যা তুমি আগামিকাল করতে পার, তা কখনো আজ করতে গিয়ে ভজঘট পাকাবে না...
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার কোনোকালেই দেখা হবার কোনো কারণ ছিল না, যেমন কখনো দেখিনি ভ্যালেরি টেইলরকে।
নদী ভাঙ্গা মানুষ সম্পর্কে শুনেছি অনেকে। নদীর চর সম্পর্কে সবসময় মনে হয়েছে এটি হয়তো কেবল দখল আর লাঠিয়ালের এলাকা। এবার সুযোগ হলো (মোটামুটি) কাছ থেকে নদীর চর আর এর অধীবাসীদের দেখার।
বৃটিশ ডোনার এজেন্সি ডিএফআইডির আমন্ত্রনে তিন দিনের জন্য গিয়েছিলাম সিরাজগঞ্জের চৌহালি উপজেলায় যমুনার চরের অধিবাসীদের জীবনযুদ্ধ ফটো ডকুমেন্টেশনের অ্যাসাইনমেন্টে।
সঙ্গে লেখক তাহমিমা আনাম, তিনি গিয়েছেন রিপোর্টিংয়ের জন্য। আর ছিলেন ডিএফআইডির দুজন।
তাহমিমা নবীন লেখক ক্যাটেগরিতে সম্প্রতি কমনওয়েলথ পুরস্কার পেয়েছেন এ গোল্ডেন এজ নামের বইটির জন্য। ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি সব বড় অর্জনগুলো যারা পান, তারা সবাই আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। ফলে, মনে হতো বড় কিছু করার জন্য বুঝি বয়সেও অনেক বড় হতে হয়।
তাহমিমার পুরষ্কারপ্রপ্তি সম্পর্কে জানার পর আমার মনে হলো- চাইলে এ বয়সেও কিছু করা সম্ভব, এ ধারনাটি তিনি হয়তো তরুন প্রজন্মের কাছে প্রকাশ করতে পারবেন। সেটি যদি পারেন, তাহলে তা আমার কাছে তাহমিমার আরেকটি বড় পুরস্কারপ্রাপ্তি বলে মনে হবে । এসব কারণেই তাকে দেখার আগ্রহ ছিল। সে সম্পর্কে পরে লেখা যাবে।
সিরাজগঞ্জ যাবার পর আমাদের যে লোকটি রিসিভ করলেন তিনি সাদা চামড়ার একজন বয়স্ক ভদ্রলোক।
কথা বলেন খুব ধীরে। এতো ধীরে যে, মনে হয় আমরা যখন কোনো বিদেশীর সঙ্গে ইংরেজিতে তথা বলি, তখন যেমন প্রথমে বাংলায় বাক্যটি ভেবে পরে সেটি ট্রান্সলেট করি, ঠিক সে রকম ধীরে।
আগেই জেনেছিলাম জুলিয়ান নামে একজন আমাদের রিসিভ করবেন।
যমুনা ব্রিজ পার হয়ে আমাদের গাড়ি যখন নির্ধারিত স্খানে গিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো, প্রথম দেখলাম তাকে।
গায়ে হাফ স্লিভ শার্ট, গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট আর পায়ে বাটার স্যান্ডাল।
এক হাতে ছাতা ধরে আছেন নিজের মাথার ওপর, আরেক হাতে বেশ কয়েকটি ভাঁজ করা ছাতা আমাদের জন্য নিয়ে এসেছেন। বৃষ্টি হচ্ছিল তখন।
আমাদের গাড়ির বহর নিয়ে তিনি চললেন এমএমএস বা মানব মুক্তি সংস্থা নামের এনজিওর অফিসে। সেখান থেকে গেলাম স্পিডবোটে চৌহালি। ঝুম বৃষ্টিতে স্পিডবোটে যমুনা নদীর অভিজ্ঞতা আমার আগে ছিল না।
স্পিড বোটে দেখা গেল আমরা যতোজন উঠেছি, ছাতা তার চেয়ে একটি কম আছে। বয়ষ্ক এ ভদ্রলোক কিছুতেই রাজী হলেন না ছাতা নিতে। তিনি মাথা নিচু করে ভিজে চললেন। আমার আগ্রহ ছিল ভেজার। কিন্তু সঙ্গে দুটি ক্যামেরা, তিনটি লেন্স, দুটি ফ্ল্যাশ, সব মিলিয়ে কয়েক লাখ টাকার ইকুইপমেন্ট।
সাহস হলো না অ্যাডভেঞ্চারের। প্রায় এক ঘণ্টা ভেজার পর পৌছলাম চৌহালি।
চৌহালি পৌছে দেখলাম আমরা যেখানে থাকব, সেখানে দুজন লোক ধরাধরি করে একটি জেনারেটর নিয়ে আসছে। ভদ্রলোক রেগে গেলেন। তিনি জেরে একটি কথাও বলেননি, শুধু জিজ্ঞেস করলেন, আমি জেনারেটর আনতে নিষেধ করেছিলাম, এটা কার বুদ্ধিতে আনা হলো? এই একটি প্রশ্নে আমি এতোক্ষণে তার বিষয়ে আগ্রহী হলাম।
কারণ তিনি বললেন, এখানে তোমরা দু'রাত থাকবে। জেনারেটরের আলোতে এখানকার রাতের পুরো সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
সন্ধে বেলায় টেবিল পেতে বসেছি উঠানে। চরের শো শো বাতাস। টেবিলে চা দেয়া হয়েছে, সঙ্গে চীনা বাদাম।
খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশে তিনি কতদিন যাবত আছেন। তিনি বললেন, আমি প্রথম এসেছি ১৯৭০ সালে। বৃটেন থেকে এখানে এসেছিলাম কৃষি বিষয়ে জানার জন্য্। ৭০ সালের জলোচ্ছাস দেখেছি। তখন দেখলাম পশ্চিম পাকিস্তানিরা এখানে কয়েক লাখ লোক মারা গেলেও সেখানে রিলিফ বিষয়ে একেবারেই আগ্রহী ছিল না।
সে সময় আমি চলে যাই বড়িশালে। তারপরতো যুদ্ধই শুরু হয়ে গেল।
যুদ্ধের পর ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক চালু করলেন। আমার মনে হলো আবেদ সাহেবের এ কাজে আমার সাহায্য করা উচিৎ। তিন লাখ টাকা যোগার করতে পেরেছিলাম নিজের যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে।
সে টাকার পুরোটাই তুলে দিয়েছিলাম আবেদ সাহেবের হাতে। সেটিই ছিল ব্র্যাকের প্রথম টাকা প্রাপ্তি।
জানতে চাইলাম, আপনি কি সে সময় থেকেই বাংলাদেশে আছেন?
না, সবসময় ছিলাম না। মাঝখানে কিছুদিন ছিলাম ইনডিয়ায়। কিছুদিন ছিলাম ইন্দোনেশিয়ায়।
এ দুটো বাদ দিলে পুরো সময়টি বাংলাদেশেই কাটিয়েছি।
ফ্যামিলি সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, আমার পূর্ব পুরুষ এদেশে এসছিলেন। তারা বান্দরবানে গিয়েছিলেন। সে তথ্য আমি আগে জানতাম না। সন্তু লারমার কালেকশনে একটি বই থেকে আমি জেনেছি।
সে বইটি পড়ে অসম্ভব উদ্দিপ্ত হয়েছিলাম। পরে সে বইটির একটি ফটোকপি করে নিয়েছি। তবে আমার পরিবারের যাদের আমি দেখেছি- না, তাদের কেউ এদেশে আসেননি। আর আমি বিয়ে করেছিলাম কলকাতায় একজন বঙ্গালি নারীকে। তিনি রাজী হননি বাংলাদেশে বা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে থাকতে।
আমার স্ত্রী লন্ডনেই থাকতেন। ফলে কয়েক বছর আগে তার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
একজন বিদেশী দীর্ঘদিন বাংলাদেশে থাকলে যে প্রশ্নটি অবশ্যই করা হয়- সেটি হলো, এ দেশের মানুষের কোন মৌলিক পরিবর্তন এতোদিনে তার চোখে পড়েছে। তিনি বললেন, পরিবর্তনতো পৃথিবীর সবখানেই হয়েছে। এখানে যে পরিবর্তন হয়েছে, তার অনেকটাই বাইরের পরিবর্তনের ফল, আর কিছুটা এখানে ভেতর থেকে হয়েছে।
জীবন এখানে অনেকটাই স্যাটেলাইট চ্যানেল নিয়ন্ত্রিত। আর মাঝখানে কিছুটা সময় মনে হয়েছিল যেন পরিবারগুলোতে বয়ষ্কদের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল, এখন মনে হয় আবার সেটি বাড়ছে জীবনের প্রয়োজনেই।
ভালো খারাপ বলতে পারবো না, তবে বদলে গিয়েছে তো অনেক কিছুই। তবে একটি জিনিস বদলায়নি, সেটি হলো এ দেশের মানুষের আতিথেয়তা। চরের ভূমিহীন লোকের বাসায় গেলেও আপনাকে বলবে একবেলা খেয়ে যাবেন।
এটি মনে হয় বদলাবার নয়।
তিনি ছোট ছোট বাক্যে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে থাকেন। আর অন্যমনষ্ক আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি পারতাম অন্য কোনে দেশে গিয়ে সে দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবনটি খরচ করতে? ভাবতে গিয়ে থমকে যাই। আজ আমার যা বয়স, এ ভদ্রলোক তার আগেই চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে।
============================================
জুলিয়ান ফ্রান্সিস বর্তমানে বৃটিশ অর্থায়নে পরিচালিত চর লাইভলিহুড প্রেগ্রাম বা সিএলপির সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।