আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

`ঈশ্বরের চোখ' থেকে : কবি রণজিৎ দাশের ১০টি কবিতা



কবি রণজিৎ দাশ, সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান একজন কবি। জন্ম ১৯৪৯ সালে, আসামের শিলচর শহরে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে সেখানেই। ১৯৭১ সাল থেকে কলকাতাবাসী। পৈতৃক নিবাস ঢাকার বিক্রমপুরে।

পেশায় ছিলেন সরকারি আমলা। কিছুদিন আগে চাকরিজীবনের অবসান ঘটেছে। এখন ফুলটাইম কবি। বাংলা কবিতায় রণজিৎ দাশের সংযোজন বেশ মজবুতই বলা চলে। তিনি বেশিরভাগ কবিতায় গল্পচ্ছলে জীবনের অমোঘ জিজ্ঞাসাগুলোকে উন্মোচিত করেন, যেখানে শব্দ ও বাক্যবন্ধ খুবই সহজ মনে হবে, কিন্তু বিষয় ও ভাবের দিক থেকে এগুলো অনেক উচ্চমার্গীয়, দার্শনিক বোধসম্পন্ন।

তাঁর বেশ অনেকগুলো কাব্যগ্রন্থ ও গদ্যগ্রন্থ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তাঁর 'ঈশ্বরের চোখ' কাব্যগ্রন্থটির প্রতি আমার এক ধরনের ভালো লাগা থাকার ফলে এ থেকেই ১০টি কবিতা ব্লগের পাঠকদের জন্য পোস্ট দেওয়া হলো। আপনাদের কেমন লাগলো জানাবেন অবশ্যই। -সফেদ ফরাজী একটি দুঃখের কথা একটি দুঃখের কথা, পথে ও বিপথে ঘুরে, প্রত্যাখ্যাত হতে হতে, গান হয়ে ওঠে। শহরে, চলন্ত ট্রেনে, মন্দিরের পথে শোনা যায় সেই গান- ধুলোমাখা, অন্ধ, মায়াময় যে কোনও গরিব দেশে ভিখারিরা সুগায়ক হয়।

কোথা থেকে আসে সুর, ছেঁড়া-ফ্রক-পড়া এক বেদনার পিছু পিছু, কুকুরছানার মতো, কোথা থেকে আসে? খেলা করে, কোলে ওঠে, শূন্যতা ও বাসি রুটি ভাগ করে খায় তারপর একদিন, রক্তচক্ষু সূর্যের জগতে কারা এসে বেদনাকে তুলে নিয়ে যায় কুকুরছানাটি শুধু শুয়ে থাকে, বোবা চোখে, প্রান্তরের সীমাহীন ঘাসে একটি দুঃখের কথা, পথে ও বিপথে ঘুরে, প্রত্যাখ্যাত হতে হতে, গান হয়ে মিলায় আকাশে কামিনীফুলের গন্ধে কামিনীফুলের গন্ধে সত্য আছে, ছলনাও আছে। প্রবাসে, রাত্রির পথে একা একা, অঝোর বৃষ্টিতে হেঁটেই চলেছি, কোনো রহস্যগল্পের সন্দেহজনক এক চরিত্রের মতো। মাঝে মাঝে পুলিশের টর্চ জ্বলে, ছুটন্ত লরি-র জলকাদা ছিটকে-ওঠা আলো সরে যায়। অজস্র বৃষ্টির ফোঁটা বিশাল মেঘের উড়ন্ত কফিন থেকে লুকোনো মার্বেল হয়ে ঝরে। বাড়ি ফিরব না আর, এই মর্মে, ঝোড়ো বাতাসের পথসঙ্গী হয়ে ঘুরি, তোমার ঘুমের চরাচরে।

যে ঘুম কামিনীগাছ- বিদ্যুৎ-জাগ্রত, একা, অন্ধকারে ভগ্নমনোরথ- রাত্রি যত বাড়ে, তত কামিনীফুলের উগ্র গন্ধে লুপ্ত হয় পৃথিবীর সমস্ত শপথ। ট্রাফিক পুলিশ শহরে যখন কেউ পাগল হয়, তখন সে ট্রাফিক পুলিশ হয়ে যায়। নিজের খেয়ালে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, দিনের পর দিন। নিখুঁত তার হাতের মুদ্রা, অটুট তার গাম্ভীর্য। কেবল তার নিয়ন্ত্রিত গাড়ি-ঘোড়াগুলি সম্পূর্ণ অলীক।

যেসব গাড়ি-ঘোড়া কাউকে চাপা দেয় না, কোনো প্রিয়জনকে বাসস্টপে নামিয়ে দিয়ে যায় না... পানশালা কলম এবং ছাইদানির সঙ্গমের ফলে জন্ম নেয় হাতঘড়ি। বিকেলে, বাড়ি ফিরে, আমি টেবিলের ওপর ফুটফুটে হাতঘড়িটিকে দেখি। টিক টিক করে ঘুরছে তার কাঁটা। ঘুরছে একটি বৃত্তের ভিতর, যার পরিধি ঘিরে রয়েছে বারোটি সময়জ্ঞাপক পানশালা। বস্তুত, পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতাই গড়ে উঠেছে একটি মানুষ সন্ধেবেলা পানশালায় যাবে বলে।

সেখানে গিয়ে, তোমার আধভাঙা গান এবং নক্ষত্রদের জুয়াখেলার কথা ভাববে বলে। অনেক রাতে, তার বাড়ি-ফেরার পথে যদি চাঁদ ও কুয়াশা থাকে, তাহলে সে তোমারই পুরুষ... তাপমান নিজের শরীরে হাত দিয়ে যখন মনে হয় অন্যের শরীরে হাত দিয়েছি, তখন জল এবং পাহাড়িগান ভীষণ বিপজ্জনক। তখন বৃষ্টি মানে, বিষ, বাথরুম মানে বিদ্যুৎচুল্লি। তখন শ্যাম্পু-করা চুলের গন্ধে পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। নিজের শরীরে হাত দিয়ে যখন মনে হয় অন্যের শরীরে হাত দিয়েছি, তখন বাস্তবতার শেষ, তোমার চিঠির শুরু... মদ নারীর ভিতরে ডুবে পুরুষটির মৃত্যু হয়েছিল।

বালির ওপর ছড়িয়ে আছে তার চশমা, বই ও ব্রিফকেস। সে নেই, কিন্তু একটা পড়ে-থাকা শূন্য কাঁচের বোতলে তার আবছা প্রতিবিম্ব আটকে আছে। সেই প্রতিবিম্ব এখনো হাসছে, হাত নাড়ছে, কথা বলছে, মাঝে-মধ্যে রুমালে মুছে নিচ্ছে চুম্বনসিক্ত ঠোঁট। আর, অসংখ্য ডুবুরি সেই বোতলের ভিতরে ঢুকে খুঁজে চলেছে তার মৃতদেহ... মাকড়সা বাস্তবতার একমাত্র প্রমাণ স্মৃতি। একটি বৃদ্ধ মাকড়সার স্মৃতি।

আমি দেখেছি সেই মাকড়সার জাল- যার মধ্যে আটকে আছে চাঁদ, জেলেনৌকো, কিশোরীদের গানের বই, অজস্র ডাকটিকিট, রঙিন প্লাস্টিকের গ্লোব, মৃত্যু-টেলিগ্রাম। আমি নিজে সেই জালের সরু তারের ওপর দিয়ে হেঁটেছি। হাততালির শব্দ, কাউনের হাসি এবং রোগা সিংহের গর্জন আমার দ্বারাই প্রমাণিত হয়েছে। এরপর আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে সার্কাসতাঁবুর বাইরে, এটাই নিয়ম। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে দেখেছি, কীভাবে বিহার জুড়ে গ্রীষ্মের লু বয়, কীভাবে ধু ধু করে খুনকান্ত এম.এল.এ-দের নির্বাচনকেন্দ্রগুলি, কীভাবে পর্যটক বাঙালি দম্পত্তিরা আরো পরস্পর-বিচ্ছিন্ন হয়ে শিমুলতলা থেকে ফিরে আসে।

সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে দেখেছি, আমিই সেই বৃদ্ধ মাকড়সা... দ্বিতীয় বেদনা পুরনো বেদনা ভুলে যাওয়াও আরেক বেদনা। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের মতো, চাপ দিলে আর ব্যথা লাগে না। বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কই, চিতায় শোয়ানো সেই আলতা-পরা পা দুটির কথা মনে পড়লে আর চোখে জল আসছে না তো? তাহলে কি, এতদিন পর, সত্যিই ভুলে গেলাম তাকে? বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কান্না হারানোর বোবা কান্নায় দমবন্ধ হয়ে আসে।

এই দ্বিতীয় বেদনা সত্যিকারের বিমূর্ত আর ভয়ংকর। মরুভূমির বিষাক্ত বিছে-র মতো, মাথার ভিতরে এর বাস শুরু হয়। শুরু হয় শূন্যতার। এই দ্বিতীয় বেদনার আতংকে মানুষ তার প্রথম বেদনাটিকে মায়ের স্মৃতির মতো আঁকড়ে ধরে থাকে। কিন্তু কতদিন? সমস্ত ক্ষত শুকিয়ে দেয় যে ছদ্মবেশী সময়, এই দ্বিতীয় বেদনা তো তারই ক্ষুধার্ত কামড়।

... কেউ জেনেছে কি ঈশ্বরের মন? ক্ষত মহান শিল্পীদের জীবনীতে প্রায়শই পড়ি তাঁদের অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা কথা। পড়ি, এবং ভীষণ বিভ্রান্তবোধ করি। ভাবি যে, যে-মানুষ ব্যক্তিজীবনে এতটা হৃদয়হীন এবং নির্মম, তাঁর শিল্পের আদৌ কী আমি দেব? যতই মহৎ হোক সেই শিল্পকীর্তি, তবু আমি তার কানাকড়ি মূল্যও দেব কি? পণ্ডিতেরা বলেন, ভুল, এই বিচার ভুল। শিল্পীও একজন মানুষ, আর সব মানুষের মতো তার ভিতরেও রয়েছে একই সঙ্গে সাধু এবং শয়তান। এবং নিজের ভিতরে এই সাধু-শয়তানের দ্বন্দ্ব থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে তার শিল্প।

সুতরাং, শিল্পীর ব্যক্তিজীবন দিয়ে তার শিল্পের বিচার এক মারাত্মক ভুল। পণ্ডিতেরা সর্বদাই এত ঠিক কথা বলেন! এত খাঁটি সত্য কথা! এবং সব সত্যই কি অদ্ভুত নির্মম! কোমলতার পক্ষে কি কোনও সত্য নেই? না, কোমলতার পক্ষে কোনও সত্য নেই, শুধু বেদনা রয়েছে। সেই বেদনার কাছে আমি আজীবন গুম হয়ে থাকি। দেখি যে, আমার মনে গোঁজ হয়ে আছে একটিই কঠিন কথা। কথাটা এই যে, শিল্পী হবার তাড়নায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বামী-স্ত্রীতে মিলে সংসার ভেঙে দিয়ে, এবং নিজেদের সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে তার গ্রামের মামাবাড়িতে ফেলে রেখে, প্যারিসে এসে রদ্যাঁর শিষ্য বনে যাওয়ার জন্যে রিলকে-র সমস্ত কবিতা আমার কাছে অস্পৃশ্য মনে হয়; অসুস্থ সঙ্গিনী ফ্রাঁসোয়া জিলো-র গালে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার জন্যে পিকাসো-র সব ছবি আমি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিতে পারি।

জীবনের অপরাধ ঢাকতে শিল্পের সাফাই হয় না। সেই অপরাধ, সেই আঘাত আরেকটি নীরব প্রাণে যে ক্ষত সৃষ্টি করে, শিল্পীর আজীবনের সকল শিল্পকর্ম দিয়েও সেই ক্ষতটির ক্ষমা হয় না, শুশ্রূষা হয় না। সমস্ত শিল্পের চেয়ে সেই ক্ষতটি বড়। সমস্ত শিল্পের বিরুদ্ধে, সেই ক্ষতটিই ঈশ্বরের বিষণ্ণ কবিতা... ঈশ্বরের চোখ আমাদের শরীরের প্রতিটি ফুটোয় জেগে আছে ঈশ্বরের চোখ ভিতরে চক্রান্ত, চাঁদ, নিহত বন্ধুর রক্ত, ক্রিমি, কীট, উলঙ্গ রাক্ষস ভিতরে মুখোশ, জুয়া, নাচ, মদ, বেশ্যাদের হাসি তিনি দেখছেন, ঠিক যেভাবে বালক তার পিতৃঘাতকের সঙ্গে নিজের মায়ের অবৈধ সঙ্গমদৃশ্য দেখে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।