www.cameraman-blog.com/
হাজত (এর করিডোর) বাস - ১
একটু পরেই সেন্ট্রি এসে জিজ্ঞাসা করলো - রন্জু কে ? বলেই করিডোরের গেট খুললো। আমি এগিয়ে যেতেই হামিদ পিছন থেকে বললো - ভাই আমার ভাইকে একটু বলবেন। আমি আর পিছনে তাকাতে পারলাম না। নিজেকে খুব ছোট আর স্বার্থপর মনে হচ্ছিলো। ওসির রুমে ঢুকেই দেখি আব্বা বসে আছে।
বাবুর ফুফুও দেখি চলে এসেছেন। ওসি সাহেব দেখতে বেশ চমৎকার, দেখে মনেই হয়না পুলিশ। ঢুকে ভদ্রলোকের ছেলের মতো ওসিকে সালাম দিলাম। ওসি সালামের উত্তর না দিয়ে বললেন
- নাম কি ?
আমি পুরো নামই বললাম।
- আরে ছোট নাম বলো ?
- জ্বী, রন্জু।
- বাড়ী কোথায় ?
- টাঙ্গাইল।
- কোন থানা ? কোন গ্রাম ?
- কালিহাতি থানা। গ্রামের নাম পাছ চাড়ান।
- .... ডাক্তার কে চিন ?
- জ্বি।
- ...... ডাক্তার যদি জানে অমুক এর ছেলেকে আমার লোকজন থানায় ধরে এনেছিল, তাহলে ?
আমি নিরুত্তর থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।
- কি কর ?
- বি.কম. পাশ করেছি। কিছু করছিনা।
- কিছু করবা না, পাড়ার মেয়েদের সাথে টাঙ্কি মারবা ওইতো তোমাদের কাজ। লজ্জা করে না বাপের ঘাড়ের উপর বইসা খাও।
- জ্বি।
যদি অনুমতি দেন, আমার একটা বায়োডাটা আপনাকে কালই দিয়ে যাব। আর ভাল লাগছেনা। কাজের আসলে খুবই দরকার। কিন্তু পাচ্ছি না।
আমার কথায় ওসি সাহেব সমবেত ভদ্রলোকজনের দিকে ফিরে বললেন
- আজকালকার ছেলেদের দেখেন।
মূখে মূখে কথা বলে। (বুঝলাম ওসি সাহেব ঘাড় থেকে আপদ বিদায় করলেন)
- এই তুমি টিশার্ট পড়ছো কেন ? ভদ্রলোকের ছেলেরা কি টিশার্ট পড়ে নাকি। এই এক ফ্যাশন হইছে - ভদ্রলোকের ছেলে পড়বে সাদা হাফশার্ট, কটন প্যান্ট আর পায়ে দিবে কাবলি স্যান্ডেল নয়তো অক্সফোর্ড সু। আর এরা পড়বে টিশার্ট, জিন্সের প্যান্ট আর কেডস। যেন সব মাস্তান।
(ওসি সাহেব তার জ্ঞান উন্মুক্ত করলেন)
আব্বা মূখ কালো করে বললেন
- টিশার্ট টা আমি মাস দু'য়েক আগে ফিলিপাইন থেকে এনে দিয়েছি।
পূত্রের দেখাদেখি পিতার এহেন বেয়াদবীতে ওসি সাহেব আমার আরো খূঁত বের করতে সচেষ্ট হলেন।
- কটন প্যান্ট তো পড়ছো। দেখি পায়ে কি দিস ? আমি ওকটু পাশে সরলাম তার দেখার জন্য, কিন্তু পায়ে বাটার স্যান্ডেল দেখে মনে হয় কিছুটা হতাশ হলেন।
এই পর্যায়ে সবার অনূরোধে তুষার, ফারুক আর বাবুকেও আনা হলো।
হাউ ফাইন হামিদের জন্য কেউ না আসায় বেচারাকে আর আনা হলো না। ফারুককে দেখে মনে হয় ওসি সাহেব রীতিমতো টাসকি খেলেন। আমাদের ৪ জনের মধ্যে ফারুক হলো সবচেয়ে হ্যান্ডসাম আর ফ্যাশন সচেতন।
- এই তুমি কি সিনেমায় নামছো নাকি ? মিঠুন চক্রবর্তীর মতো করে চুল কাটছো ! তুমি না শিক্ষকের ছেলে। ছিঃ ছিঃ! স্যার, আপনে অন্যের ছেলেদের মানুষ করেন আর নিজের ছেলের কি হাল ধেখেন না ? (ফারুকের আব্বা এহেন বাক্যবাণে থতমত খেলেন) দেখি কি পড়ছো ? (ফারুকের গায়ে ছিল শার্ট, জিন্সের প্যান্ট আর কেডস) তোমার কাপড়-চোপড়ও তো দেখি ঠিক নাই।
আবার মাস্তানদের মতো শার্টের হাতা গুটাইছো।
এরপর বাবুর পালা। বাবুর ড্রেস-আপ ক্ল্যাসিক ছিল মানে হাফ শার্ট, কটন প্যান্ট আর স্যান্ডেল, তাই ওসি সাহেব সেদিকে আর গেলেন না। পড়াশোনা নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা হলো। আর এর ফাকেই ওসি সাহেবের অভিজ্ঞ পুলিশি চোখ বাবুর ডান হাতের কাচা দাগ আবিস্কার করে ফেলেছে।
- এই ছেলে ওটা কিসের দাগ ? দেখি, ওদিকে আসো দেখি। বাবু তার সামনে গিয়ে দাড়াতেই আরো কিছু দাগ পাওয়া গেল।
- ম্যাডাম। আপনি তো ডাক্তার। বলেন দেখি এগুলো কিসের দাগ ? (আবিস্কারের আনন্দে বাবুর ফুফুকেই প্রশ্ন করলেন)
- ছুরির।
- ছুরি না, ছুরি না। এগুলো ড্যাগারের দাগ। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিবে। এমনি এমনিই কি আর রমনা থানার ওসি হলাম। কি ঠিক বলছি না ? (এবার বাবুর সমর্থন চাইলেন)
- স্যার, বরিশালে আমার শত্রুরা একা পাইয়া পোঁচ দিসিলো।
- শত্রু !!! ভদ্রলোকের শত্রু থাকে নাকি। তুমি আস্ত একটা ক্রিমিনাল। ঘোষণা বরলেন ওসি। বাবুর ফুফু কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে ওসি এবার তুষারকে নিয়ে পড়লেন।
মিচকা শয়তান তুষার এতোক্ষণ ঝিম মেরে ছিল।
আর তার ড্রেস-আপও ছিল সুপার ক্ল্যাসিক, কারণ একমাত্র সেই কাবলী স্যান্ডেল পড়া ছিল। টুকটাক যেসব প্রশ্ন করা হলো সে অতিশয় ভদ্রছেলের মতো পিছনে দুই হাত বেধে (আরামে দাঁড়াও ভঙ্গিতে) মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে উত্তর দিয়ে গেল।
- এই ছেলেটা খুব ভাল। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। বললেন ওসি।
এরপর ওসি তার জ্ঞানগর্ভ মতামত তুলে ধরলেন।
- বাবু একটা ক্রিমিনাল। ওর ১০০% মানে ১৬ আনাই খারাপ। ম্যাডাম, আপনি সরকারী কর্মকর্তা। আমার কাছে আর রিকোয়েষ্ট করবেন না।
ও আজকের রাতটা এখানেই কাটাবে। কাল ১২টার দিকে এসে নিয়ে যাবেন।
- ফারুক একজন শিক্ষকের ছেলে, অথচ ওর চুলকাটা আর পোষাক-আষাক তা বলেনা। তবে ও ক্রিমিনাল না। ওর আট আনা ভাল আট আনা খারাপ।
ওকে নিয়ে যান মাষ্টার সাহেব। তবে একটু শাসন করবেন।
- রন্জুর বেশির ভাগটাই ভাল, তবে ওর টিশার্ট পড়াটা ভাল লাগে নাই। ওর চার আনা খারাপ আর বার আনা ভাল। আর তুষারের সব কিছুই ভাল।
একদম ভদ্রলোকের ছেলে। বলে তুষারের পিঠটা একটু চাপরে দিলেন ওসি সাহেব।
আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
- তোমার জন্য কে ফোন করেছিল জান ?
- জ্বী।
- তার পর্যায়ের অফিসাররা আমাদের মতো ওসিদের ফোন করেন না। তার সন্মানটা রাখতে চেষ্টা করো।
যাও।
বের হয়ে আসছি থানা থেকে হামিদ করুণ কন্ঠে জানতে চাইলো - আপনাদরন ছেঢ়ে দিয়েছে ?
কি আর বলবো। ফারুকের আব্বা বললেন - আমি গিয়ে তোমার ভাইকে পাঠাচ্ছি।
পরের দিন ডি.আই.জি. মামা ফোন করে আব্বাকে বলেছিলেন আমি যেন সাবধানে চলাফেরা করি। কারণ পুলিশ খুব শীঘ্রই একশনে যাবে।
এর ঠিক দু'দিন পরই শুরু হয়েছিল মাস্তান ধরা অভিযান। আর পরবর্তী এক-দুই মাস আমাদের গ্রাউন্ডেড করে রাখা হয়েছিল। , মানে নো আড্ডা - নো বাইরে ঘোরাঘুরি।
সেরাতে ফারুকের আব্বা বলেও হামাদের ভাইকে থানায় পাঠাতে পারেন নাই। পুলিশ তার ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়াতে তার নাকি মান-সন্মান সব ভূলন্ঠিত।
পরের দিন বাবু আর হামিদ যথা সময়েই ছাড়া পেয়েছিল।
১. বাবুর জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। ওর ফুফুই ওকে বড় করেন। মহিলা এই ভাতিজার জন্য জীবনে বিয়েই করেননি। অথচ বাবুর আব্বা ঠিকই আরেকটা বিয়ে করেছিলেন।
শেষবার যখন বাবুর সাথে ধেখা হয় ও তখন বরিশালে এক ঔষধ কোম্পানির কর্মকর্তা।
২. হামিদ গ্রামের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। কথায় কথায় হাউ ফাইন বলতো বলে ওর নাম হয়ে গেছিলো 'হাউ ফাইন হামিদ'। বড় ভাইটা পড়াশোনায় ভাল ছিলো। ছাকরি পেয়েছিলো ফরেন সার্ভিসে।
ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছিল ঢাকায় পড়াশোনা করার জন্য। কিন্তু এক সেক্রেটারির মেয়েকে বিয়ে করে জাতে উঠার পর সব বদলে যেতে থাকে। এই ঘটনার পর হামিদের ঢাকায় থাকার ভিসা বাতিল হয়ে যায়। এরপর আর দেখা হয়নি ওর সাথে।
৩. তুষার আমেরিকা হয়ে এখন কানাডায় আছে।
৫/৬ বছর আগে একবার দেখা হয়েছিল।
৪. ফারুক ঢাকাতেই আছে। বড় ব্যবসায়ী। আমার সাথে এখনও ভাল বন্ধুত্ব।
ছবি : বারডেম, শাহবাগ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।