'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'
শাশ্বত সত্যকে নিয়ে সুজনের দেয়া এই পোস্টটি স্টিকি করার আহ্বান আবারো
শাশ্বত সত্যকে নিয়ে তার শিক্ষক আ-আল মামুনের এই লেখাটি ক'দিন আগে আমার হাতে এসেছে একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপার জন্য। লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে লেখাটি ব্লগে দিলাম। - ব্লগার
শাশ্বত সত্য’র পাশে দাঁড়াবোই
আ-আল মামুন
প্রথম বর্ষের ক্লাস নিতে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়েছি, বহুদিন পরে। ক্লাসে আমি মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাস পড়াচ্ছি, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করিজ্জএক দিন, দুই দিন, তিন দিন। একটা ছেলে প্রশ্নগুলোর জবাব জানে।
অনেকদিনের অভিজ্ঞতায় হতাশা জন্মেছে, ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছেজ্জযদি বলি মহাভারত পড়েছ? জবাব পাই, না স্যার পড়িনি, তবে কেউ কেউ বলে টিভিতে দেখেছি। সেহেতু হতাশা জন্মেছে, তবু অভ্যাসবশে বক্তৃতার মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি উত্তরের প্রত্যাশা না-করেই। এবার অবাক হয়েছি, একটা ছেলে জবাবগুলো জানে। বলি, কাগজ কোন দেশের মানুষ আবিষ্কার করেছিল, জবাব আসে চীন দেশে। প্রশ্ন করি, আধুনিক মুদ্র্রণশিল্পের জনক কাকে বলা হয়, তার সাকিন কোথায়জ্জজবাব পাই গুটেনবার্গ, জার্মানীর মেনজ শহরে।
বরীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো পড়েছো? হ্যাঁ। মানিক পড়েছ? হ্যাঁ স্যার কিছু পড়েছি। আমার চোখ বারবার ঘুরে যায় উত্তরদাতার দিকে।
আমি ছেলেটা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি, মনোযোগ দিই। নাম শাশ্বত সত্য।
প্রাণবন-, উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি। বামহাতে ক্র্যাচে ভর দিয়ে তার চলাফেরা। ও মাঝেমধ্যে আলাপ করতে আসে, আমি পরামর্শ দিই, অবশ্যপাঠ্য বইগুলো পড়তে বলি, সাংবাদিকতার অ-আ-ক-খ শেখাইজ্জআমার ভালো লাগে। পড়ালেখা-করা ছেলে নজরে পড়লে শিক্ষক হিসেবে আমি স্বভাবতই তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠি। ভাবি, বেশতো পড়ালেখা করছে ছেলেটি, এখন আরও বইপত্র পড়িয়ে ও আলাপচারিতার মাধ্যমে গড়েপিঠে নেবজ্জরাষ্ট্রকাঠামো, সমাজ আর মিডিয়ার সমাজতত্ত্ব বিষয়ে সচেতন করে তুলবো।
এভাবেই দিনগুলো চলছিল, এভাবে আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকি।
এর মধ্যে ওদের প্রথম ইনকোর্স পরীক্ষা হলো। জিজ্ঞেস করি, কেমন পরীক্ষা দিলে শাশ্বত? ও বলে, ‘ভালো হয়নি স্যার। ’ আমি মনক্ষুন্ন হই, বলি ‘কেন ভালো হলো না?’ জবাব পাই: ‘বেশিক্ষণ একটানা লিখতে পারি না, হাত অবশ হয়ে আসে স্যার। ’ এতোদিন আমি ওর মনোজগতের বিকাশ নিয়ে আগ্রহী ছিলাম, এখন ওর শরীরতত্ত্বও সামনে এসে হাজির হয়।
আপন শরীর নিয়ে ওর লড়াইয়ের ইতিহাস বড়ই করুন আর দীর্ঘ। সেই ১৯৯৮ থেকে ২০০৮। পরিসি'তির নিয়মিত অবণতি ঘটেছে, শরীরের অঙ্গগুলো একটার পর একটা বিদ্রোহ করেছে, অচল হয়ে যাচ্ছে। আর প্রচণ্ড মনোবল সম্বল করে ও এগিয়ে চলেছে, সামনে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও। ডাক্তারিবিদ্যা ও বিজ্ঞান বলছে ওর পরাজয় ঘটবেজ্জহাত-পা-কোমরের জয়েন্টগুলো অচিরেই অচল হবে, মেরুদণ্ড আরষ্ট হয়ে যাবে, ও চলচ্ছক্তিরহিত একদলা মাংশপিণ্ডে পরিণত হবে।
তারপরে মৃত্যু অনিবার্য। কিন' বিজ্ঞান মানুষের মনের তালাশ এখনও করতে পারেনি। বিজ্ঞান জানে না মানুষের মন কী অপরিমেয় শক্তি ধারণ করে, কতোটা অমৃত ফলাতে পারে। প্রতিটি মানুষের মনে যে আল্লা বাস করে করে এবং অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে তার তালাশও বিজ্ঞান করতে পারেনি, অদূর ভবিষ্যতেও করতে পারবে না বলেই মনে হয়।
২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন- বিছানায় পড়ে ছিল শাশ্বত, পিঠে গোটা গোটা ঘা হয়েছিল।
সবাই ওর পঙ্গুত্ব মেনে নিলেও মানতে পারেনি শাশ্বত নিজে। দেহ-মনের সর্বশক্তি জড়ো করে ২০০৬ সালের প্রথম দিকে ও হামাগুড়ি দিয়ে, ছেঁচড়ে উঠে বসেছিল। তারপর একসময় দুই ক্র্যাচে ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে এক পা দুই পা করে হাঁটতে শুরু করেছিল, শরীরের অসীম যন্ত্রণা উপেক্ষা করে। এবং ২০০৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে এক ক্র্যাচে ভারসাম্য রেখে এবছর আমাদের বিভাগে ভর্তি হয়েছে। একটা ক্লাসেও ওকে অনুপসি'ত দেখি না।
ও যেন মৃত্যুর সাথে, পরাজয়ের সাথে পাশা খেলে চলেছেজ্জনিয়মিত বিলম্বিত করে তুলছে আজরাইলের কাজটি। আমি ওর লড়াই দেখি আর অবাক মানি।
এই লড়াইয়ের কাহিনী শুনতে একদিন শাশ্বতসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে বসেছিলাম আমার বাসায়। বাবা-মা স'ানীয় ডাক্তার ছেড়ে একসময় নিয়ে গেছেন কোলকাতার পেয়ারলেস হাসপাতালে। জেনেছেন, সিরোনেগেটিভ রিউমেটয়েড আর্থারাইটিস নামের নাম না-জানা দুরারোগ্য ব্যাধি ধরেছে শাশ্বতকে।
তিন মাস অন-র গিয়ে দেখাতে হবে। ফিরে আসার সময় ব্যাথা সামান্য কম থাকলেও দুই মাস পেরোতে না পেরোতেই ব্যাথার তীব্রতা এতোই বাড়ে যে তিন মাসের অপেক্ষা না-করেই তাকে ছুটতে হয় কোলকাতা। ঐ অবস'াতে ক্লাস না-করে ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেয় সে। ফল ৩.৫০। কথা বলতে বলতে খুব উৎফুল্ল হয়ে বলে, ‘২০০১ থেকে ২০০৩ এর মে মাস পর্যন- আমি অনেক ভালো ছিলাম।
ব্যাথা প্রায় হতোই না। কিন' মে মাসে হঠাৎ করেই এমন পরিসি'তি হলো যে আমার পক্ষে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা চিন-া করাও অসম্ভব ছিল। ’ ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে ওর শরীরের ওজন ছিল ৬০ কেজি আর ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে গিয়েছিল ২৮ কেজিতে। বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হয়েছিল প্রায়। দিনে ২/৩ চামচ বার্লির বেশি কিছু খেতে পারতো না, এটুকু খেলেও নীল বমি হয়ে বেরিয়ে আসতো।
বাবা অরুণ সত্য তাকে কোলকাতায় আর না-দেখিয়ে নিয়ে এবার গেলেন ভেলোরে ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজে। সেখানেও ডাক্তার জানালেন পিত্তথলী ভর্তি অসংখ্য পাথর। সিরোনেগেটিভ রিউমেটয়েড আর্থারাইটিস তো আছেই। ঔষুধ নিয়ে যখন দেশে ফিরে আসে তখন তার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি আর অবশিষ্ট নাই। একটার পর একটা ঔষুধে ক্লান- শাশ্বতর এবার বুকে ব্যাথা শুরু হয়েছে, আর রাত্রে জ্বর হচ্ছে, শরীর বিছানাগত।
বাবা-মা তার জীবনের আশা ছেড়ে দিলেন।
‘কোলকাতায় থাকতে আমি একটা বইতে প্রাণায়ামের বিষয়টি পড়ি। সেটা করে মনের দৃঢ়তা ফিরিয়ে এনে আমি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াই ২০০৬ সালের প্রথমদিকে, তাও কুঁজো হয়ে,’ শাশ্বত বলে। ছেলের এই চেষ্টা অসহায় বাবা-মাকে আশান্বিত করে। আবার নিয়ে যান ভেলোরে জুন মাসে।
চিকিৎসক বললেন, সিরোনেগেটিভ রিউমেটয়েড আরথাইটিস আরো একধাপ এগিয়ে এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস এ রূপান-রিত হয়েছে। আরও জানান, বাম পায়ের হিপ জয়েন্ট বা অসি'সন্ধি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে এবং শরীরের প্রত্যেকটি জয়েন্ট নষ্ট হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। যদি-না তাকে ৪টি বিশেষ ইনজেকশন অতিসত্ত্বর দেয়া হয় তাহলে তার দেহের অন্যান্য হাড়ের জয়েন্টও নষ্ট হয়ে যাবে।
এক একটি ইনজেকশনের দাম দুই লাখ রুপি, মানে বাংলাদেশী ১৬ লাখ টাকা। বাবার সামর্থ্য নাই, গত দু’বছর তার চিকিৎসা তাই বন্ধ রয়েছে।
বাম পা ও মেরুদণ্ড ইতোমধ্যে একটু বেঁকে গেছে। ডান দিকের হিপ-জয়েন্ট ও পা আক্রান- হয়েছে। হাত দিয়ে লিখতে পারে না বেশিক্ষণ, ফুলে যায়। নিজে পোশাক বদলানো, একটানা একঘণ্টার বেশি শুয়ে থাকা, একটানা পনেরো মিনিট বসে বা দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও তার নাই এখনজ্জমেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়, বুকের খাঁচা হৃদপিণ্ড কামড়ে ধরে।
স্বাসে'্যাজ্জল শরীরের ছেলেটিকে দেখলে কে বলবে প্রতিনিয়ত তার জয়েন্টগুলো খুলে খুলে যাচ্ছে।
কে বলবে প্রতি রাতে দু’হাজার পাওয়ারের ব্যাথানাশক খেয়ে বিছানায় যায় সে। অনেকটা সময় কথা বলতে বলতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলে, ‘স্যার আমার চার্জ শেষ হয়ে আসছে। বাসায় গিয়ে রাতে একটা ব্যাথার ওষুধ খেয়ে ঘুম দিব। তবেই কাল সকালে ক্লাসে আসতে পারবো। এই ওষুধই এখন আমার চার্জার।
’ আমরা ওকে রিকসায় উঠিয়ে দিয়ে আসি। নির্ভার শরীর নিয়ে আমরা কেউ কারো সাথে কথা বলতে পারি না। শাশ্বতর কথাগুলো এপ্রিলের গরম বাতাসে আর আমাদের মগজে রাজত্ব করতে থাকে।
শাশ্বতর মা গৃহিণী, বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল-শিক্ষক। পনেরো বিশবার কোলকাতা ও তিনবার ভেলোরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে, আর উচ্চ-ক্ষমতা-সম্পন্ন ব্যথানাশক কিনতে কিনতে আর্থিক অবস'া তলানিতে ঠেকেছে।
লিখিত হিসাব অনুযায়ীই তারা ১১ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন, আর অ-লিখিত ব্যয় কতো তা আমরা জানি না। সর্বশান- বাবা-মা জানেন না সন-ানকে কীভাবে বাঁচিয়ে তুলবেন।
কিন' আমরা জানি। আমরা জানি কীভাবে শাশ্বতকে পঙ্গুত্ব ও অকাল মৃত্যু থেকে রক্ষা করা যায়। শাশ্বতর বাবার একার পক্ষে যা নিশ্চিতভাবেই অসম্ভবজ্জযে কারণে তিনি ২০০৬ সালে ১৬ লক্ষ টাকার কথা ভেবে ভেলোর থেকে পাংশু মুখে ফিরে এসেছিলেনজ্জসেকাজ আমাদের লক্ষ হাতের জন্য অনায়াশসাধ্য।
আমরা জানি, লক্ষ হাত সহজাত প্রবণতাবশে শাশ্বত’র দিকে এগিয়ে আসবেই। আমরা জানি, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এখনও ‘মনুষত্ব্যের বোধ’ প্রবল।
তাই আমরা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারী মিলে শাশ্বত চিকিৎসা-সহায়তা কমিটি গঠন করেছি। ২টি ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে আমরা অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি-১) ‘শাশ্বত চিকিৎসা-সহায়তা’ একাউন্ট নং: ৩৪২৬০৪৯৮, অগ্রণী ব্যাংক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা; এবং ২) ‘Saswota Chikitsa-Sohayota’ AC no: 135-101-33705, Dutch-Bangla Bank Limited.
শরীরের যেটুকু ক্ষমতা তারচে অনেক বেশি আদায় করে নিতে চেয়েছিল শাশ্বত। তাই শরীর আবার বিগড়ে গেছে।
এই মে মাসে ওদের দ্বিতীয় ইনকোর্স পরীক্ষা চলছিল। ও দুটো পরীক্ষা পার করতে পেরেছে কোনোমতে, তারপর শরীরের কাছে হার মেনে আবারও বিছানা নিয়েছে। আমরাও বুঝে নিয়েছি, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা না-দিতে পারা অবসন্ন শাশ্বতকে আমি পিঠে হাত বুলাতে গেলে বলে, ‘স্যার প্লিজ হাত দেবেন না, ব্যাথা’। ডাক্তার-কথিত ইনজেকশন নিলে শাশ্বত অনিবার্য পঙ্গুত্ব ও অকাল মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবে হয়তো।
কিন' হাড়ের গিটে গিটে ব্যাথা নিয়েই ওকে জীবন পার করতে হবে, কোনোদিনই সারবে না।
আমরা চাই, এক-শরীর ব্যাথা নিয়ে হলেও শাশ্বত যেন আমাদের মাঝে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ওর উজ্জ্বল সক্রিয় উপসি'তিটুকু বজায়ে রাখতে পারে। ও যে মুক্তো ফলানোর স্বপ্ন দেখে, বিষময় শরীর নিয়ে হলেও যেন সেই স্বপ্নের মানচিত্রজুড়ে হাঁটতে পারে। ওকে দেখি আর আবুল হাসানের পদ্যের দুটো লাইন বারবার মনে পড়ে আমার: ‘ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও। ’
আমরা যেন এই নিশ্চয়তাটুকু ওকে দিতে পারি।
২৩শে মে ২০০৮
(লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।