোন রাজনৈতিক পরিতৃপ্তি, কোন তৃপ্তির ঢেকুর?
ছোট্ট কন্যাটি অপেক্ষা করে বাড়িতে, বাবা আসবেন।
বাবা আসেন না। মা সারা রাত জেগে থাকেন দরজা ধরে, পথ চেয়ে—এই বুঝি ছেলে ফিরে এল। ছেলে ফিরবে কী, সে তো একটা পোড়া মাংসের অবয়বহীন দলা হয়ে পড়ে আছে কোনো ভস্মীভূত গাড়ির ভেতরে।
আমাদের রাজনীতিবিদদের, আমাদের নেতাদের বুঝতে হবে, প্রতিটা জীবন মূল্যবান। অধিকার জনগণের হয় না, অধিকার হয় প্রত্যেক মানুষের।
নিরাপত্তা সারা দেশের মানুষের হয় না, নিরাপত্তা হয় প্রত্যেক মানুষের আলাদা আলাদা। একটা মানুষকে হত্যা করা মানে মানবতাকেই হত্যা করা। একজন নাগরিককে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারা মানে মানবসত্যকেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারা।
আগে থেকে ঘোষণা না দিয়ে হঠাৎ করে আপনি গাড়ি ভাঙতে, আগুন জ্বালাতে, ককটেল ফোটাতে কেন যাবেন? গত পরশু ঢাকা শহরে মানুষের কী ভোগান্তিটাই না হয়েছে। একদিকে যানজট, অন্যদিকে আতঙ্ক।
কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে বিপদে পড়েছে মানুষ, কাজ থেকে ফেরার পথে যানবাহন পাওয়া হয়ে পড়েছে ভার। মানুষের এই সব দুঃখ-কষ্টের কোনোই মূল্য নেই আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছে? কিসের জন্য রাজনীতি করেন আপনারা? শুধু ক্ষমতার মধু পান করার জন্য, শুধু কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার জন্য, শুধু বিরোধী মতকে দলন করার জন্য?
আর সারা দেশে একযোগে বোমা ফাটানোর মানে কী? এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় জেএমবির সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের দিনগুলোর কথা। আমাদের ভয় হয়, বড় নেতাদের জেলখানায় ঢুকতে দেখে জামায়াত তার মরণকামড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা সারা দেশকেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার কর্মসূচির একটা মহড়া করল মাত্র। আর পরিহাসটা দেখুন।
কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়ার আর মাঠে ককটেল হাতে নেমে পড়েছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিটি।
যে পরিকল্পনাকারীরা এই ককটেল বানানোর ও ফাটানোর পরিকল্পনা করেছে, নির্দেশ দিয়েছে, তাদের নাকে কি মাংসপোড়া গন্ধ যাচ্ছে না? আরবের সব সুগন্ধীও কি তাদের হাতে রক্তের গন্ধ দূর করতে পারবে?
হয়তো এদের কোনো ঘ্রাণেন্দ্রিয় নেই। ক্ষমতার মোহ এদের নাক-কান-চোখ বন্ধ করে দিয়েছে। এদের বিবেক বহু আগেই মারা গেছে। সাধারণ দয়া-মায়া-করুণা নামের মানবিক গুণগুলো এদের সত্তা থেকে বহু আগেই বিতাড়িত।
এরা অন্ধ, এরা ক্ষমতান্ধ, এরা অন্ধ, এরা আদর্শ-অন্ধ।
এরা করতে পারে না, এমন কোনো কাজ নেই।
হে আল্লাহ, এই রকম রাজনীতি-অন্ধ, ক্ষমতা-অন্ধ, আদর্শ-অন্ধ ভয়ংকর রাজনীতিকদের হাত থেকে দেশ ও মানুষকে তুমি রক্ষা করো।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।