আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খুঁজি ওয়েবের ক্যানভাসে মানুষের মুখ



উৎসর্গ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। প্রিয় অরুপকে, বেচারা অনেক দিন না কি ব্লগ পড়ে না। প্রথম যখন সামহোয়্যারে আসলাম, তখন একটা ওয়েব সাইটে বাংলায় লেখা যায় এটাই আনন্দের উৎস ছিলো। খবরটা পেয়েছিলাম এক বন্ধুর কাছে, এসে দেখেই সদস্য হলাম। তখনও বাংলা টাইপিং জানি না, এখানে লিখতে হতো বিজয়ে, আর অন্য একটা ছিলো মাউস টিপে বাংলা লেখা।

এখনও সেটা আছে তবে এখন যেভাবে আসে কি বোর্ড লে আউট সে রকম নয়। একপাশে স্বরবর্ণ, অন্য পাশে ব্যঞ্জন বর্ণ। মাউস চেপে বাংলা লেখা তেমন চমৎকার কোনো কাজ না, আনন্দের কাজ না। বিজয়ের নিজস্ব কিছু সমস্যাও ছিলো এখানে। তবে বাংলা লেখার আনন্দকে কিছুই দমিয়ে রাখতে পারতো না।

দুপুর বেলা বসে টিপ টিপ মাউস চেপে লিখছি- অনেক কষ্ট করে লেখা শেষ করে প্রকাশ করুন চেপে করুণ হাসি- ততক্ষণে লগ আউট হয়ে গেছি। তবে এটাও দমাতে পারে নি। পুনরায় লেখা শুরু। কয়েকবার ভুলের পর বিকল্প পন্থায় খুঁজে পাওয়া গেলো। লেখার পরে সেটা কপি করে রাখা।

একবার প্রকাশ করুন বাটনে চাপ দিয়ে দেখা। যদি কপাল ভালো থাকে তবে একেবারে চাঁদমারি, না হলে পুনরায় পেস্টানো। তখন সাহিত্যের বাতিক ছিলো না এখানে। কতিপয় বাঙালী নিজের আনন্দে বাংলা লিখতো। নিজের ভাষায় লিখতে পারার আনন্দ নিয়েই লিখতো।

সবাই খুব ভালো লিখতো তাও না। আজকে দিনটা খুব খারাপ গেলো। বন্ধুর সাথে রাগ, মায়ের সাথে অভিমান, ভালোবাসার কষ্ট, আনন্দ, বোধ হয় ব্লগের নিজের চরিত্র হলো নিজের আনন্দে লিখে যেতে পারা। একটা মানুষ নিজের যাবতীয় অনুভব নিজের মতো লিখছে, সেটা সবার জন্য উন্মুক্ত বলেই হয়তো সবাই আসছে, পড়ছে। কারো কারো নিজের অনুভবের সাথে মিলে যাচ্ছে সেইসব অনুভব, তারা একাত্মতা প্রকাশ করছে।

মা দিবসে মন খারাপ করা লেখা পড়ে বৃষ্টি ভেজা মনে ঘরের বাইরে গিয়ে চুপ চাপ সিগারেট টানি। মায়ের কথা মনে পড়ে। নিজের সন্তানের চেহারা দেখি, তার দাঁত না ফোটা হাসি দেখি, জড়িয়ে ধরে বসে থাকি। বাবা তোমাকে একদিন দাদীর কাছে নিয়ে যাবো। হঠাৎ হঠাৎ ঢাকর গল্প শুনে মনটা ধরাস করে উঠে, কি হবে এই জীবন রেখে, ঢাকার রাস্তার পাশের টংয়ের দোকানে বসে এক কাপ চা না খেয়ে কতদিন কাটিয়ে দিলাম।

শাহবাগের মোড় বদলে গেছে। সেখানে এখন রাস্তার মাঝে ৪টা ডিভাইডার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ সড়কের এমন বেহাল শুনেই মনটা খারাপ হয়। অন লাইনের বন্ধু জানায় যাদুঘরের কাছে বাস চাপা পড়ে তার এক বন্ধু মুমূর্ষু। একজন মৃত, আরেকজন জীবন্মৃত।

একই সময়ে আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরে নিরাপদ পারাপারের অধিকারের জন্য আন্দোলন. ভিসি আটকা পড়লো চারুকলায়, তাকে পিটিয়ে উদ্ধার করে আনলো ছাত্রদলের ক্যাডাররা। কি আর করা যাবে? পেশীর দাপটে মানুষের নিরাপদ জীবনের আন্দোলন দমিয়ে রাখা যায়। ভিসি হাতের আঙ্গুল উঁচিয়ে বিজয় চিহ্ন দেখান। ঘৃণায় গা রি রি করে। ক্ষমতার অন্ধত্ব বাধা মানে না।

বন্ধুর শরীরে আঘাত করতেও কারো দ্বিধা হয় না। ক্ষমতা আর দখলের লড়াইয়ে সবাই শত্রু। বন্ধু হয়তো ক্ষণিকের, শেষ পর্যন্ত মহসিন হলের শিমুলের কথা মনে পড়লো। সে এক ছেলেই ছিলো। বাড়ী কোথায় জানি না, ৯৬এ যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলো, জসিমুদ্দীন হল দখল হবে, সে তখন ছাত্র দলের ক্যাডার, মাঝ রাতে হলের দরজা খুলে দিয়ে সেও ঘোরতর আওয়ামী লিগার হয়ে গেলো।

তার কড়ে আঙ্গুল কাটা পড়লো সেই লড়াইয়ে। কয়েক দিন হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরে আসলো সে একদিন। মেইন গেট বন্ধ রেখে সারা রাত পাহারা দেয় অস্ত্রধারী ক্যাডার, সাধারণ ছাত্র গভীর রাতে ফিরলে গেটের বাইরে দাঁড়া করিয়ে রাখে। ভোর হলে তার প্রবেশের নির্দেশ পাওয়া যাবে, নেতা এসে যদি বলেন এ ছাত্র নেহায়েত গোবেচারা, তাকে দিয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, ও তো আমাদের ছেলে মিছিলে যায় নিয়মিত। ছোটো ভাই তুমি আসো, অতিথি ঘরে বসো।

আমরা ক্ষমতার দম্ভে বুক উঁচু করে চলতে থাকা মানুষকেও বদলে যেতে দেখেছি। ক্ষমতার অন্ধ নেশায় রাতারাতি আদর্শ বদলে একেক জন নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হতে সময় নেয় নি। হলের মাংনা খাওয়া আর একটু দপটের সাথে ছড়ি ঘোরানোর আনন্দে কারোই শোভনতা বোধ ছিলো না। সেসব গল্প মনে পড়ে। চারুকলায় আহত ছাত্রদের জন খারাপ লাগে।

স্থবির বসে থাকি। হাতে মাউস নিয়েই বসে থাকি, আঙ্গুল সরে না। কষ্ট হয়, ক্ষোভ হয়, তবে সব কিছু সয়ে যেতে হয়। সয়ে যাওয়াটাই নিয়ম। কোথা থেকে প্রতুলের গান ভেসে- আলু বেচো পটল বেচো বেচো বাকরখানি, বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।

ঝিঙে বেচো ৫ সিকেতে হাজার টাকায় সোনা। বন্ধু তোমার চোখের রঙ্গীন স্বপ্ন বেচো না। আশায় বুক বাধি। এই অস্থির দিন কেটে যাবে, অন্ধকারের স্থায়িত্ব যতই হোক সেটা চিরস্থায়ী অন্ধকারে ঢেকে রাখতে পারে না সবদিক, কোথাও না কোথাও এই অন্ধ সময়েও ভোর হয়। লেখা পড়ি, মানুষের ভালোবাসার গল্প জানি।

ভালো লাগে, পৃথিবীকে আগের মতোই সুন্দর মনে হয়। কতিপয় অন্ধকার দৃশ্য চোখ কষ্ট পেলেও এখনও অনেক সুন্দর দৃশ্যই থেকে গেলো চোখের অগোচরে। সামহোয়্যার বদলে গেছে। অনেক বদলে গেছে, এখন পেশাদার সাহিত্যিকের চাপ এখানে, কেউ কেউ ছোটো কাগজের লেখক, কেউ বড় কাগজের, কারো ৪ বই বের হয় কারো ২টা, কেউ বছরে একটা প্রসব করেই খুশী বাকি সবাইকে তার ছাগল মনে হয়, কেউ নিজের লেখাই পুণঃপ্রকাশ করে। এতসব লেখার ভীড়ে আমি মানুষের মুখ খুঁজি, মানুষের অনুভব খুঁজি।

সেই মানুষের অনুভব যারা একটা সময় বাঁচার আশ্বাস জাগাতো রীতিমতো। যাদের অনুভবের সাথে একাত্মতাবোধ করতাম। নির্মিত অনুভব নয়, সাধারণ মানুষের সাধারণ টুকরো মুহূর্তগুলো জুড়ে জুড়ে একটা কোলাজ। সে কোলাজের সব টেরাকোটা আজ মাটিতে ধ্বসে পড়েছে। এখন কস্টোমাইজেশনের যুগ।

অপেশাদার মানুষেরা নিজের অনুভব লিখে না লজ্জা দ্বিধায়। পেশাদার কলমশ্রমিকেরা এসে কখন কি ভুল ধরে বসে, ও লেখার কিছুই বুঝে না, ওর এটা ওর নল, ওরটা অনুকরণ আর ওরটা কিছুই হলো না। প্রতিদিন হাজার পাতা ভরে যায়, আমি খুঁজতে থাকি আমি খুঁজতে থাকি খুঁজতে থাকি মুখোশের আড়ালে ওয়েবের ক্যানভাসে মানুষের মুখ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।