সরকারি তহবিলের গরিবের টাকা খরচ করে জনতা ব্যাংক লিমিটেড খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এমন একটা নিম্নমানের বিকৃত ইতিহাস রচনার প্রয়াস পেয়েছে, যা ভাবীকালে পাকিস্তানকে পাক, মুক্তিযোদ্ধাদের নাপাক করার প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হবে। জনাব অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতকে একজন রুচিবান, বিদ্বান, পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবেই এতদিন জানতাম। কিন্তু তার তত্ত্বাবধানে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, জাতির শ্রেষ্ঠ বীর, দেশের সূর্যসন্তান খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে সম্মাননার নামে অসম্মানের ব্যবস্থা মোটেই কাজের কাজ হয়নি। যে কোন লগ্নি প্রতিষ্ঠানের কাজ শ্রম, ঘাম ও রক্ত শোষণ। তাদের কাজ কাউকে সম্মান দেখানো নয়, সম্মান করাও নয়।
কিভাবে মানুষকে সম্মান করতে হয় তা তারা জানে না। কোন অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের জানার কথাও নয়। সেখানে স্বাধীনতাযুদ্ধের সোনালি দিনের গর্বিত খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানো সে তো আরও কঠিন কাজ, কোন হেলাফেলার ব্যাপার নয়। দলকানা লোকেরা যে কত বেপরোয়া হতে পারে জনতা ব্যাংকের এই সম্মাননার আগে কল্পনাও করিনি। চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতকে তেমন না জানলেও প্রতিষ্ঠানের সিইও এসএম আমিনুর রহমানকে বহু বছর ধরে জানি।
যখন যেভাবে পেয়েছি ভীষণ সম্মান দেখিয়েছেন, কথা শুনেছেন- এখনও শোনেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মিঠামইনের এক দরিদ্র ঋণীর বহু দিনের ঋণ একদিনে সমাধান করে দিয়েছিলেন। অমন একজন সজ্জন ভাল মানুষ থাকতেও বাজার থেকে কেনা পুঁটি মাছ যেমন কেউ বাড়ি পাঠায়, তেমন করে একখানা ক্রেস্ট পাঠিয়েছিলেন কেন? কিছুই বুঝতে পারলাম না। বড় ব্যথিত ও বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে ক্রেস্টটি ফেরত পাঠিয়েছি। ওটা রেখে দিতে বলেছি।
একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ করে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে কিভাবে সম্মানের সঙ্গে সম্মাননা ক্রেস্ট পাঠাতে বা দিতে হয় ওটা চোখের সামনে থাকলে মনে করতে পারবেন। সরকারি পয়সায় এ কাজ যারা করেছেন তারা পায়ের ওপর পা তুলে নানা মঞ্চে বসেছেন। যারা রক্ত, ঘাম ঢেলে দেশ স্বাধীন করে দুর্ঘটনার মতো এখনও বেঁচে আছে, আর যারা নেই, তাদের পরিবার-পরিজন চাকর-বাকরের মতো নিচে বসে তাদের কথা শুনেছে। আজ আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে কিছু গরিব শ্রেষ্ঠ সন্তানের তালিকা করে চেক হস্তান্তর করা হবে। জনতা ব্যাংকের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ কাজটি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের শুধুই ছোট করার নামান্তর ছাড়া আর কিছু হয়নি।
২৪৩ পৃষ্ঠায় শফিক ইমাম রুমির একটা ছোট্ট অভিযানের কথা উল্লেখ করে পুরো পাতা খরচ করেছে। অথচ ২৪১ পৃষ্ঠায় আবদুস সবুর খান বীর বিক্রমের বেশ কয়টা অভিযানের কথা উল্লেখ করেও আধা পাতা খরচ করেনি। আবদুস সবুর খান বীর বিক্রম প্রায় ৭০-৮০টা যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছেন। কার কাছে শুনে ওইভাবে দু’-একটা রাজাকার, মিলিশিয়া গ্রেপ্তারের গল্প ফেঁদেছে তা তারাই জানে। লেখাপড়া জানা কলমবাজরা অনেক কিছু করতে পারে, যা গ্রামগঞ্জের গরিবরা পারে না।
রুমীর মা শহীদ জননী। আর যে মায়ের ঘর পুড়েছে, বাড়ি পুড়েছে, স্বামীসহ ছেলে মরেছে, মেয়ের ইজ্জত গেছে সে কি শহীদ ঝি? ২৫শে আগস্ট অভিযান করে ২৯শে আগস্ট রুমী ধরা পড়ে, তা দেখে ১৩ই ডিসেম্বর তার বাবা মারা যান। তার বাবা-মা দু’জনই তখনও পাকিস্তান সরকারের চাকুরে ছিলেন, বেতন পেতেন। ছেলে গ্রেপ্তারের ৫ মাস পর শোকে মারা গেছেন। ব্যাপারটা খুবই দুঃখের।
কিন্তু গ্রাম-বাংলার শ’ শ’ মুক্তিযোদ্ধার বাড়িঘর, বাপ-মা, ভাইবোনসহ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে- কেউ বাঁচেনি, তাদের বেলায় কি হবে? তাদের পায়ে দললে ওইসব কেতাবি জননীদের সম্মান করবে? কেউ করবে না। এসব বলায় প্রচুর সমালোচনা হবে জানি। বয়স হয়েছে তাই সমালোচনার ভয়ে আত্মাকে কলুষিত করতে চাই না।
স্মারক গ্রন্থে ১৫৭ পৃষ্ঠায় শহীদ হাবিলদার রফিকুল ইসলাম বীর বিক্রমের যুদ্ধ সম্পর্কে পোয়া পৃষ্ঠা লিখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘২৫শে মার্চ নিরীহ বাঙালিদের পাকিস্তানিরা হত্যা শুরু করলে দেশের মানুষকে রক্ষার তাগিদে তিনি মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন।
তার দুঃসাহসিকতার জন্য ঢাকার পূর্বাঞ্চল অনেক সহজেই মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে। তিনি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতীতে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। ’ কোন বাহিনীর লোকের নিজের থেকে করার কিছু থাকে না। তার ব্যাটালিয়ন যুদ্ধে গেছে, দলের সঙ্গে তিনিও গেছেন। সেখানে তার কোন বিশেষ ভূমিকা থাকার সুযোগ কই? আর শহীদ হাবিলদার রফিকুল ইসলাম বীর বিক্রম কালিহাতীতে গেলেন কি করে? তার দল ছিল আগরতলা।
আগরতলা আর চকির তলা তো এক নয়। কালিহাতী আর আগরতলা বহুদূর। এখনও একদিনের পথ। যুদ্ধের সময় রাস্তাঘাট ছিল না। তা ছাড়া পাকিস্তান হানাদাররা শিয়াল ছিল না।
কলমের ডগায় অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু বাস্তবে করা যায় না। কালিহাতী ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। যুদ্ধবিগ্রহ যা হওয়ার সবই হয়েছে কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে। এখনকার মতো তখন যা খুশি তা করা বা ইচ্ছামতো ফুটানি করার উপায় ছিল না।
জাতির কি চরম দুর্ভাগ্য, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ করে হানাদাররা হলো পাক আর মুক্তিযোদ্ধারা নাপাক।
রফিকুল ইসলাম বীর বিক্রমের বয়ানটি সম্পূর্ণই অসত্য, বিভ্রান্তিকর, মুক্তিযুদ্ধের এক চরম ইতিহাস বিকৃতি। ৬৪১ পৃষ্ঠার সাঈদুর রহমান বীর প্রতীক কাদেরিয়া বাহিনীতে ছিল। আমার সুপারিশে খেতাব পেয়েছে, তাকে দিয়ে কালিহাতীতে ১২ই জুন যুদ্ধ করিয়েছে। ১২ই জুন কালিহাতীতে কোন যুদ্ধই হয়নি। এমন বিকৃতির কোন প্রয়োজন ছিল না।
শফিউল্লাহ সেই সময় একজন মেজর ছিলেন। তার নামে ২৬-২৭শ’ জনবলের একটি ব্রিগেড ছিল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তেমন বীরত্ব দেখাতে পারেননি। ঢাকার পূর্বাঞ্চল কালিহাতী নয়, কালিহাতী ঢাকার উত্তরাঞ্চল। সফিউল্লাহর নেতৃত্বে একজনও ডিসেম্বরের আগে ঢাকার বাতাস পায়নি। বিজয়ের এক-দু’দিন আগে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে শফিউল্লাহর ব্রিগেড আখাউড়া থেকে ভৈরব হয়ে ঢাকার পূর্বে রূপগঞ্জের কাছাকাছি শীতলক্ষ্যার পাড়ে আসে।
এরপর একসময়ের পাকিস্তানি মেজর যুদ্ধ শুরুতে যেমন, শেষেও তেমন পাকিস্তানি গাড়িতে করে একা এতিমের মতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজির হন। কথাটা আমার নয়, কথাটা ভদ্রলোকের নিজের। বুঝতে পারলাম না ভদ্রলোককে কেন এত মাথায় তোলার চেষ্টা হলো? যা ছিলেন তা থাকলেই তো ভাল হতো। মেজর শফিউল্লাহ সম্পর্কে জনতা ব্যাংকের স্মারক গ্রন্থ থেকে তুলে দিচ্ছি, ‘২৮শে মার্চ সকাল ১০টায় জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করেন। জয়দেবপুর চৌরাস্তায় পৌঁছে তিনি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং কনভয় নিয়ে টাঙ্গাইল মুক্তাগাছা হয়ে ২৯শে মার্চ ময়মনসিংহ পৌঁছান।
তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে এমএনএ সৈয়দ আবদুস সুলতানকে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন যোগানোর জন্য দিল্লি পাঠানোর বন্দোবস্ত করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক ঢাকা আক্রমণের লক্ষ্যে তিনি সাড়ে তিন হাজার সৈন্যের বাহিনী সংগঠিত করে বিভিন্ন স্থানে সৈন্য পাঠান। কিন্তু খালেদ মোশারফের অনুরোধে সে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। এ সময় তার বাহিনী বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১লা এপ্রিল টাঙ্গাইলের রাস্তায় অ্যাম্বুস করে পাকবাহিনী ৬ গাড়িভর্তি সৈন্য হত্যা ও ২রা এপ্রিল নরসিংদীর পাঁচদোনায় অ্যাম্বুস করে ৪০০-৫০০ পাক সেনা হতাহতসহ ২০-২৫টি গাড়ি ধ্বংস করে দেয় তার বাহিনী।
’ এইটুকু নিয়েই আলোচনা করি। শফিউল্লাহ যখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন হয়তো নিজের অর্থে একটি সাক্ষাৎকার ছেপে বুকলেট আকারে প্রচার করেন। তার কপি এখনও আমার কাছে আছে। সেখানে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ২৭ তারিখ পর্যন্ত ঢাকার কোন খবর জানতেন না। পালিয়ে যাওয়া কোন সৈন্যের কাছ থেকে প্রথম খবর পান।
তারপর ২৮ তারিখ জয়দেবপুর রাজবাড়ী থেকে দু’টা কোম্পানি নিয়ে প্রথমে টাঙ্গাইল তারপর ময়মনসিংহে যান। জয়দেপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত এসে বহরে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিলেন- এটা স্মারক গ্রন্থেই বলা, আমার বলার দরকার নেই। আমার বলার দরকার, তিনি ২৮ তারিখ জয়দেপুর থেকে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছান। তাহলে তিনি বা তার দল ১লা এপ্রিল টাঙ্গাইলের রাস্তায় অ্যাম্বুস করেন কি করে? আবার ২রা এপ্রিল নরসিংদীর পাঁচদোনায় অ্যাম্বুস করে ৪০০-৫০০ হানাদার হত্যা করেন। আসলে যুদ্ধে কোন যোদ্ধা কোন সৈন্য হত্যা করে না।
হত্যা একটা গুরুতর অপরাধ, স্বাভাবিক সময় যেমন যুদ্ধক্ষেত্রেও তেমনি। যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ মারা যায়, ধরা পড়লে তাদের সেবা করতে হয়, আহতকে চিকিৎসা করতে হয়। জানি না ২রা এপ্রিল পাঁচদোনায় কোন যুদ্ধ হয়েছিল কিনা বা পাকিস্তান হানাদাররা অ্যাম্বুসে পড়েছিল কিনা? পড়ে থাকলে তার দলিল-দস্তাবেজও পাওয়া যাবে। তবে অ্যাম্বুসে ৪০০-৫০০ সৈন্য মারা যাওয়া এটা তাজমহল নির্মাণের চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার। ট্রেনিংপ্রাপ্ত কোন সশস্ত্র বাহিনী কোন অ্যাম্বুসে একসঙ্গে ৪০০-৫০০ মরতে পারে না।
যতখানি এলাকায় অ্যাম্বুস হয় তাতে কয়টা সৈন্য থাকে? ১০, ২০, ৫০-এর বেশি নয়। ৫০০ সৈন্য মারা মানে একটা ব্যাটালিয়ান ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ব্যাপারটা খুব সহজ নয়, লেখা যত সহজ। কোন সামরিক বাহিনী কচুগাছ নয়। কচুগাছ কাটতেও সময় লাগে।
একটা অ্যাম্বুসে বড়জোর ২-৩ মিনিটের জন্য শত্রুকে বেকায়দায় রাখা যায়। তারপর তারাও অবস্থান নিয়ে নেয়। তখন আর অ্যাম্বুস থাকে না, যুদ্ধ শুরু হয়। এতো দেখছি ৪০০-৫০০ সৈন্যকে কচুগাছ কাটার চেয়ে সহজে মেরে ফেলা। ১ তারিখ টাঙ্গাইল, ২ তারিখে নরসিংদীর পাঁচদোনা হেলিকপ্টারে যেতেও অসুবিধা হবে।
কারণ আকাশপথও নিরাপদ ছিল না। তবে কেমন অলৌকিভাবে মেজর শফিউল্লাহর সৈন্যরা সেখানে পৌঁছেছিল? টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ সেখান থেকে ভৈরব তারপর নরসিংদীর পাঁচদোনা- আজকের পথ? স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এত রাস্তাঘাট হয়েছে তারপরও ৪০-৫০টি গাড়ি নিয়ে একদিনে টাঙ্গাইল থেকে নরসিংদীর পাঁচদোনা পৌঁছা যাবে না। আর তখন তো রাস্তাঘাটই ছিল না। শত্রুকবলিত দেশ খোঁজখবর নিয়ে ধীরে ধীরে চলতে হতো। তাই ব্যাপারটা খুব একটা স্বাভাবিক নয়।
১লা এপ্রিল টাঙ্গাইলের রাস্তায় কোন হানাদার পাকিস্তানি ছিল না। হানাদাররা টাঙ্গাইলের দিকে পা বাড়িয়েছে ৩রা এপ্রিল। সেদিন আমাদের সঙ্গে হানাদারদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। নরসিংদী পাঁচদোনায় কি কোন সেনা ছাউনি ছিল? তা না থাকলে পাকিস্তান হানাদাররা পাঁচদোনায় যাবে কি করে? তাদেরও মাজা সোজা করে দাঁড়াতে প্রাথমিক অবস্থায় দু’চার দিন সময় লেগেছে। তারাও খুব নিরাপদ ছিল না।
কেন এসব তথ্য সংগ্রহ করা হলো বুঝতে পারি না। তা ছাড়া ময়মনসিংহের এমএনএ সৈয়দ আবদুস সুলতানকে সমর্থন পাওয়ার আশায় দিল্লি পাঠানোর ব্যবস্থা করা এটা ঔদ্ধত্য ছাড়া কিছু না। তিনি তখন যে মর্যাদার ছিলেন তাতে দিল্লি পাঠাবেন কি করে? পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কারও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় ছিল না। পাকিস্তান আর ভারত ছিল চির শত্রু। আর সৈয়দ আবদুস সুলতান একজন খুবই বিদ্বান বুদ্ধিমান পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন।
স্বাধীনতার পর ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ওই রকম মানুষকে কূটনৈতিক মিশনে তিনি পাঠানোর কে? জনতা ব্যাংক লিমিটেড কেন এমন একটা অপ্রচ্ছন্ন কাজ করতে গেল কিছুই ভেবে পাই না।
এবার নিজেদের প্রসঙ্গে আসি, কাদেরিয়া বাহিনী প্রসঙ্গে, গেজেটে আমার ক্রমিক দেয়া হয়েছে ৭৫। ৭৫ নম্বর ক্রমিকে আমাকে কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বীর-উত্তমের গেজেটে আমার নম্বর ৬৮।
জীবিত-মৃত খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বীরশ্রেষ্ঠ-৭, বীর-উত্তম-৬৮, বীর বিক্রম-১৭৫, বীর প্রতীক-৪২৬। তাদের লেখা থেকে সামান্য তুলে ধরছি, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে টাঙ্গাইল সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ’৭১ সালের মার্চ মাসে সরকারি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন। এ সময় তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে পাকবাহিনী। সামান্য কিছু অস্ত্র আর কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে উদার চিন্তা-চেতনা, অকল্পনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা, দৃঢ় মনোবল, অদম্য সাহস আর নিজ নেতৃত্বগুণে অতি অল্প সময়ে গড়ে তোলেন ৩০ হাজার সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী আর ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সংবলিত বিশাল বাহিনী। শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার।
এই বাহিনী পরবর্তীকালে কাদেরিয়া বাহিনী নামে খ্যাতি লাভ করে। সীমান্তের অপর পাড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে নয়, বরং হানাদার বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ঢাকার মাত্র ৪০ মাইলের মধ্যে সার্বক্ষণিক শত্রু পরিবেষ্টিত এলাকায় অবস্থান করে অসংখ্য সফল যুদ্ধ পরিচালনা করে বিপুলসংখ্যক পাক সেনা হত্যা করে তার বাহিনী। শুধু গেরিলা আক্রমণই নয়, তার বাহিনীর পাকবাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংখ্যক সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। একের পর এক যুদ্ধে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে তিনি ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও ঢাকা জেলার বিশাল এলাকা মুক্ত করতে সক্ষম হন। ভূঞাপুরে পাকবাহিনীর অস্ত্রবোঝাই জাহাজ আয়ত্তে নিয়ে তিনি বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ দখল করেন।
তিনি বল্লা গ্রামসংলগ্ন মারকার যুদ্ধে আহত হন। ’
স্মারক গ্রন্থে কাদেরিয়া বাহিনীর বহু প্রশংসা করা হয়েছে। আমি বল্লার কাছে মারকার যুদ্ধে নয়, ধলাপাড়ার মাকরাইয়ের সম্মুখ যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছিলাম। বাঁচবো তার আশাই ছিল না। একজন বীর উত্তম, ৩ জন বীর-বিক্রম, ১৩ জন বীর প্রতীকসহ কাদেরিয়া বাহিনী ১৭টি বীরত্বসূচক খেতাব পেয়েছে।
বলা হয়েছে, ৩০ হাজার সশস্ত্র ও ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সংগঠিত করে আমরা হানাদারদের মোকাবিলা করেছি। আমরা হানাদারদের মোকাবিলা করেছি ঠিকই। ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সেটাও সঠিক। কিন্তু সশস্ত্র যোদ্ধা ছিল ১৮ হাজার। আমাদের ক্ষেত্রে বেশি বলা হয়েছে বলে খুশি হবো, অন্যদের ক্ষেত্রে কমও তো হতে পারে।
স্মারকেই বলা হয়েছে, ‘ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ঢাকার বিশাল এলাকা মুক্ত করতে সক্ষম হন। ’ আমাদের যুদ্ধ এলাকা ছিল ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের কিছু অংশ। মুক্তিযুদ্ধে আর কারও দলে এত বিপুল মুক্তিযোদ্ধা ও এত বিস্তীর্ণ এলাকা দখলে ছিল না। তার পরও সেক্টর কমান্ডারদের যে বয়ান দেয়া হয়েছে সেখানে কাদেরিয়া বাহিনীর উল্লেখ নেই। আমরা যেন একেবারেই ভাসা পানা।
সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের জায়গা আছে কিন্তু কাদেরিয়া বাহিনী বা আমার কোন জায়গা নেই। যতটা সম্ভব সঠিক হলে বলার কিছুই থাকতো না। কিন্তু শুদ্ধের চেয়ে ভুলের সংখ্যাই বেশি দেখেছি। তাই না বলে পারলাম না। অনেক বছর চুপ থেকেছি।
এখন যাওয়ার পালা। তাই আর কতকাল চুপ করে থাকবো?
সম্মাননা স্মারকে আরও অনেক ইচ্ছাস্বাধীন ইতিহাস বিকৃতি আছে। সরকার বদল হলে অবশ্যই এ প্রকল্পে কত টাকা খরচ হয়েছে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব নেয়া হবে। অসংযত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ ধরনের অপচেষ্টার সঙ্গে জড়িতরা ভাবীকালের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হবেন। টাকা হলেই ইতিহাস রচনা করা যায় না।
বই ছেপে বাজারে বিক্রি করা যেতে পারে কিন্তু সেটা ইতিহাস হয় না, হয় ইতিহাস বিকৃতি।
স্মারকটির নাম দেয়া হয়েছে, ‘একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাথা খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা স্মারক গ্রন্থ’। ৭১-এ কেউ বীর আর কেউ ভীরু ছিল না। ’৭১-এ যারা যুদ্ধ করেছে তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। যোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধা এক নয়।
কথাটা আমরা মূর্খরা না বুঝতে পারি। কিন্তু জ্ঞানপাপী, বিদ্বানরা না বুঝলে সেটা বড়ই দুঃখের। কিতাবের ৮ পৃষ্ঠায় পণ্ডিতি করে হিসাব দিয়েছে সাধারণ বাঙালি বীর উত্তম ৬ জন। অথচ ’৭৩ সালের গেজেটে গণ বলতে সাধারণ বাঙালি মাত্র একজন। বাকিদের সবার নামের আগে পরে কোন না কোন পদবি আছে।
১০ পৃষ্ঠায় দেখিয়েছে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা দু’বার খেতাব পেয়েছেন। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়ে একবারও পেলো না, পণ্ডিতদের কলমে এখন অনেকে দু’বার পাচ্ছেন। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে দু’বার খেতাব পেতে সে ধরনের বড়সড় কাজ তো দেখতে হবে। আসলে জ্ঞানপাপী কর্মকর্তারা বড় বেসামাল। আদতে কেউ কোন কাজ করে দু’তিনবার খেতাব পায়নি, তেমন বিশেষ কাজও তারা করেননি।
তালিকা করতে গিয়ে এক নাম অসাবধানে দু’বার লিখেছেন।
ময়মনসিংহের প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান তুরার ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। ওই অঞ্চলের আর কোন রাজনৈতিক নেতা মুক্তিযুদ্ধে অতটা সক্রিয় সময় ব্যয় করেনি। লক্ষাধিক ছাত্র-যুবক তার ক্যাম্পে থেকে নানা শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছে। স্বাধীনতার পর ২০০৪-০৫ সাল পর্যন্ত শুনে এলাম প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান বীর প্রতীক।
এখন শুনছি প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান কোন বীরপ্রতীক-টতিক না। জামালপুরের ইপিআরের সিপাই মতিউর রহমান বীর প্রতীক। সেক্টর ভাগ করতে গিয়ে কিশোরগঞ্জ বাদে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেটের সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম ১১ নম্বর সেক্টর দেখিয়েছে। সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর আবু তাহের, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ এরা কেউ মুক্তিযুদ্ধের সময় কখনও ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণে পা রাখেননি। জিয়াউর রহমানকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল সিলেট, মেজর আবু তাহের কামালপুরে যুদ্ধে আহত হন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ ভারতের সীমানা থেকে বাংলাদেশে পা রাখেননি।
খুঁজলে ইতিহাসের কোথাও টাঙ্গাইলকে ১১ নম্বর সেক্টরে পাওয়া যাবে না। একজন শিক্ষক মানুষ, অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে স্বাধীনতার ৪২ বছর পর নতুন বিকৃত ইতিহাস সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। কি কারণে তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। যেমনি দলকানা অধ্যাপক জনাব মুনতাসীর মামুন ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধের খণ্ড দলিলপত্র গ্রন্থের ৪৭ পৃষ্ঠায় এক অঙ্গীকারনামা তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছেন, আনোয়ারুল আলম শহীদের নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের মুক্তাঞ্চলে এক বেসামরিক প্রশাসন গড়ে ওঠে। তার অধীনে কাদের সিদ্দিকী যুদ্ধ করেন।
রাজাকারের বেটা ভাইস্তারা কতটা জ্ঞানপাপী হলে স্বাধীনতার এত বছর পরও এমন লিখতে পারেন! মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ১৯৭১ সালে, যুদ্ধ জয়ের পর ’৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর পদতলে লক্ষাধিক অস্ত্র জমা দিয়েছি। কাদের সিদ্দিকীর নামে কাদেরিয়া বাহিনী হয়েছে। অথচ আনোয়ারুল আলম শহীদের অধীনে কাদের সিদ্দিকী যুদ্ধ করেছে? কাদের সিদ্দিকী একমাত্র বাঙালি বীর উত্তম, আনোয়ারুল আলম শহীদ অধমও নন। যে শহীদকে ভূঞাপুর থেকে জুলাই মাসে আন্ধিতে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করতে বসানো হয়েছিল, ধীরে ধীরে একটি বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তুলে দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধ শেষে রক্ষী বাহিনীতে পাঠানো হয়।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর খুনিদের প্রতি প্রথম সমর্থন জানিয়েছিল। এখন আমাকে ছোট করতে দলকানা জ্ঞানপাপীরা তাদের মতো করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছেন। আমাকে অপছন্দ করে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ছবি বাদ দিতে গিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে তাকেই বাদ দেয়া হচ্ছে। জনতা ব্যাংকের এ প্রচেষ্টায় অবশ্যই কোন না কোন উদ্দেশ্য আছে। না হলে মুক্তিযুদ্ধের মহিমাকে এমন খাটো করবেন কেন? তারা একটা ক্রেস্ট বানিয়েছেন- ডানে পুরুষ বামে নারী, হাতে অস্ত্র।
মুক্তিযুদ্ধে কোন নারী কামান বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করেনি। সে ধরনের পরিবেশ ছিল না। এটা ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া নয়। কাদামাটির দেশে সব কাজ নারীরা করে না, করতে পারে না, তারা প্রেরণা যোগায়। রাইফেল কাঁধে যে যোদ্ধাকে দেখিয়েছে, রাইফেলের বাঁট অত উপরে উঠে না।
বাম হাতের কনুই থাকে কোমর বরাবর। গ্রামগঞ্জের ছোট কোষা যখন ডোবে তখন ওরকম পেছনের দিকে উল্টে পড়ে ডোবে। ক্রেস্টটা দেখে মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের মহিমাকেই উল্টে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এ লেখায় অনেকবার ‘পাকবাহিনী’ লেখা হলো। ওটা আমার নয়, ওটা স্মারক গ্রন্থের।
তাই প্রিয় পাঠক ক্ষমা করবেন।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।