মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চিত্তজাগরণ ও আত্মজাগরণের রেনেসাঁ লাখো শহীদের আত্মত্যাগে রক্তিম পতাকা বুকে নিয়ে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আজ আমাদের বুকের স্পন্দন ও গর্বিত উচ্চারণ-
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’।
এবং
‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’।
আমাদের প্রাণের স্তরে স্তরে ও আত্মার গভীরে এবং হৃদয়ের স্পন্দনে মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের সমগ্র জাতির চিন্তা ও চেতনা, আশা ও আনন্দ, সংগ্রাম ও বিদ্রোহ এবং বিবেক ও প্রতিবাদী উচ্চারণ ঘনীভূত শিল্পরূপ লাভ করেছে আমাদের শহীদ মিনারে এবং অপরাজজেয় বাংলা ও জাতীয় স্মৃতি সৌধে।
সমগ্র বিশ্বে আমরাই একটি গর্বিত জাতিযে, বুকের রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছি। আমরা আরো গঠিত যে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে সমগ্র বিশ্বে নন্দিত ও স্বীকৃত। মাতৃভাষা বাংলাকে সরকারি স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠার জন্য আসাম রাজ্যের সুরমা-বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ, শিলচর, কাছার ও হাইল্যাকান্দির দেশপ্রেমিকরা শহীদ হয়েছেন এবং বর্তমানে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে। তাদের প্রতিও আমাদের অসীম শ্রদ্ধা।
মহান ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ছিলো-
‘অফিস আদালতে সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহার করতে হবে’
মহান ভাষা আন্দোলনের উত্তাপ ও আবহেই মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক।
আমাদের সংবিধানের প্রথমেই শেখা আছে-
‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।
কিন্তু দুঃখের বিষয় সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু এবং ‘শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাভাষা’ বিষয়টির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বাস্তব উদ্যোগ নেই এখনো।
মাতৃভাষা বাংলাকে দাপ্তরিক ও উচ্চশিক্ষায় চালুর অন্তরায় ও জটিলতাগুলো এখনো দূর হয়নি। অথচ পঞ্চদশও ষোড়শ শতর্কের বাংলাভাষা রাজকীয় চিঠিপত্র লেখা হতো এবং এর নিদর্শনও আমাদের হাতে আছে। [জহরলাল বসুর ‘বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস’ বইতে অনেক উদাহরন পাওয়া যাবে।
]
তখোনকার দিনে অহোমরাজ, কাছাররাজ, জৈন্তারাজা, কোচবিহাররাজ বাংলা ভাষায় রাজকীয় চিঠিপত্র লিখতেন। ইলিয়াসশাহি সুলতানেরা বাংলাভাষার শুধু পৃষ্ঠপোষণাই করেননি, ব্যক্তিগত পর্যায় ছাড়াও সরকারি চিঠিপত্র এবং ব্যবসাবাণিজ্য, দলিলদস্তাবেজ ও রাজকীয় ফরমানও বাংলাভাষায় জারি করতেন।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে অনেক মোঘল শাসনকর্তার স্বাক্ষরিত কয়েকটি চিঠি পাওয়া গেছে- যেগুলো বাংলাভাষায় লেখা। এসমস্ত চিঠিপত্র সুলতানী আমলের চিঠির প্রথা ও নমুনার স্বাক্ষর বহন করে।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই মুরশীদ কুলি খাঁর দরবারের একটি বিচার অনুষ্ঠানের রায়ের পত্রটি উল্লেখ করতে হয়।
পুরো রায় ও জয়পত্রটি বাংলাভাষায় লেখা হয় এবং উল্লেখ্য যে, উক্ত দরবারে বৈষ্ণব মতাদর্শ ঘটিত বিতর্ক অনুষ্ঠানের দু’টি পত্রেই নবাবের মোহরাঙ্কিত স্বাক্ষর রয়েছে। তাই নবাবের মোহরাঙ্কিত বাংলাভাষায় লেখা জয়পত্র ও রায়পত্রটি এ সাক্ষ্যই বহন করে যে, সুলতান, নবাব ও বাদশাদের রাজকীয় কার্যে বাংলাভাষা ব্যবহারে কোন অনীহা ছিলো না। বরং এখানে বাঙলা, বাঙালি ও বাংলাভাষার স্বীকৃতি ও মর্যাদাই প্রকাশ পেয়েছে।
‘অফিস আদালতে সর্বত্র বাংলা ব্যবহার করতে হবে’।
কাগজে কলমা তাকলেও এর বাস্তব প্রয়োগ খুব কমই দেখা যায়।
বেসরকারী অনেক অফিসেই বাংলায় কথা বলা পর্যন্ত নিরুৎসাহিত করা হয়।
এ দাবি যেমন অবহেলিত তেমনি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাও উপেক্ষিত। একটিও শুদ্ধ ইংরেজি বাক্য যারা বলতে ও লিখতে পারে না তারাও গর্ব করে বলে ইংরেজি তার কাছে বাংলার চেয়ে সহজ ভাষা। শুধু তাই নয় তারা দম্ভ ভরে বলে থাকে বাংলা ভাষা নাকি আজো বিজ্ঞান দর্শন ও উচ্চ শিক্ষার বাহন হিসেবে উপযুক্ত নয়। রাশিয়া ও চীন-জাপানের ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে অনেক জটিল ও দুর্বোধ্য অথচ তারা মাতৃভাষার মাধ্যমেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় চরম উৎকর্ষে উঠেছে।
ভাষাকে সমৃদ্ধ করে মানুষ। ভাষার প্রতি থাকতে হবে প্রেম। বিজ্ঞানী ও দার্শনিক মাতৃভাষায় বিজ্ঞান ও দর্শনের ভাষা তৈরি করবেন। আমাদের কোথায় সে সৃজনশীল বিজ্ঞানী ও দার্শনিক, কোথায় সে ভাষা প্রেমিক! আমাদের পরিভাষাও কি বিদেশীরা তৈরি করে দেবে?
মাতৃভাষার মাধ্যমে অধিক বিদ্যাকে আত্মস্থ করতে পারে না বলেই আমাদের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার নামে কিছু মুখস্ত বুলি নিয়ে টবের গাছ বা শিকড় বিচ্যুত গাছের মতো ভিত্তিহীন হয়ে গড়ে উঠে। শুধু তাই নয়, মাতৃভাষার প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা না থাকলে দেশপ্রেমও সৃষ্টি হয় না।
মাতৃভাষার প্রতি এমন অনীহা আমাদের মতো অন্য কোন জাতির আছে কিনা সন্দেহ।
(সূত্র : ড সাইফুদ্দীন আহমেদ, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।