জীবন যখন যেখানে যেমন
বগুড়ায় থাকা অবস্থায় একবার পাবনা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আমার হাজবেন্ডের অফিসের কলিগ (নাম জুয়েল ভাই) তার বাড়ি ছিল পাবনা জেলায়। সে বগুড়া অফিসের সবাইকে (সবাই বলতে মোট ১০ জনকে) তার পাবনার বাসায় একদিন দাওয়াত করেছিলেন। সেইদিন সকাল সকাল আমরা সবাই অফিসে জড়ো হলাম। সেখান থেকে অফিসের জীপ নিয়ে রওনা দিলাম পাবনার উদ্দেশ্যে।
বেশ সুন্দর আমাদের উত্তরবঙ্গের রাস্তাগুলো। প্রাকৃতিক দৃশ্যে মনোরম চারিদিক, রাস্তার ধারে সারি সারি লাল কৃষ্ণচূড়ার গাছে ফুল ফুটে আছে থোকা থোকা, অসম্ভব সুন্দর লাগলো সেটা। যাওয়ার পথে রাস্তায় পড়লো "চলন বিল", সেটা মনে হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল। তার পাশে গাড়ি থামিয়ে আমরা টুকটাক কিছু খেয়ে নিলাম, বিলের ধারে নেমে হাঁটাহাঁটি করতে অনেক অনেক ভাল লেগেছিল। তারপরে আবার রওনা দিলাম, বেশ অনেকটা সময় পরে আমরা পাবনাতে পৌঁছালাম, আমাদেরকে বাসা চিনিয়ে নেয়ার জন্য উনি একটা জায়গাতে অপেক্ষা করছিলেন।
আমরা তার সাথে বাসায় গেলাম তখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। আমাদের ইচ্ছা ছিল খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে পাবনা শহরটা একটু দেখবো, কিন্তু যেতে যেতে অনেক সময় লেগেছিল আবার রাতের মধ্যেই বগুড়া ফিরতে হবে তাই সেই ইচ্ছাটা আর পূরণ হয়নি। তবে তাদের বাসার খাওয়া দাওয়া যা ছিল এখনো মুখে লেগে আছে তার স্বাদ... খালাম্মার (মানে উনার মার) হাতের রান্না আসলেও অসাধারণ ছিল।
তাড়াতাড়ি খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমরা বললাম এতদূর এসেছি যখন কিছু একটা জায়গা না দেখে আমরা যেতে পারি না। তো সবাই আস্তে ধীরে ঠিক করলাম পাবনার "হেমায়েতপুর মেন্টাল হসপিটাল" টাই না হয় দেখবো।
জুয়েল ভাইও বললো আচ্ছা তবে সন্ধ্যা হয়ে আসছে যেতে হলে তাড়াতাড়ি তানা হলে হসপিটালের ভেতরে ঢুকতে নাও দিতে পারে। সবাই মিলে গেলাম সেখানে, তবে সন্ধ্যা হয়েই গেছিল যখন গেলাম। তাই আমরা ভেতরে পুরাটা ঘুরে দেখতে পারিনি, ছবিও তুলতে পারিনি। কিছু অংশ দেখলাম তারা কিভাবে এই অসহায় মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষদের রেখেছে। জেলখানার মত গ্রীল দিয়ে বন্দি সবাই।
একেকটা বড় ঘরের মত তার ভেতরে বেশ কয়েকজন করে আছে। ভেতরে কোন কোন ঘরে টেলিভিশন আছে, কিছু কিছু সুবিধাও মনে হয় আছে কিন্তু সব ঘরে একই রকম না, মনে হয় কোনো নিয়ম আছে যার জন্য অনেক সুবিধাই নাই সব ঘরে। আমরা কাছে যেতেই কয়েকজন গ্রীলের কাছে এসে দাড়ালো, খারাপ লাগলো তাদেরকে দেখে, আমরাও মানুষ তারাও মানুষ অথচ বাস্তবতার কি নির্মম পরিহাস, তাদের কে এইভাবে চিড়িয়াখানার পশুদের মত গ্রীলের ভেতরে থাকতে হচ্ছে আর আমাদের মত মানুষেরা তাদের দেখার জন্য বাইরে ভীড় করছি। যাইহোক আমাদেরকে দেখে ভেতরের মানুষেরা অনেক খুশিই হচ্ছিল আমরা তাদেরকে দেখতে এসেছি তাই ভেবে। আমাদের সাথের কয়েকজন কলিগ ভেতরের বন্দি মানুষ গুলোর সাথে কথাও বললো (দূর থেকে যদিও)।
ভেতরের একজন গান গাওয়ার চেষ্টা করছিল আমাদেরকে দেখে, আমাদের মধ্যে থেকে একজন তাকে বললো একটা গান শোনান। বন্দি মানুষটি বললো গিটার নাই তো কিভাবে শোনাবো, কলিগ বললেন গিটার লাগবে না এমনি শোনান, সে গান ধরলো...শিল্পি আমি তোমাদেরই গান শোনাবো, তোমাদেরই মন ভরাবো। সে গান গেয়েই যাচ্ছে থামতে বলাতেও থামেনি পরে আমরা চলে এসেছি। আরেক ঘরের দিকে গেলাম দেখলাম সেখানে মেয়েরা আছে...কেউ কেউ লাল লিপিস্টিক, লাল ফিতা দিয়ে সেজে আছে। আমরা যাওয়াতে তারাও কয়েকজন গ্রীলের কাছে এসে দাড়ালো।
একজন কি যেন বলার চেষ্টা করছিল আমাকে, আমি ওর কথা বুঝছিলাম না। কি কি সব যেন বলছিল, আমিও দূর থেকেই আচ্ছা, হ্যা এইসব বলে কিছুক্ষণ পরে চলে এসেছিলাম, যদিও তার কথা বলা থামেনি তখনও। আমরা কিছুক্ষণ ভেতরে থেকে একসময় বের হয়ে গেলাম, দিনে বেলায় গেলে হয়ত আরো ভেতরে যেয়ে পুরা হসপিটালটা দেখা যেত রাতের বেলায় ঢুকতে দেয়া হয়না সব জায়গায়।
হসপিটালটা দেখে আমরা বগুড়ায় ফেরত আসার জন্য আবার জীপে চড়ে বসলাম। আর পেছনে ফেলে আসলাম মানুসিক বিকারগ্রস্থ কিছু অসহায় মানুষদের, যাদের কিছু কিছু মুখ আজও আমার মনে পড়ে।
পাবনায় কাটানো এই একটা দিন স্মৃতির পাতায় চির অম্লান হয়ে থেকে গেছে আমার কাছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।