আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিনলিপি ৫: ফ্র্যাঙ্কি যেমন বলেছিল



"আই গট মাই ফার্স্ট রিয়েল সিক্স স্ট্রিং,বট ইট অ্যাট দ্য ফাইভ এন ডাইম। " ঘর কাঁপিয়ে ব্রায়ান অ্যাডামস গেয়ে ওঠার সাথে সাথেই নিশ্চিন্ত হলাম, খরচে বাম্বু দিলেও স্পিকারটা অন্তত ঠিক হয়েছে। ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে বসে আছি,সেই ঠ্যাং দু'টো আবার তুলে আছি টেবিলটার উপর ৩০ ডিগ্রী কোণে,বইয়ের পাশে পা তুলতে হয়না গুরুজনদের এমন একটা নির্দেশ অগ্রাহ্য করেই। ঠিক যেরকম নবাবী চালে হেলান দিয়ে থাকা পছন্দ সেরকম আরামদাক না চেয়ারটা,পেছনে গদির বদলে আছে রেক্সিনমোড়া একটা হাতল,কিছুক্ষণ হেলান দিয়ে থাকলে পিঠ ব্যথা হয়ে যায়,তারপরেও অভ্যাসবশে সেভাবেই আছি,এরচেয়ে আরামদায়ক কিছু আপাতত না পেয়ে। ১টা কোর্সের পরীক্ষা ড্রপ দিয়ে বেশ হালকা ছিলাম,কিন্তু পরীক্ষার দিনটা পার হয়ে যাবার পরেই হালকা একটা অনুশোচনা মতও হচ্ছে।

এমন কিছু রাজকার্য ছিলনা হাতে যার জন্য পড়াশোনা করা যাবেনা,সত্যি বলতে কি এত ঝাড়া হাত-পা থাকিনি অনেকদিন। কিন্তু প্রথম পরীক্ষাটা দেবার পর কেমন যেন একটা চরম আলসেমি ভর করে গেল,জার্নাল আর পেপারগুলো নিয়ে রাতে বিছানায় হেলান দিয়েই আরামে ঘুম,সকালে উঠে টের পেলাম যে সকাল হয়ে গেছে। এখন অবশ্য,কোর্স টিচারের উপর হালকা দায় চাপিয়ে অপরাধবোধ কমানোর একটা চেষ্টা লক্ষ্য করছি নিজের মাঝে,১৪ সপ্তাহের মাঝে মাত্র ৩য় বারের মত ক্লাসে গেলাম যেদিন শেষ ক্লাসে, রোলকল করার সময় একটু হতাশভাবেই জিজ্ঞেস করলেন,আজকে কি মনে করে আসলা? এ কথার কোন জবাব হয়না,মুখে চলেই এসেছিল আমার শ্বশুরকে দেখতে,কিন্তু তার কোন সম্প্রদানযোগ্য কন্যা আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হতে না পেরে চেপে গেলাম কথাটা। মনে হয় কন্যা নেই,বা থাকলেও আমাকে জামাতা হিসেবে তার মনে ধরেনি,কাজেই ঘোষণা করলেন,তোমার পাশ করার আশা নেই। যাব্বাবা,আমাকে দেখায় ফেলের ভয়? যা ব্যাটা পরীক্ষাই দেবনা,করাও এবার ফেল! তো,পরীক্ষা না দিয়ে এখন আমি দরজার ডাঁসার মত চেয়ার আর টেবিলের মাঝে ঠেকনা দিয়ে দোল খাচ্ছি আর বেসুরো তাল ঠুকছি ডান হাতটা দিয়ে।

বেশ নিশ্চিন্তেই হার্ডরক ছেড়েছি বলা যায়,প্রতিবেশীদের বিরক্ত হবার বিশেষ কোন আশংকা নেই,একে এই দুপুর ১২টার বেগুনপোড়া রোদে কেউ বের হবে না যদি বিরক্ত হয়েও থাকে,আর আমার মত কাজকর্ম ছাড়া লোকজন আশপাশের কোন বাড়িতে আছে এমনটাও মনে হয়না। তার ওপর গবেষণার ফলাফল বলে,এ বাড়ি থেকে শব্দ বাইরে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই,নিজে ভুক্তভোগী না হলে বিশ্বাস করতাম না ভেন্টিলেটার ছাড়া কোন বাড়ি থাকতে পারে। শব্দকে শব্দ, বাতাস তাপ কোন কিছুই বের হয়না,ফলাফল হিসেবে বাসাটা বেশ একটা প্রেশার কুকারের রূপ নিয়েছে,তফাৎ হল এখানে চাল-ডালের বদলে আমরা ক'টা হতভাগা প্রাণী ভাঁপা পিঠা হয়ে যাচ্ছি। বাড়িওয়ালাকে এমন অন্ধকূপ বানানোর কারণ জিজ্ঞেস করতে লাজুক হেসে জানালো,আসলে এসি বসানোর জন্য এই ব্যবস্থা। মনে মনে বলি,সম্বুন্ধির পো এসি বসানোর পয়সা থাকলে কি তোর এই কবুতরের খোপে উঠি? মুখে বলতে পারিনা, আমরা বড় নিরুপায়,মনে মুখে বড় জ্বালা।

এর মাঝে গান বদলে গেছে,নিয়াজ মোহাম্মদ গেয়ে চলেছেন,জীবনানন্দ হয়ে,সংসারে আজো আমি,সবকিছু ভুলে গিয়ে করি লেনদেন। একটু উদাস হয়ে যাই। সবকিছু ভুলে গিয়ে লেনদেন করা কি এতই সহজ? জীবনবাবু পেরেছিলেন,নিজের কবিতার মতই জীবনের শেষে ট্রামের তলায় চলে গিয়ে মৃত্যুর সাথেও নির্বিকার লেনদেন সেরে ফেলেছিলেন, আমাদের এত সাহস কোথায়? মনে হয় পিসি'রও সহ্য হলনা,দুম করে রিস্টার্ট করে গেল। এই আরেক ঝামেলা,হার্ডওয়্যার কোন একটায় সমস্যা করছে,২-৩ টা গান শুনলেই পিসি রিস্টার্ট হয়,কাজেই ২-১টা গান শোনার পরেই কিছুক্ষণ তাকে বিশ্রাম দেয়া লাগে। আপদটাকে মেরামত করতে যত খরচ গেছে ও দিয়ে নতুন পিসি একটা কেনা যেত কিন্তু এই বাপে-তাড়ানো-মায়ে-খেদানো পিসি'র উপর মায়া পড়ে গেছে,নিজে নড়বড়ে বলেই কিনা,নড়বড়ে যে কোন কিছুর দিকে বাড়তি একটা টান চলে আসে।

পিসি রিস্টার্ট হলে আবারো গান চালাই,সময় কাটতেই চায়না,আশপাশের জানালায় কোন সুন্দরীও আসেনা যে দেখে চোখ জুড়াবো,যে পাড়ায় যাই সেটাই কি নারীশূন্য হয়ে যায় নাকি? বন জোভি হুংকার ছাড়ে--"ঊঊঊউ শি'জ আ লিটল রান আওয়ে,ড্যাডি'স গাল লার্নস টু ফাস্ট অল দ্য থিংস হি কুডন'ট সে"। তা বটে,এখনকার পোলাপান আর ড্যাডি'স গাল কি মামি'স গুডি বয় নেই,না বলতেই কিভাবে যেন বড় বেশি তাড়াতাড়ি সব শিখে যায়,হাতে মোবাইল কানে ইয়ারফোন মুখে ওউ সো ফানি সো কিউট হোয়াসসাপ ডুড। কালকে সন্ধ্যায় মৌচাক মোড়ে গোটা দুই চিড়িয়া দেখেছিলাম মনে পড়লো,ওদিকটায় আলোর একটু স্বল্পতা আছে,প্রথম দর্শনে ভেবেছিলাম চিড়িয়াখানার দু'টো বাঁদর ভেগেছে নির্ঘাত,পরে বোঝা গেল,পাংক কালচার এদেশেও চলে এসেছে,বন জোভির গানের প্রতিভা না পাক,সাজের প্রতিভা পেয়েছে এরা। স্কিনটাইট শার্ট আর হাঁটু পর্যন্ত গোটানো জিন্স আর রংচঙে চুল,সাথে হেভি মেকআপ,ড্যাডি'স গাল দের দেখলে কি ড্যাডিরা আজকাল ভির্মি খায়না? দিন বদলেছে ঠিকই। বসে থেকে পিঠ ধরে গেছে।

উঠে পড়ি,মুরগির খোপটার মাঝে হাঁটাও মুশকিল,৫ বছরের কাগজপত্র সিডি পিসি প্রিন্টার জামাকাপড় তারছেঁড়া গিটার সব কিছুর ভিড়ে বইগুলো সব খাটের নিচে চালান করে দিয়েছি,গোছানো দরকার,ভাবছি ৪ মাস ধরে,ভেবেই যাব মনে হচ্ছে। আই অভ দ্য টাইগারের তালে তালে বাতাসে গিটার বাজাই চেয়ারে পা তুলে কিছুক্ষণ,সুইট চাইল্ড ও মাইন বলে চিঁ চিঁ করি আরো খানিক,স্ল্যাশের মত গিটারিস্ট হব ভেবেছিলাম একবার, কিন্তু যন্ত্রটার কারিগরিই আর শেখা হল না এ জীবনে,এক তার ছিঁড়ে পড়ে আছে এক কোণে। ওহে সুইট চাইল্ড,আমাদের একটা বাঘের চোখ বড় দরকার,কোথায় পাব? কতদূরে? হাউ মেনি সিজ মাস্ট আ হোয়াইট ডাভ সেইল,বিফোর শি স্লিপস ইন দ্য স্যান্ড? কবে শান্তিতে ঘুমাবো? বব ডিলান উদাত্ত কণ্ঠে যতই বলুন দ্য অ্যানসার মাই ফ্রেন্ড ইজ ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড,আকাশ বাতাস হাতড়ে জবাব তো পাই না। ভ্যান হেলেনের সাথে তাই লাফাই,জাম্প জাম্প,হেহেহে জাম্প,যেমন লাফায় আমার জাতভাই বাঙ্গালিরা তারেকের বউয়ের সাথে,হাসিনার পুত্রবধুর সাথে,ফুলের মালা গলায় দিয়ে তারেক আর হাসিনা জেল থেকে বের হয়ে ধবধবে বিদেশি হাসপাতালে কান আর হাঁটু মালিশ করাতে করাতে বেকুব বাঙ্গালির বাঁদর নাচ দেখে হাততালি দেয়,জাম্প জাম্প জাম্প জাম্প জাম্প,হেহেহে জাম্প। পাশের বাসার খোলা ছাদ থেকে একটা পিচ্চি অবাক চোখে চেয়ে আছে দেখে লাফানো থামাই,জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে হাতছানি দিই।

পছন্দ হয়না,মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। আরামে আছ বাবা,বড় হও,বুঝবে দুনিয়ার কি ঠেলা,দুপুর রোদে ঘোরাঘুরির দিন আমাদেরো ছিল। টিল দ্য অ্যান্ঞ্জেলস কাম,এন আস্ক মি টু ফ্লাই,ওয়ানা বি এইটিন টিল আই ডাই। অ্যাডামসের সাথে গলা ফাটিয়ে আবার চিৎকার করি,এইটিন টিল আই ডাই,বড় তাড়াতাড়ি মনের বয়সটা বেড়ে যাচ্ছে। কত কিছু বাকি রয়ে গেল,করার,দেখার।

সবকিছু থেকে ছুটি নিয়ে বের হয়ে যাব নাকি কিছুদিনের জন্য? পদব্রজে বিশ্বভ্রমণ না হোক দেশভ্রমণ টাইপ? পকেট যদিও খালি,কোনভাবে ম্যানেজ করা যাবে না? রাতের ট্রেনে উঠে কোন স্টেশনে নেমে হাঁটা ধরলাম দু'দিনের জন্য? বান্দরবন আর খাগড়াছড়িটা দেখা বাকি রয়ে গেছে,একবার হলেও তাজিংডংয়ের চূড়ায় ওঠা দরকার, জীবনের চূড়ায় না উঠি পাহাড়ের চূড়াটা ছুঁয়ে তো দেখি। শেষবার কক্সবাজার গিয়ে ভেবেছিলাম এরপর এলে আর কোথাও ছোটাছুটি না,৩ দিন আরাম করে সৈকতে ঝিমাবো,সেটাও করা হল না এখনো। আজ পালাবো কাল পালাবো করে কোথাও কোনভাবে আটকেই যাই খালি খালি, শুধু পরিকল্পনার পরী উড়ে যায় কল্পনার বনে,বন জোভি স্পিকারে চিৎকার করেন, মাই হার্ট ইজ লাইক অ্যান ওপিন হাইওয়ে,লাইক ফ্র্যাঙ্কি সেইড আই ডিড ইট মাই ওয়ে,কিন্তু যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণও বেঁচে থাকা হয় না আমার। ইট'স মাই লাইফ,কিন্তু আমার মত করে আর হয়ে ওঠা হয়না এখনো, ফ্র্যাঙ্কির মত বেপরোয়া কণ্ঠে বলাও হয়ে ওঠেনা কখনো,জীবনটা শুধুই হয়ে থাকে কার্নিভ্যাল অভ রাস্ট।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।