আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে
সিকি শতাব্দী না পেড়ুনো এ জীবনে ১৯৮৯ সাল এসেছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে । ৮৯ আমাকে খাতা ভরে অ,আ,ক,খ লিখতে শিখিয়েছিল, বছর শেষে ২ এর সাথে ২ যোগ করতে শিখিয়েছিল । ৮৯ এ আমার বিশ্ব চেনার হাতেখড়ি,ইচ্ছামত কার্টুন না দেখতে পারার তীব্র কষ্টে বড় হওয়ার তীব্র আকুতি। বাবার সাথে ৮৯ তেই আমার ভার্চুয়াল বিশ্বভ্রমণ , তীব্র ফুটবল প্রেমের হালখাতা ।
৮৯ সালে আমাদের এলাকায় প্রথম ইরান টেলিভিশনের সম্প্রচারের সূচনা ।
সবে মাত্র বছর খানেক আগে ইরাক ইরান যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে । তার ধারাবাহিকতায় পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে সিগনাল পৌছে দেবার জন্য টেলিভিশন ট্রান্সমিশনের সুউচ্চ টাওয়ার বসানো শুরু হলো । ইরাক সীমান্তের খুব কাছাকাছি হওয়ায় এতদিন ইরাক টেলিভিশন ছাড়া অন্য কোন সিগনাল পাওয়া যেত না ।
যতটা মনে আছে ইরাক টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলোর সিংহভাগ জুড়েই থাকতো সাদ্দাম বন্দনা । খবরে দেখতাম ,সাদ্দাম সারাদেশ সফর করছেন , আর শিশুরা , নারীরা রাস্তার দু'পাশে তালি দিয়ে গান গাইছে ।
সঙ্গীতানুষ্ঠানগুলো জুড়ে থাকতো সাদ্দাম স্তুতি করে গাওয়া গান । প্রতি সপ্তাহে দেখানো হতো ২/৩ টি করে বলিউডের হিন্দি সিনেমা । বিকালের দিকে কার্টুন দেখানো হতো , কিন্তু আরবি ভাষার কারণে সেসবের কিছুই বুঝতাম না । টেলিভিশন দেখবার সময়টা আমার জন্য ছিল নির্দিষ্ট , মিনি স্কার্ট পড়া শিল্পীদের যেন না দেখি সে জন্যই কিনা , বাবা মা অনেক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখতেন ।
ইরান টেলিভিশন আমার সামনে যেন দিগন্ত খুলে দিল ।
হিন্দী সিনেমার বিপরীতে প্রতি সপ্তাহে প্রচারিত হতে লাগলো ফারসি ভাষায় ডাব করা জাপানি , ইতালিয়ান বা হলিউডের মুভি , ডাব করা জাপানি কার্টুন।
জাপানী মুভিগুলো ছিল মূলত সামাজিক আর পারিবারিক বন্ধনের উপর নির্মিত,ইরানী মুভিগুলোর সাথে খুব মিল রেখেই সম্ভবত মুভিগুলো সিলেকশন করা হতো । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন একটি স্কুলের ছাত্রদের আর তাদের মমতাময়ী ম্যাডামের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন জীবন কাহিনী নিয়ে একটা মুভির কথা আবছা মনে আছে । শিশু বয়সেই সেটার প্রভাব এত বেশি ছিল বলে , এখনও মুভির কিছু কিছু দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠার সাথে সাথে মনটা দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে উঠে ।
ফরাসী , ইতালিয়ান আর জার্মান মুভিগুলো সিলেকশনে মূলত রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা খেয়াল রাখা হত ।
সোভিয়েত বা মার্কিন দুই পরাশক্তির সাথে সম্পর্ক প্রচন্ড খারাপ হওয়ার কারণে খুব সুচারুভাবে দুই দেশের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরা হতো ।
ফরাসী একটি মুভিতে দেখেছিলাম চেকোস্লাভাকিয়াতে সোভিয়েত আগ্রাসনের ইতিহাস । একটি দৃশ্যের কথা মনে আছে যেখানে প্রেসিডেন্ট ডুপচেক(নামটা ভালো করে মনে নেই) কে সোভিয়েত সেনারা গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ।
পশ্চিম জার্মান একটি মুভিতে প্রথম চিনেছিলাম বার্লিন প্রাচীর কে । প্রাচীর পার হওয়ার প্রচেষ্টায় পূর্ব জার্মান এক তরুণের সুদীর্ঘ সাধনা , আর শেষ দৃশ্যে পূর্ব জার্মান সীমানা প্রহরীদের গুলিতে ছেলেটির খুলি ফেটে রক্ত বের হওয়া আজ এতগুলো বছর পরেও আমাকে আলোড়িত করে ।
হলিউডের মুভিগুলো সিলেকশনে রাজনৈতিক মুভির পাশাপাশি সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলোকে রাখা হত । সোভিয়েত মার্কিন শীতল যুদ্ধের সাথে প্রথম পরিচয় এমনই এক মুভিতে । ১৯৮০ সালে মস্কো অলিম্পিকস কাভার করতে যাওয়া ৩ ব্রিটিশ , আর ১ এক সুইডিশ সাংবাদিক কে বিনা কারণেই আটক করে সোভিয়েত কেজিবি । প্রহসনমূলক বিচার শেষে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় সাইবেরিয়ার বন্দী শিবিরে । তারপর বরফের প্রান্তর দিয়ে ট্রেনের সুদীর্ঘ যাত্রা , ৪ সাংবাদিকের ট্রেন থেকে পালিয়ে হাজার মাইলের যাত্রা ।
পথে প্রাণ হারায় দু'জন । তাদের মাংস খেয়েই বেঁচে যায় অন্য দু'জন । শেষ দৃশ্যে মৃতপ্রায় দু'জন নরওয়ে সীমান্তে এসে পৌছে যখন চিৎকার করে হেসে ফেলে , প্রবল উৎকন্ঠার মাঝেও আমার শিশুমন সাড়া দেয় , সম্ভবত আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হেসে উঠি।
একই সাথে দেখানো হতো কমিউনিস্ট দেশগুলোতে নির্মিত মুভি , সেসব ব্যবহার হত এন্টি-মার্কিন এজেন্ডা হিসেবে । এমন একটি মুভিতে দেখেছিলাম চিলির বামপন্থী সংগ্রামী প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আয়েন্দেকে ।
মার্কিন বাহিনীর সমর্থন নিয়ে ১৯৭৩ সালে জেনারেল পিনোশের মিলিটারি ক্যু এর মাধ্যমে আয়েন্দেকে উৎখাত , বিশ্বস্ত সঙ্গীদের অনুরোধ সত্ত্বেও দেশ ছাড়তে আয়েন্দের অস্বীকৃতি , জাতির উদ্দেশ্যে শেষ ভাষণ , সান্টিয়গোর রাস্তায় অসংখ্য বিপ্লবীকে চোখ বেঁধে হত্যা , আয়েন্দের প্রয়াণ পরে আমাকে এতটাই ভাবিয়েছিল বলে শৈশবের একটা বড় অংশ জুড়ে আয়েন্দে আমার জীবনের নায়কের স্থানটি দখল করে রেখেছিলেন।
ইরানি মুভি প্রচার হত যেদিন , কান্না লুকোনোর প্রস্তুতি নিয়ে বসতাম , আমার ধারণা ছিল ৩/৪ বছরের বেশি বয়সের কারও কান্না করা রীতিমত লজ্জার ব্যাপার , কান্না ঠেকানোর সংগ্রামটা সত্যি খুব কঠিন লাগতো।
বিশ্ব নিয়ে আমার এ আগ্রহের জন্মদাতা আমার বাবা । খাওয়া দাওয়া করতে চাইতাম না বাবা নতুন এক কৌশল আবিষ্কার করলেন । টোনা আর টুনি নামের দু'টো ছোট্ট পাখিকে জাপানের ওসাকা বন্দর থেকে যাত্রীবাহী জাহাজে চড়ালেন ।
তারপর কাহিনী স্ফীত থেকে স্ফীততর হয়ে সৃষ্টি হলো বিপদসঙ্কুল যাত্রাপথ । বছরকালের বেশি সময়ের দীর্ঘ এ যাত্রাপথে টোনাটুনি পার হলো সাংহাই , জাকার্তা , চট্টগ্রাম , কলম্বো , এডেন হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের দার-আস-সালাম , দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন , ফ্রিটাউন , আবিদজান সহ সমগ্র আফ্রিকার পূর্ব উপকূল । গল্পের লোভে রুদ্ধশ্বাসে আমি বাবার হাত থেকে প্রতিটি খাবারের লোকমা বিনা বাক্য ব্যয়ে মুখে তুলে নিতাম । বছর শেষে পৃথিবীর অনেকটা অংশের নাম আমার চেনা জানার মাঝে এসে গেলো ।
বড় হতে চাইতাম প্রতিনিয়ত ।
ছোট ছিলাম বলে মনে হতো আমি তীব্র অবহেলার শিকার , সব ব্যথার উৎস ছিল কার্টুন দেখাকে কেন্দ্র করে । দিনে দু'ঘন্টা সময় বরাদ্দ ছিল কার্টুন দেখার জন্য , কিন্তু আমার মন চাইতো সারাটা দিন কার্টুন দেখতে । এ সময়টা বরাদ্দ করতো আমার মা , দু'ঘন্টা যখন শেষ হওয়ার পথে তখন কেবলই মনে হত , কবে বড় হয়ে সকাল সন্ধ্যা দু'বেলা কার্টুন দেখতে পারবো ।
কার্টুনগুলোর অধিকাংশ ছিল জাপানি । অসংখ্য শিক্ষামূলক অ্যানিমেশন কার্টুনের মাঝে আমার প্রিয় ছিল "একিয়ো সান"।
ছোট্ট বালক "একিয়ো সান" , সামুরাইদের মোকাবেলার জন্য বেছে নিয়েছিল গণিত আর ধাধা ।
জার্মান একটি কার্টুন ছিল "উরুজ্যাক" । এ ফিল্মের সবগুলো চরিত্র ছিল বাস্তব , কেবল উরুজ্যাক ছিল কাগজে আঁকা অ্যানিমেশন । অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ক্ষমতার অধিকারী উরুজ্যাক তার কাঠমিস্ত্রী মনিবকে সাহায্য করতে গিয়ে অনেক মজার দৃশ্যের জন্মদিত ।
জাপানিজ আরেকটি কার্টুন খুব প্রিয় ছিল আমার , "ডক্টর সিমসন" ।
ব্রিটেন থেকে অস্ট্রেলিয়া যাবার পথে জাহাজডুবির পর বেঁচে যায় কেবল ড্ক্টর সিমসন এবং তার পরিবার । নির্জন দ্বীপে উদ্ধারের আশায় কেটে যায় অনেকগুলো বছর , চলতে থাকে কঠিন জীবন সংগ্রাম ।
সেবছরই প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল দেখা , কাকতালীয়ভাবে ম্যাচটি ছিল ব্রাজিল আর্জেন্টিনার ম্যাচ । চোখ বন্ধ করে যখন ম্যাচটির কমেন্ট্রির শুনার চেষ্টা করি , উত্তেজিত কন্ঠের এক অচেনা ভাষা শুনি , বুঝতে বাকি থাকে না , সেদিনের ধারাভাষ্য ছিল স্প্যানিশে । ম্যাচটি ১-১ এ শেষ হয় ।
চারিদিকে তখন আর্জেন্টিনা জোয়ার , সেসবের ঢেউ এসে লেগেছিল আমাদের শিশুদের মাঝেও । আমার মাঝে একটা প্রবল ধরণের রিপালসিভ ফোর্স মাঝে মাঝে দানা বাধে , স্রোতের বিপরীতে আমি ব্রাজিলকে ভালোবেসে ফেললাম , আমার আরেক বন্ধুকেও ব্রাজিল সমর্থক বানিয়ে ফেললাম । ৯১ সালে যখন একটু খেলা বুঝতে শিখে গেছি , তখন বুঝতে বাকি রইলো না , ব্রাজিলই নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সেরা ফুটবলটি খেলে । একদিন আব্বু ম্যারাডোনা লেখা একটি আর্জেন্টিনার জার্সি এনে দিলেন । নানা অজুহাতে সে জার্সিটি কখনো গায়ে দিতাম না ।
৮৯ জন্ম দিলো খেলাধুলা আর রাজনীতি সচেতন এক জ্যাক অব সাম ট্রেডস , বাট মাস্টার অব নান এর ।
চলবে ...........................
পরবর্তী পর্ব (১৯৯০-১৯৯২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।