সারাদিন নির্বিচারে ধর্ষণ করার পর বৈকালে আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং-এর ওপর তাদেরকে উলঙ্গ করে লম্বা লোহার রডের সঙ্গে চুল বেঁধে রাখা হতো। রাতের বেলায় এসব নিরীহ বাঙালী নারীদের ওপর অবিরাম ধর্ষণ চালানো হতো। আমরা গভীর রাতে আমাদের কোয়ার্টারে বসে মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনে অকস্মাৎ সবাই ঘুম থেকে ছেলেমেয়েসহ জেগে উঠতাম। সেই ভয়াল ও ভয়ঙ্কর চিৎকারে কান্নার রোল ভেসে আসত : ‘বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও, তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাদের বাঁচাও, পানি দাও, এক ফোঁটা পানি দাও, পানি, পানি। ’
ঢাকা পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর মোঃ সাহেব আলী ৩০ মার্চ দেখেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘পরদেশী নামে আমার জনৈক ডোমের হাতে এক ষোড়শী রূপসীর উলঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখলাম, দেখলাম সেই যুবতীর পবিত্র দেহে অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন, তার বুক থেকে স্তন সজোরে তুলে নেয়া হয়েছে, লজ্জাস্থান ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আছে, পিছনের মাংস তুলে নেয়া হয়েছে।
মিরপুরে পাকিস্তানীদের সহযোগী বিহারীদের অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন রমনা থানার সাব ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ সালেহজ্জামান...‘বাঙালী রমণীদের ধরে এনে রাস্তায় উলঙ্গ করে ফেলে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে তৎক্ষণাৎ ধারালো ছুরি দিয়ে স্তন ও পাছার মাংস ছলাৎ করে কেটে ফেলে নৃশংসভাবে হত্যা করছে। কাউকে কুঁচি কুঁচি করে কেটে ফেলছে। কারও যোনিতে লোহার রড ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ’
ঢাকা পৌরসভার ছন্নুডোম ২৯ মার্চের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন ‘... মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাইনি, যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পিছনের মাংস কাটা দেখেছি।
মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, তাদের হত্যা করার পূর্বে তাদের স্তন সজোরে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং পিছনের মাংস যেন ধারাল চাকু দিয়ে কেটে এ্যাসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ’
নওগাঁর জয়ম-ল জানিয়েছেন, ডকরামপুর ‘ঘাঁটি থেকে পাক-বর্বররা অন্য জায়গা হতে সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে মিশনে সাহেবের বাসার ওপর তলাতে আটকে রাখত। পাশবিক অত্যাচার ও ধর্ষণ করার পর গলা কেটে তাদের হত্যা করত। হত্যার পরে তাদের রক্ত চৌবাচ্চার নল দিয়ে স্থানীয় তুলসীগঙ্গা নদীতে পড়ত।
’
রংপুরের মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘রংপুর শহরে সাবেক ইপসিক-এর পাশে আর্মি হেডকোয়ার্টারের সংলগ্ন জনৈক মেজরের বাসভবনে রাত ১১টার দিকে জলসা বসত। বিভিন্ন স্থান থেকে ধৃত তরুণীদের দিয়ে জোরপূর্বক নাচ এবং গানের আসর করানো হতো। তখন তরুণীদেরকে যথেষ্ট ধর্ষণ করা হতো। যখন তারা চিত্ত বিনোদনে অসমর্থ হতো মেজরের নির্দেশে তাদের হত্যা করা হতো। ধর্ষিতা মেয়েদেরকে শুকনো রুটি এবং রাতে সামান্য ভাত দেয়া হতো।
দিনাজপুরের মঈনুদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, ‘তারা মেয়েদের ওপর প্রথমে অত্যাচার করত, তারপর তার গুপ্তাঙ্গের ভেতর রাইফেলের নল ঢুকিয়ে দিত। এক একটি মেয়ের ওপর ৭-৮ জন অত্যাচার করত। অত্যাচারের পর নির্যাতিত মহিলাদের বহুজন এমনি মারা যেত। তারা প্রকাশ্যেই এ অত্যাচার করত। ’
যশোরের আহাদ আলী জানিয়েছেন, ‘মেয়েদের ধর্ষণ করে কোন কোন ক্ষেত্রে বাচ্চা ছেলেকে কোলে বসিয়ে বাচ্চাটিকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে মেয়েটিকে রেখে দিত।
’
স্বরূপকাঠির জুলুঘাই আক্রমণ করে একদিন পাকিস্তানীরা। উষা রানী মল্লিক বাড়ির পেছনে কলাবাগানে পালিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে দেখেন পাশের বাড়ি থেকে দুটি মেয়েকে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। মেয়ে দুটিকে যখন ঘরের ভেতর নিয়ে যায় তখন তাদের কোলের ছোট ছেলেকে আছাড় মেরে বাইরে ফেলে দেয়। ঘরের ভেতর থেকে মেয়ে দুটির করুণ চিৎকার ভেসে আসতে থাকে।
মেয়ে দুটির ওপর পর পর ৪ জন মিলিটারি ধর্ষণ করে। মিলিটারি চলে যাবার পর আমরা মেয়ে দুটির কাছে যেয়ে দেখি তারা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের সারা শরীরে ক্ষতের চিহ্ন। পরনের কাপড় দূরে রয়েছে।
গৌরনদীর নূরজাহানকে সৈন্যরা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমাকে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখত। বেয়নেট দিয়ে সারা শরীর খোঁচাত, আঙ্গুলের ফাঁকে ইটের টুকরো ঢুকিয়ে চাপ দিত। এর সঙ্গেই তারা প্রতিদিন অসংখ্যবার আমার ওপর পাশবিক অত্যাচার করত। খান সেনাদের লোলুপতার সেই চিহ্ন এখনও আমার শরীরে রয়ে গেছে। ’
শৈলকুপার নাজিয়া খাতুনকে ৯ মাস ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল পাকিস্তানীরা।
জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, ‘খেতে পারতাম না। খেতে ইচ্ছেও করত না। কিন্তু আর্মিরা জোর করত। খেতে না চাইলে মারধর করত। আর প্রতিদিন চালাত সেই বীভৎস নির্যাতন।
কতবার ভেবেছি আত্মহত্যার করব। কিন্তু আত্মহত্যা করারও কোন সুযোগ ছিল না। গলায় দঁড়ি দেবার মতো দড়ি তো দূরে থাক, কাপড়টুকু পর্যন্ত পাইনি। শাড়ি পরতে দিত না। জামা পরে থাকতে হতো।
ওড়নাও পরতে দিত না। ’
নাজিয়ারা তবুও কাপড় পেয়েছিলেন অনেক জায়গায় কোনো কাপড়ও পরতে দিত না। ঝিনাইদহের কামরুননেসা জানিয়েছেন, তাকে এবং অনেক মহিলাকে একটি তামাকের গোডাউনে রাখা হয়েছিল। ‘সবার ইতিহাসই প্রায় এক। সেই ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া, সবার সামনে উলঙ্গ ও দলবদ্ধ করে রাখা।
তারপর কখনও এককভাবে, কখনও সম্মিলিতভাবে; কখনও দু’একজনকে কখনও অনেককে গণধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন চালিয়ে যাওয়া। এদের অনেকেই ছিল ক্ষত-বিক্ষত, হাত পা ও তলপেটের ব্যথায় এরা হাঁটতে পারত না। অনেকে আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। আমিও তখন ক’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সেই গুদামের মধ্যে পচে যাওয়া শরীরটাকে কোনোক্রমে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম।
’
নাজিয়ার ভাগ্য ভাল যে, তাকে খেতে দেয়া হতো। অনেককেই প্রায় খেতে দেয়া হতো না। আমাদের কেস স্টাডিগুলোতেই তার বিবরণ আছে। কানন বণিককেও ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল সেনাবাহিনী। তিনি লিখেছেন, ‘অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তারা যখন একটু পানি চাইত তখন হানাদার বাহিনী ডাবের খোসায় প্রস্রাব করে তাদের খেতে দিত।
’
পাইকগাছার বীরাঙ্গনা গুরুদাসীকে আমি নিজেও খুলনার রাস্তায় দেখেছি। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সবাই তাঁকে মাসী বলে ডাকতেন। হানাদার বাহিনী তার বাড়ি আক্রমণ করে। গুরুদাসীর দিকে তারা হাত বাড়ালে স্বামী গুরুপদ বাধা দেন।
তাকে তখনই গুলি করে মারা হয়। তারপর হত্যা করা হয় তাঁর দুই পুত্র ও এক কন্যাকে। কনিষ্ঠ কন্যা তখন মায়ের কোলে দুধ খাচ্ছিল। হানাদাররা ছোট মেয়েটিকে কোল থেকে তুলে কাদা মাটিতে ফেলে গুরুদাসীকে ধর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে পরে উদ্ধার করেন বটে কিন্তু তখন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।
১৯৭১ মালে তাদামাসা হুকিউরা ছিলেন বাংলাদেশে, সাহায্য-সহায়তা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। জাপানি এই ভদ্রলোক যুক্ত ছিলেন রেডক্রসের সঙ্গে। যুদ্ধ শেষে ফিরেছেন ঢাকায়। একজন মহিলাকে যাবার পথে কুমিল্লায় নামাবেন। তার সঙ্গে আলাপের এক পর্যায়ে তাদামাসা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যুদ্ধ চলাকালে কুমিল্লায় এক হাজার জনের মতো মহিলাকে পাকিস্তানী সেনারা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল বলে যে গুজব শুনেছিলাম, সেটা সত্য কিনা।
উত্তরে তিনি বললেন, সঠিক সংখ্যা বলতে পারি না, তবে ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছিল। আমাদের এ বাড়িতেই দুইদিন ধরে চারজন মহিলা আছেন, তারাও সেভাবে আটক ছিলেন। ’
শুনে বিস্মিত হলাম। তাহলে গুজবটা মিথ্যা নয়।
মি. আহমদের বোন দোতলা থেকে সেই চারজন মহিলাকে নিয়ে এলেন।
চারজনই কালো বোরকা দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে রেখেছেন। দেখে বুঝতে পারলাম এরা সবাই অন্তঃসত্ত্বা। জানতে পারলাম তাদের বয়স যথাক্রমে ২৬, ২২, ২১ ও ১৯ বছর। সবাই বিবাহিতা। ২৬ বছর বয়সী মহিলা এক কলেজে পড়ান।
বাকি তিনজন গৃহবধূ এবং প্রত্যেকে তিনজন অথবা আরও বেশি সন্তানের মা।
গত এপ্রিলে তাদের এখানে আনা হয়েছিল খুলনা, রাজশাহী, সৈয়দপুর ও বগুড়া থেকে। তাদের ব্যারাকে আটকে রাখা হয়েছিল। তাদের পরনে কোনো কাপড় দেয়া হয়নি। সম্ভবত কাপড় ছিঁড়ে গলায় ফাঁস দিয়ে যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে এ জন্য।
দিনের বেলায় একটা তোয়ালে এবং রাতে কম্বল ছাড়া আর কিছু দেয়া হতো না। গোসলের সময় তিনজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেয়া হতো। পাকিস্তানী সেনারা দড়ির এক প্রান্ত ধরে তাদের দিনের বেলায় পুকুরে নিয়ে যেত এবং গোসল করাত।
আমার বন্ধু ফজলুর রহমান বীরপ্রতীক বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের একদিন তিনি ছিলেন সাবরুমে। উল্টোদিকে রামগড়।
মাঝে শীর্ণকায় ফেনী নদী। ওপার থেকে তারা দেখছিলেন এ পারের দৃশ্য। হঠাৎ দেখেন, ছয়জন প্রায়-নগ্ন মহিলাকে এক দড়িতে বেঁধে দুই জন পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে এসেছে স্নান করতে নদীতে। দড়ি বাধা অবস্থায়ই তারা নদীর কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে। সৈন্য দু’জন অলসভাবে পাহার দিচ্ছে।
ভারতীয় সেনা অফিসারের মানা সত্ত্বেও তারা কয়েকজন পাকিস্তানী দু’জনকে হত্যা করে মেয়েদের উদ্ধার করেছিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে অপারেশন সম্পন্ন হয়েছিল। মেয়েদের একজন গুলিতে মারা গিয়েছিলেন।
মেজর থাপার (ভারতীয়) তার দেখা একটি ঘটনার কথা আমাকে বলেছিলেন, এদের কথা শুনে তাঁর কথা মনে পড়ল। ফেনীর কাছে ভারতীয় সেনারা যখন পাকিস্তানী সেনাদের ঘাঁটি অবরোধ করেছিল পাকিস্তানী সেনারা তখন বাঙালী মহিলাদের বিবস্ত্র অবস্থায় ঘাঁটির সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।
পাকিস্তানী সেনাদের হাতে আটকাবস্থায় মহিলাদের মধ্যে কেউ আত্মহত্যা না করলেও কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছিল বলে চারজন মহিলার মধ্যে দু’জন আমার সামনে সাক্ষ্য দেনÑ যারা পাকিস্তান সেনাদের আদেশ অমান্য করার চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদের সামনে তাদের মেরে ফেলা হয়েছিল। উদ্দেশ্য, পাকিস্তানী সেনাদের ইচ্ছামতো না চললে পরিণতি কী হবে তা দেখানো। ’
আরও আছে। বাবার সামনে মেয়েকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা, বাবাকে দিয়ে মেয়েকে ধর্ষণ ও পুত্রকে দিয়ে মাকে ধর্ষণের হুমকির বিস্তর বিবরণ আছে যা কেউ উল্লেখ করতে চায়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।