আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প: বুয়া

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

কাজের বুয়া খুঁজছে অনেকদিন ধরেই। তবুও এমন এক বুয়া রাখবে, ভাবতেই পারে নি সুমি। বিকট, বিশাল চেহারা, বাজখাই গলার আওয়াজ আর গায়ের রং আষাঢ়ের মেঘের মতো কালো। কাজের বুয়াকে সুন্দরী হতে হবে, এমন উৎকট দাবী কে করে? কিন্তু অসুন্দরের একটা একটা সীমা তো থাকা চাই। বাচ্চারাই যদি বুয়ার ভয়ে তটস্থ হয়, সে বুয়া কি বাড়ীতে রাখা যায়? াএকবার তাকিয়ে শরীরের বহর দেখে তো খাওয়াদাওয়ার পরিমান বুঝতেও দেরী হয়না।

এই দুর্মল্যের বাজারে এমন একজনকে দুৱবেলা শাক ভাত দিয়েই পেট ভরে খাওয়ানো খুব সহজ কথা নয়। তাই অফিসের এক কলিগের যোগাযোগে শাহেদ যখন একে নিয়ে বাসায় এলো, কালো আর গম্ভীর হয়ে উঠলো সুমীর চেহারা। দু’জনেই অনেকদিন ধরে একে তাকে বলে বলে বুয়া খুঁজে হদ্দ। কোথায় পাবে? সব গরীব মেয়েরা তো গার্মন্টসএ কাজ করতেই বেশী আগ্রহী। একজন দু’জনকে পেলেও তাদের যা খাই, কেরানীর মাইনেতে কি তা মেটানো সম্ভব? তাই এই বুয়াকে দেখেই আষাঢ়ের মেঘের মতো চেহারা হলো সুমির।

তাকে রান্না ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে টেনে শাহেদকে নিয়ে গেল শোবার ঘরে। - কান্ডজ্ঞান কি পুরো খেয়ে বসেছো? একে নিয়ে এসেছ! আমার তো দেখলেই ভয় হয়! এমনকি বাচ্চারাও ভয় পাবে। আমাদের তিন্নিকে দেখনা, ফকির দেখলেই ভয় পায়! শাহেদ সুমির কথাকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে হেসে উঠলো। ওর যেন কিছুতেই কোন ভাবনাচিন্তা নেই। - কি যে বলো! ভয় হতে যাবে কেন? ও তো আমাদের মতোই মানুষ! এবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো সুমি।

এমনিতেই গরমে মেজাজ খারাপ ছিল তার। এর মাঝে মাছওয়ালা প্রায় দ্বিগুন দাম চেয়ে আরো গরম করে দিয়েছে মাথাটা। - ছাড় তোমার মারফতি কথা! আমি ভয় না পেলেও ছেলেমেয়েরা তো পাবে। একে আমি রাখবো না। - তোমার যা মর্জি! তবে সংসারের ঘানি টানতে টানতে শেষ হয়ে যাচ্ছ, একথা আর বলতে পারবে না! বলে এবারও এবারও হাসলো শাহেদ।

- ওমা, এমন কথা আমি কবে বলেছি? - বলনি! তবে রাতের বেলা একটু আদর করতে গেলেই তো ছ্যাত করে ওঠো। অন্যদিকে ফিরে তারপরই ঘুম! শাহেদের কথা শুনে এবার হেসে উঠলো সুমি নিজেই। চেহারাতেও লালিমা ছড়ালো অনেকটা। রান্নাঘরের উনোনের উত্তাপে যে লাল গাল আরো লাল হয়ে গেল। - ঠিক আছে গো।

আর ছ্যাত করবো না, সারারাত প্রেমই করবো। তারপর দেখবো পরদিন কি করে অফিসে যাও তুমি! দু’জনেই হেসে উঠলো একসাথে। কিন্তু ঘরের বাইরে এসে অবাক হলো ওরা। রান্নাঘরের দাওয়ার বুয়ার কোলে বসে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে তিন্নি। আর বুয়া চোখ বড়বড় করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।

ওদের দিকে নজরই করলো না কেউ। সুমির মুখের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো শাহেদ। আবার শোবার ঘরে ফিরে গেল দু’জন। নতুন করে আলোচনা চললো। সকাল বিকেল বুয়ার চাকুরী হলো এবাড়ীতেই।

কিন্তু প্রথমদিনই বিরক্ত হলো সুমি। চেহারার সাথে সাথে কথা বলার ভঙ্গীও ভাল নয় বুয়ার। সকাল বেলা মাত্র ঘুম থেকে উঠেও নি, তখনই দরজায় ধুম ধুম ধাক্কা। ঘুম ঘুম চোখে গিয়ে দরজা খুলল সুমী। খুলেই দেখে বুয়া দাঁড়িয়ে বাইরে।

- খাইছেগো! আম্মা! রইদ উইঠ্যা গেছে, অহনও ঘুমাইতাছেন! - এটা আবার কোন ধরণের কথা! আমার সামনে খাইছে খাইছে করবে না। - ঠিক আছে আম্মা, কমুনা। - আম্মাও বলবে না। - খাইছে! আপনেরে তাইলে কি কমু আম্মা। - খালা বলবে।

- ঠিক আছে আম্মা, আপনেরে খালাই ডাকমু। বুয়ার কাজ ভালো, রান্না ভাল। খেয়ে শাহেদ তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ঘরবাড়ীও বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখে। শরীরের তুলনায় খাওয়ার পরিমানও বিরাট কিছু নয়।

তবে বুয়াদের অধিকারের যে একটি সীমাবদ্ধতা থাকে, তা জানতে চায়না একেবারেই। তিন্নিকে পড়াশোনা, বা দুষ্টুমির কারণে সামান্য বকাবকি করলেও গলা বাড়িয়ে ঝগড়া করে সুমির সাথে। মুদ্রাদোষের কথা বার বার বলেও ছাড়ানো যায়নি। বুয়ার আস্কারায় এমনকি তিন্নিও মাঝে মাঝে “খাইছে” বলে ফেলে। তারপর মায়ের বকা খেয়ে আবার বুয়ার পেছনে গিয়েই দাঁড়ায়।

তাতে সুমির বিরক্তি বেড়েই চলে। সুমির ঘ্যানঘ্যানানিতে অস্থির হয়ে এরই মধ্যে শাহেদ অন্য বুয়াও খুঁজেছে গোপনে। কথা বলে পছন্দ হলেও বেতনের দাবী শুনে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। কোন বুয়া বাদে নিজের হাতেই কাজকর্ম চালিয়ে দেবে বলে ভেবেছিল সুমি। কিন্তু তার শরীরের কথা ভেবে শাহেদই সায় দিতে চাইল না।

নতুন শিশুর আগমনি বার্তায় শরীরও ভারী, যখন তখনই দুর্বলতা এসে ভর করে। তাছাড়া প্রসবের পরও তিন্নিকে দেখাশোনার জন্যে হলেও কাউকে দরকার। আঘাত বাইরে থেকেও এলো। হঠাৎ অশুভ ঘনঘটায় জিনিসপত্রের দাম বাড়তে লাগলো হুহু করে। পঁচিশ টাকা কেজি চালের দাম এক লাফে গিয়ে উঠলো পয়তাল্লিশের ঘরে।

অন্যান্য খাবার দাবারও চালের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠলো। এমনি অবস্থা যে, নিজেদের খাবার জোগাড়ই প্রায় অসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো। সুমির অপছন্দের কারণে না হলেও এই অভাবের কারণেই একদিন বুয়াকে বিদায় নিতে হলো। তিন্নিকে কোলে তুলে আদর করে ও শাহেদ আর সুমির পায়ে সালাম করে বুয়া তার সেদিনকার ভাত-তরকারী নিয়ে চলে গেল এবাড়ী ছেড়ে। কিন্তু তাতে যতটুকু খাবার বাঁচলো, তাতে শুন্যস্থানটি পূরণ হবার নয়।

তাই শাহেদের বার বার নিষেধ সত্বেও একদিন খুব ভোরে ন্যায্যমুল্যের দোকানে চালের জন্যে লাইন দিল সুমি। শ’য়ে শ’য়ে অভাবী মানুষ চাল কেনার আশায় ভীড় জমিয়েছে। সবারই অপেক্ষায়, কখন খুলবে দোকান। এরই মাঝে কিছু কিছু লোক দেখা গেল, যারা গায়ের জোরে ঠেলে পেছন থেকে সামনে আসতে হম্বিতম্বি চালিয়ে যাচ্ছে। একজন আরেকজনকে চিৎকার করে যেভাবে কথা বলছে, তাতে তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট ভাবেই প্রকাশ পেলো।

দোকানের খোলার সাথে সাথে দেখা গেল সেই আলামত। পেছন থেকে ধাক্কাধাক্কি আর হই হই রব। পাহাড়াদার পুলিশের দল কি এক অজানা কারনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। পেছনের হঠাৎ ধাক্কায় সামনে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল সুমি। মাথাটাও ঘুরে উঠেছিল।

মনে হলো পেটের ভেতরে শিশু যেন মা মা বলে চেচিয়ে উঠলো। শেষ মুহুর্তে কেউ একজন ধরলো পেছন থেকে শক্ত হাতে। সুমী মুখ ফিরিয়ে বুয়াকে দেখার আগেই শুনতে পেল, - খাইছে! আম্মাগো আম্মা, আপনেও এইহানে? আমি আপনের পিছেই আছি। দেহি কোন হালায় আপনেরে ধাক্কা দেয়। কইলজাডা লগে লগে ছিড়্যা লমু না!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।