আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
২০০২ থেকে আজ পর্যন্ত যতটুকু সময় বাসায় থেকেছি বেশির ভাগই পিসির সামনে কেটেছে। হয়ত কোন সফটওয়্যার নিয়ে ঘাটা ঘাটি করেছি, ইন্টারনেটের এ গলি ও গলি ঘুরেছি, বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং, সিনেমা দেখা, গান শুনা আর লেখা পড়া তো আছেই। অথচ ২০০২ এর আগে এই যন্ত্র বিষয়ে আমার এককথায় কোন ধারণাই ছিল না।
আমি প্রথম কম্পিউটার ধরি ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় সেই তিরানব্বই সনে। এক কাজিনের কম্পিউটার ছিল, তাদের বাসায় গিয়ে দেখেছিলাম।
মাউসের নাম ও কাজ দেখেতো অবাক আমি। মনিটরে আমার নাম টাইপ করতে দিল ভাইয়া। আহা!! কি মজা। তারপর নিজে নিজে করলাম, একটা গেমও খেললাম। খুব সিম্পল একটা গেম ছিল, মোবাইলের স্নেক গেমটার মত।
অবশ্য কোন সাপ ছিল না তখন, একটা রেখা ঘুরে ঘুরে ১, ২, ৩ এই সব সংখ্যাকে ধরত আর লম্বায় বড় হত। আপ, ডাউন, লেফট-রাইট অ্যারোগুলো কন্ট্রোল করতে খুব সমস্যায় পড়েছিলাম তখন। তারপরই কম্পিউটারের সাথে সম্পর্কের ছেদ ঘটে।
এরপর চারিদিকে কম্পিউটারের নানা কথা শুনতাম কিন্তু কিছুই বুঝতাম না। স্কুলে “কম্পিউটার ও বিজ্ঞান” রচনাটা আমি কখনই পড়ি নাই, কারন কিছুই মাথায় ধরত না।
নাইন-টেনে আমাদের স্কুলে “কম্পিউটার বিজ্ঞান” বিষয়টা ছিল না। বাবার এক বন্ধুর ছেলে মতিঝিল মডেল স্কুলে পড়ত, ঐ ছেলে সাবজেক্টটা নেয়। ওদের বাসায় গিয়ে দেখি তার বাবা তাকে কম্পিউটার কিনে দিয়েছে। কিন্তু সে তার কম্পিউটার প্লাস্টিক মুড়েই রেখে দিত, ব্যবহার করত না। যখন কলেজে পড়ি তখন আর এক কাজিন কম্পিউটার কেনে।
তাদের বাসায় গেলে ভাইয়া খালি কম্পিউটারের কথা বলত, কিন্তু ধরতে দিত না। একবার খুব আর্জি করায় সামনে বসতে দিয়েই আবার উঠিয়ে দিল। সে আমাকে বলত আগে উইন্ডোজ ৯৮, এম এস ওয়ার্ড ইত্যাদি শেখ তারপর কম্পিউটার ধর। নইলে নাকি নস্ট করে ফেলব। আমি বুঝতাম না উইন্ডোজ ৯৮, এম এস ওয়ার্ড এগুলা কি জিনিস, দেখতে কেমন, খায় না মাথায় দেয়! বন্ধুরা কম্পিউটার মেলায় যেত, আমি কোন আগ্রহ পেতাম না।
তবে হ্যা, আগ্রহ বাড়ছিল। বাসায় এসে মায়ের কাছে ধিরে ধিরে ব্যাপারটা তুলতে লাগলাম। প্রথম প্রথম মায়ের কাছে এটা একটা বিলাসিতা মনে হত। আমি একটু চালাকি করে মাকে বুঝালাম, অন্য সবার আজকাল কম্পিউটার আছে। সবাই এসব নিয়ে কথা বলে, আমি কিছুই জানি না তাই চুপ করে থাকি।
ওদের থেকে পিছিয়ে পড়ব। ছেলের দুঃখ মায়ের মনে আঁচড় দিল, শুরু হল বাবা পর্ব।
কলেজে পড়ার সময় বুঝলাম এই জিনিস অন্তত কলেজ জীবনে পাওয়া হবে না। ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় ফলাফল সামনের দিকে থাকায় বাবা আমার উপর খুশি। বুঝলাম, লোহা গরম থাকতেই বাড়ি দিতে হবে।
ঠিক সেই সময়, বাবার ব্যাংকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের উপর ১৫ দিনের কোর্স হয়। কোর্স শেষে কম্পিউটার কিনবার জন্য লোনও দেওয়া হয়। বাবার কলিগদের যারা লোন নিয়েছিল তাদের কয়েকজনই কম্পিউটার কেনে। বাবা আমাকে বাসায় এসে বলে, তার কোন এক কলিগের স্কুল পড়ুয়া ছেলে কম্পিউটারে কি কি লাগবে তার পুরা লিস্ট বাপকে দিয়ে দিয়েছে, ছেলেটা স্মার্ট, কত কিছু জানে!! কথাটা আমার খুব গায়ে লাগল। এক বন্ধু তখন কম্পিউটার সাইন্সে পড়া শুরু করছে।
তার কাছ থেকে পিটার নর্টনের Introduction to computer বইটা এনে অর্ধেক পড়লাম। কম্পিউটার কি, কত প্রকার, এতে কি থাকে, কোন তার কাজ কি, কনফিগারেশন পর্যায়ের মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা পেলাম। এর আগ পর্যন্ত কম্পিউটার বলতে চিনতাম শুধু মনিটর। বাবাকে নিজেই লিস্ট করে দিলাম, কি কি কিনব।
এর আগে অবশ্য একটা ঘটনা ঘটে।
আমরা দুই বন্ধু একদিন সকালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে বের হলাম। দুই দিন পরেই পড়া শুরু করব, অন্য রকম একটা ভাব। দুপুরের দিকে বাড্ডায় আর এক বন্ধুর বাসায় গেলাম। ওর বড় ভাই কয়েক মাস আগেই কম্পিউটার কেনে, ভাইয়া সেদিন বাসায় না থাকায় আমরা চান্স পাই। টাইপিং মাস্টার সফটওয়্যার দিয়ে প্রথম সিস্টেমিক টাইপিং শেখার শুরু ওখান থেকেই।
খুব মজা লাগছিল, একটু পর পর ম্যাসেজ দিত আমার টাইপিং ইফিসিয়েন্সি বাড়ছে। তারপর শুরু করলাম ক্রিকেটের গেমটা খেলা। চার-ছক্কা মারতে মারতে খেয়াল নাই কখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত চলে এল। বাসায় ফিরে তো দেখি তুলকালাম অবস্থা। বাবা ঢাবি ক্যাম্পাসে আমাকে খুজতে যাবার জন্য রেডি, মা কান্না-কাটি চালাচ্ছে।
তখনতো মোবাইলও ছিল না যে খবর দেব, তাছাড়া আমি সন্ধ্যার পর কখনই বাইরে থাকি নাই আগে। কৈফিয়ত দেই সত্যি কথা বলে, কম্পিউটারে ডুবে গিয়েছিলাম। ঘটনাটা টনিক হিসেবে কাজ করে।
২০০২ সালের ২৩ এপ্রিল আমাদের ঘরে কম্পিউটার আসে। পেন্টিয়াম 4, 1.6 GHz মোট খরচ পরে ৪০,০০০ টাকা।
বাবার অফিসের পরিচিত এক লোকের দোকান থেকে কেনা হয়, বাসায় এসে দিয়ে যায়। তা সেট করার পরে, লোকটা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনাকে কি কিছু শিখায়া দিব?”। কিন্তু হায়! কি শিখাবে তাই জানি না। প্রশ্ন করতে পারলাম না। এমন পরিস্থিতি নিশ্চয়ই সেই লোক অনেক দেখেছে।
সে আমাকে কম্পিউটার ছাড়া, সাট ডাউন আর গান/ভিডিও এইসব দুই একটা ব্যাপার দেখিয়ে গেল। সাথে বলে গেল মাস খানেকের মধ্যে অনেক কিছুই জেনে যাব। সে আমাকে রোড-র্যাশ গেমটাও দেখিয়ে যায়।
তো এই হল আমার আর কম্পিউটারের সম্পর্কের সূত্রপাত। প্রথম প্রথম খুব সাবধান থাকতাম, যদি কোন ঝামেলা করে ফেলি।
তারপরও ঝামেলা করে ফেলতাম। পাশের বাসায় সুশান্ত ভাইয়া আহসানুল্লাহতে কম্পিউটার সাইন্সে পড়ত। সে আমাকে এসে বলে, “ইচ্ছামত কাজ কর। যা ইচ্ছা ডিলিট করে দাও, এইভাবেই শিখতে পারবা। আর আমি তো আছিই”।
আমার প্রথম ইয়াহু ইমেইল এড্রেস ভাইয়াই খুলে দেয়। সেই থেকে শুরু দুশ্চিন্তাহীন পথ চলা, যদিও মাঝে দুইবার সব ডাটা হারাতে হয়েছে। বছর দুই আগে, আগের মাদারবোর্ড, হার্ডিক্স এলিফেন্ট রোডে বিক্রি করে সিস্টেম আপডেট করলাম।
কম্পিউটার অনেকের কাছে একটা যন্ত্র বিশেষ। আমার কাছে এটা যন্ত্রের অধিক।
আমার চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটে এই কম্পিউটার দিয়ে। মানবজাতির সব থেকে বড় তথ্য ভান্ডার আমার চোখের সামনে আসে এই যন্ত্রের সাহায্যে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের কত মানুষের সাথেই না আজ প্রাণের সম্পর্ক আমার যার মাধ্যম কম্পিউটার। মন ভাল হলেও আনন্দের গান শুনি, খারাপ থাকলে বিরহের গান শুনি এই যন্ত্রের মুখে। প্রেমিকা এসবের বিনিময়ে চাইবে সম্পূর্ণ আমাকে।
অথচ, প্রিয় কম্পিউটার চায় খানিকটা বিদ্যুৎ। আজ যদি বলি, “প্রিয় পিসি, তোমায় ভালবাসি”; খুব হয়ত বোকামি করা হবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।