আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ আত্মজা

mostafizripon@gmail.com
এক 'এত ঘুম কেন তোর? আমার দিকে একটু তাকিয়ে দেখ', দিলারা মশারি উঁচু করে মেয়ের সাথে কথা বলে। 'মা। আম্মু', সে গভীর স্বরে মেয়ের সাথে কথা বলে যায়, 'কার মতো হয়েছিস তুই? মায়ের মতো? কি নাম তোর? নাম নেই! রাজকন্যা, তোর নাম রাজকন্যা। ' শিশুটি গভীর ঘুমে। ছোট্ট গাঢ় একটি শ্বাস ফেলে সে।

তার বন্ধ করে রাখা চোখের পাতায় সামান্য ভাঁজ পড়ে; কিছু ধরার চেষ্টা করছে- এমন ভঙ্গীতে হাতের মুঠো দু'বার খুলে-বন্ধ করে। দিলারা শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মুগ্ধ-বিস্ময় তার দৃষ্টিজুড়ে। তার নিজের শরীর থেকে জন্ম নেয়া, রক্তে-মাংশে বেড়ে ওঠা মানুষ- তারই সামনে! কী অসামন্য এই অভিজ্ঞতা! দিলারার বুকটা ভরে ওঠে, মনটা কেমন করে- কান্না পায়। সে আলতো করে মেয়ের গালে চুমু খায়। শিশুটির গায়ে অদ্ভুত এক নরম সুবাস; যে সুগন্ধ শিশুদের জন্যই শুধু তৈরী হয় পরম মমতায়।

শিশুটির ঠোঁটের কোণে মূহুর্তের জন্য এক টুকরো হাসি জমে ওঠে; সে হাসি ভালবাসা হয়ে দিলারার বুকটা ভরে দেয়। দিলারা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখের জলের সাথে সাথে তার বুকের ভেতর টুকরো দীর্ঘশ্বাস জমে অচেনা আবেগে। মামুনের ফোনের শব্দে দিলারার স্বপ্ন-কাটে, 'হ্যালো, কি কর তোমরা?' 'আমার আর কী কাজ বল! রাজকন্যাকে পাহারা দিচ্ছি, তার ঘুমই ভাঙ্গেনা!' মামুন হাসে, বলে, 'একটা ক্যামেরা কিনেছি। ' 'কি হবে ক্যামেরা দিয়ে?' 'মেয়ের ছবি তুলব। ইচ্ছে হলে তোমার ছবিও।

' 'কারো ছবি তুলতে হবে না। ' 'এত রেগে রেগে কথা বলছ কেন?' 'ক্যামেরা ফেরত দিয়ে এসো। ' 'আচ্ছা ফিরিয়ে দেব। জাহানারা আপারা কাল-পরশু বাসায় আসতে চায়। আসতে বলব?' 'আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন, তুমি বোঝনা কাকে দাওয়াত দেবে?' 'তোমাদের বাড়ীতে কয়েকদিন ঘুরে আসবে?' 'আমি এখানেই ভাল আছি, কোথাও যেতে হবে না।

ইচ্ছে হলে তুমি ঘুরে এস। আমি এখানে মহাসুখে আছি। ' মামুন কথা বাড়ায় না, ফোন রেখে দেয়। তারপর জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার ওপারে গাছের নীচে পলিথিনের ঘর তুলেছে কেউ; কেউ একজন ফুটপাতে শুয়ে আছে।

দুই পা হারানো পঙ্গু লোকটাও রাস্তার পাশে ভিক্ষার জন্য বসে আছে। মানুষ কেন বাঁচে? পলিথিনের নীচে, ফুটপাতে ঘুমিয়ে, বিকৃত শরীর নিয়ে, ভিক্ষা করে মানুষ কিসের আশায় বেঁচে থাকে? 'মামুন ভাই, আপনার মেয়ের তো বিয়ের বয়স হয় নাই- এত কি ভাবেন?'- পাশের টেবিলের জাহানারা ম্যাডাম ঠাট্টা করেন, মামুন বোকার মতো হাসে। দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ হয়ে গেল মেয়ের বয়স, জাহানারা আপাকে বাড়ীতে একদিন দাওয়াত দিতে হবে। দুই দিলারা বিছানা গোছায়, মেয়ের ছোটছোট কাঁথা, জামা-কাপড় ধোয়ার জন্য বাথরুমে নিয়ে রাখে। রান্না করে।

এরই ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখে শিশুটির দিকে। মাথা ভর্তি চুল মেয়েটির। হাসপাতালে এক নার্স ঠাট্টা করে বলেছিল, 'এত চুল! এখনই খোঁপা করা যাবে', দিলারা একথা শুনেছে বাড়ীতে ফিরে। সে জানালার পর্দা নামিয়ে দেয়- তার রাজকন্যা ঘুমাচ্ছে। দিলারা কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে।

মেয়েটা বড় হলে কেমন হবে? মেয়ের পাশে শুয়ে দিলারা আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে। দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে। দিলারা দরজা খুলতেই অল্পবয়সী এক মেয়ে হাত পেতে দাঁড়ায়। মেয়েটির কাটা ঠোঁট- মামুনের ভাষায় ক্লেফট ঠোঁট। কুৎসিত চেহারাটি থেকে দিলারা তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয় অন্যদিকে।

সে দ্রুত পায়ে ঘরের ভেতরে চলে আসে। ভিখারি মেয়েটি পিছু ছাড়েনা, সেও ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর। দিলারা খুচরো পয়সা খুঁজতে থাকে। এরমাঝে আরো একটি মেয়ে হাত পেতে এসে দাঁড়ায় দিলারার সামনে, তার জিহ্বা বের হয়ে আছে কাটা ঠোঁট দিয়ে। দিলারা এক পলক দেখেই চোখ সরিয়ে নেয়, মরিয়া হয়ে খুচরো পয়সা খুঁজতে থাকে।

তার পাশে আরো একজন এসে দাঁড়ায়; এরপর আরো একজন; আরো একজন। এবার দিলারা ছুটতে শুরু করে। ঠোঁট কাটা ভিখিরির দল ছুটে আসে তার দিকে; তার শাড়ি টেনে ধরে, পা জড়িয়ে ধরে- সে চিৎকার করে ওঠে। দিলারা বিছানায় ধরমর করে উঠে বসে- দুঃস্বপ্ন দেখছিল। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে, তারপর হাত বাড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েকে স্পর্শ করে, মাথায় হাত বুলায়।

মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয়, বুকে চেপে ধরে রাখে কিছুক্ষণ, তার ঠোঁটে আস্তে আস্তে আঙ্গুল বুলিয়ে দেয়। কাটা ঠোঁট। আবার শিশুটিকে বিছানায় শুইয়ে দেয় দিলারা। মেয়েটির দু'পাশে দুটি বড় বালিশ রাখা, যাতে সে গড়িয়ে না পড়ে যায়। দিলারা বালিশ দু'টো ঠিক করে পেতে দেয়।

কি ভেবে একটি বালিশ মেয়েটির বুকের ওপর রাখে সে। শিশুটি একটু চোখ কুচকে আড়মোড়া ভাঙ্গে, হাতের আঙ্গুলগুলো টানটান করে রাখে কিছুক্ষণ, তারপর আবার ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি ছড়ায়। দিলারা বালিশটাকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেয়, নিজের বুকের কাছে চেপে ধরে রাখে। তার বুক ধরফর করে কাঁপছে। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে।

তারপর কি ভেবে বালিশটিকে আবার শিশুটির বুকের ওপর নামিয়ে আনে। দিলারা শিশুটির মুখ থেকে চোখ ফেরায় না- সে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেনা। সে বালিশটি আস্তে আস্তে শিশুটির মুখের ওপর টেনে আনে, শক্ত করে চেপে ধরে। দিলারার চোখ এখন নীলচে ফুল তোলা বালিশের কাভারে, সে শ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেছে। সূতোর সেই নীল ফুলগুলো বড় হতে থাকে, গাঢ় নীল হতে থাকে, ছড়িয়ে পড়তে থাকে বালিশের কাভার থেকে বিছানার চাদরে, বিছানার চাদর থেকে ঘরের মেঝেতে-দেয়ালে, দেয়াল থেকে দরজায়।

হঠাৎ সর্বগ্রাসী নীল দরজায় কড়া নাড়ে, আর চিৎকার করে বলে, 'দরজা খোল, দরজা খোল!' দিলারা সম্বিৎ ফিরে পায়, বালিশটাকে ত্বরিত সরিয়ে নেয় শিশুটির মুখের ওপর থেকে। মেয়েটি চিৎকার করছে, হাত-পা ছুড়ছে। দিলারা নেশাগ্রস্তের মতো দরজার দিকে এগিয়ে যায়, ছিটকিনি খুলে দেয়- মামুন দাঁড়িয়ে আছে। 'কি হয়েছে? ও অমন করে কাঁদছে কেন?' মামুনের কথার জবাব দেয়না দিলারা, সে ছুটে বাথরুমে ঢুকে যায়, সজোরে পানি পড়ার শব্দও দিলারার কান্নাকে চাপা দিতে পারেনা। মামুন মেয়ের কাছে ছুটে যায়, তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নেয়।

'কি হয়েছে মা?' আত্মজার কান্না মামুনকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে। সে শিশুটির নরম গালে নিজের গাল চেপে রাখে। তারপর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, 'কাঁদে না মা, আমি আছি না, তোকে কষ্ট দেয় সাধ্য কার!' একসময় দিলারা বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে। জলের ঝাঁপটায় তার শরীর ভিজে গেছে। সে মামুনের পায়ের কাছে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, 'আমি পাগল হয়ে গেছি।

' মামুন মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর দিলারার মাথায় হাত রেখে আস্তে আস্তে বলে, 'কি হয়েছে?' দিলারা কেঁদেই চলে, যেন অন্তহীন কান্না তার সব পাপ, সকল দুঃখ মুছে দেবে। 'আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি', মামুন দিলারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, 'ক্লেফট ঠোঁট কোন সমস্যাই না, ছোট্ট অপারেশন। ' মামুন মেয়ের দিকে তাকায়, তার শরীরের অংশ থেকে ওর জন্ম হয়েছে। মামুন কয়েক মূহুর্তের জন্য আরেক জীবনে রূপান্তরিত হয়- যে জীবন দু'পাশে বালিশের নীল ফুলের মাঝে ঘুমিয়ে আছে, ঘুমের মধ্যে ফুপিয়ে ফুপিয়ে উঠছে।

কার মতো দেখতে হবে মেয়েটি? দিলারা বিছানায় যায়; খুব যত্ন করে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়, গভীর ভাবে ঠোঁট রাখে মেয়ের গালে, বুকের খুব কাছে টেনে আনে- কার সাধ্য সন্তানকে মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নেবে! মামুন একা একা রাতের খাবার খায়। বেশ কয়েক রাত ঘুম হয়নি তার। সে প্যাকেট থেকে একটি ঘুমের ওষুধ বের করে। খায়। প্যাকেটের বাকি ওষুধগুলোর দিকে লোভীর মতো তাকিয়ে থাকে সে।

অনেকদিন ভাল ঘুম হয়না; অন্তহীন ঘুমের নেশা মামুনকে তাড়া করে। সে একটা একটা করে ট্যাবলেটগুলো বের করে আনে; হাতের তালুতে রাখে গোলাকার, নিখুঁত, নিরিহ বিষের দানা। তিন খুব সকালে অফিসে এসেছে মামুন। তখনও অফিসের দরজা খুলেনি। ফুটপাতের ওপর নুলো ভিখিরিটি বসে আছে।

মামুন সিগারেট বের করে, এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে দেশলাই খোঁজে। ঘুমের ওষুধের খালি প্যাকেটটি উঠে আসে হাতে, যে হাতে অনন্ত ঘুমের বীজ ঢেলে দিয়েছে সে আত্মজার খাবারে। মামুনের ফোনটি বেজে ওঠে। হঠাৎ বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পেটায়, ফুসফুসটাকে শক্ত কর চেপে ধরে। দিলারা ফোন করেছে- প্রতিক্ষিত দূরালাপন সংকেত।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।