www.cameraman-blog.com/
সালটা ১৯৮৮। আব্বার চাকরির সুবাদে তখন থাকি বেইলী রোডের সরকারী কোয়ার্টার বেইলী স্কয়ারে। ডিগ্রি পাস করে পুরাই বেকার। না আছে কোন পড়ালেখা, না কোন কাজকর্ম। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে সোজা ক্লাবে, সেখানে তাস খেলা কিংবা ক্যারাম।
দুপুরে গোসল-খাওয়া সেরে সামান্য দিবানিদ্রা। এরপর বিকালে কোয়ার্টারের এমাথা ওমাথা পায়চারী করে মেয়েদের দেখে-টেখে রাখা। আর সন্ধ্যার পর ক্লাবে কিংবা মাঠে অথবা কোন বিল্ডিং এর সামনে বসে আড্ডা। এই ছিলো তখন আমাদের প্রায় প্রতিদিনকার রুটিন। সময়টা তখন হো.মো. এরশাদের, দেশের রাজনৈতিক কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনটাই ভাল না।
বেইলী স্কয়ারের পিছনেই ছিল রমনা থানা। আমরা বিকালে কিংবা সন্ধ্যার পর প্রায়ই দেখতাম পুলিশ টেম্পো নিয়ে অভিযানে বেরোচ্ছে বা অভিযান শেষে ফেরত আসছে। মাঝে মধ্যে বেরসিকের মতো কোয়ার্টারে ঢুকে আমাদেরকেও ঘেরাও করতো। এরপর চলতো নানারকম প্রশ্ন - আমরা কারা, রাতে পড়ালেখা না করে আড্ডা দিচ্ছি কেন ইত্যাদি। তবে বেশীরভাগ সময় সরকারী কর্মকর্তার ছেলে এই পরিচয় (যা ওরাও জানতো) পেলেই বলতো দিনকাল ভাল না বাসায় চলে যান।
আমরাও নিখাদ ভদ্রলোকের ছেলের মতো বাসায় চলে যেতাম। এভাবে চলছিলো ভালই।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো একদিন।
বরাবরের মতো বৈকালিক কোয়ার্টার পরিভ্রমণ শেষে ৬ নাম্বার বিল্ডিং এর সামনে মাঙ্কি রাইডারের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছি। সন্ধ্যা ৭টা - সাড়ে ৭টার মতো বাজে।
পরের দিন কি একটা পরীক্ষা আছে বলে শাহিন চলে গেল। আর ওর শুন্যস্থান পূরণ করতেই মনে হয় তুষারের আগমন ঘটলো। দুই চোখ লাল। বুঝলাম কোথা থেকে হয়তো দম দিয়ে এসেছে। ঠিক সেই সময়েই দেখা গেলো একটা টেম্পো ধীর গতিতে ভেতরে ঢুকছে।
পরিচিত দৃশ্য। সাদা পোশাকের দুই-একজন দেখলাম নেমেও পড়েছে। টেম্পোটা ঠিক আমাদের সামনে এসে থামলো। একজন শার্ট-প্যান্ট পড়া ওয়াকিটকি হাতে আর একজন লুঙ্গি পড়া হাতে বাজারের ব্যাগ, নেমে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। উল্টা দিকের ষ্ট্রীট লাইটের আলো বাজারের ব্যাগের উপর পড়ায় আমরা সবাই বুঝলাম ওটাতে একটা ষ্টেনগান বহন করা হচ্ছে।
ব্যাপক আয়োজন। আমরা কিন্তু বসেই আছি - সরকারী কর্মকর্তার ছেলে তো। পাঁচজনে মিলে আমাদের এমনভাবে ঘেরাও করে দাড়াল যাতে কেউ ইচ্ছা করলেও দৌড়ে পালাতে না পারি। রীতিমতো প্রফেশনাল কাজ। ওয়াকিটকি হাতে ভদ্রলোক প্রশ্ন শুরু করলেন - পরিচয় কি, কোথায় থাকি, কি করি ইত্যাদি নিস্কলুষ পুলিশীয় প্রশ্ন।
আমরাও নিতান্ত গোবেচারা সেজে উত্তর দিয়ে গেলাম। সব শুনে বদ্রলোক অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন আমাদের থানায় যেতে হবে। বলে কি ??? থানায় !!! তুষার হঠাৎ করেই লাফ দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ঐ লাফ দেয়া পর্যন্তই, সাথে সাথেই কট বিহাইন্ড হয়ে গেল। মানে তুষারের পেছনে দাড়ানো লোকটা ওকে আলগোছে ধরে ফেললো।
সেদিনই প্রথম দেখলাম এবং জানলাম পুলিশ কিভাবে যেন বেল্টের হুকের দুইপাশ দিয়ে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে ধরে, নড়াচড়া করার কোন উপায় থাকে না। আমরা তো এদিকে বিস্তর চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছি - আরে এটা কি মগের মূল্লুক নাকি, কোয়ার্টারের ছেলেদের ধরে নিয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। যেতেই হবে। অগত্যা আমি, বাবু আর হাউ ফাইন হামিদ বিনা বাক্য ব্যয়ে টেম্পোতে উঠে বসলাম, তুষার আর ফারুককে তুলতে ওদের একটু কসরত করতে হলো।
এরমধ্যে ফারুকের আব্বা-আম্মা আর তুষারের আব্বা খবর পেয়ে নিচে নেমে এসেছেন। টেম্পো থামিয়ে তারা এহেন কর্মকান্ডের ব্যাখ্যা দাবী করলেন। ওয়াকিটকিধারী ভদ্রলোক সবিনয়ে জানালেন উপরের নির্দেশ, তার নাকি কিছুই করার নাই। ধরে নিতেই হবে। পরিশেষে সে থানায় আসার আমন্ত্রণ নাকি নিমন্ত্রণ করে পাঁচ হতভাগাকে নিয়ে রওনা হলো।
এক মিনিটও লাগলোনা, থানায় চলে আসলাম। আহা ! এই সেই রমনা থানা। কত কাজে-অকাজে এর আশ-পাশ দিয়ে কত লক্ষ-হাজারবার আসা-যাওয়া করেছি, অথচ একবারের জন্যও ভিতরে ঢুকে দেখি নাই কি আছে, কারা আছে। আফসোস !!! আর আজ - একেবারে থানার গাড়ীতে করে অফিসিয়াল ভিজিটে চলে আসলাম। কার যে মূখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলাম হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না।
যিনি ধরে এনেছিলেন, সেই এ.এস.আই. আমাদেরকে ডিউটি অফিসার এস.আই. এর হাতে গছিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন। আর ডিউটি অফিসার আমাদের নাম-ঠিকানা একটা খাতায় লেখার উদ্যোগ নিচ্ছেন। আর যায় কোথায়। আবার শুরু হলো আমাদের সমস্বরে ফ্রি-ষ্টাইল চেঁচামেচি - আমরা কি অপরাধী নাকি, আমাদের কি গ্রোফতার করা হয়েছে নাকি ইত্যাদি। এরমধ্যে তুষারের আব্বা আর ফারুকের আব্বা থানায় এসে হাজির।
তাদেরকে কাছে পেয়ে আমরা কাঁদ কাঁদ স্বরে বললাম - আঙ্কেল দেখেন ওনারা আমাদের নাম-ঠিকানা লিখতে চাইছে। আমাদের কি এরেষ্ট করা হয়েছে ? তুষার দেখি শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছতেছে আর ফারুক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তুষারের আব্বা একটু রাগতঃ স্বরেই ডিউটি অফিসারকে বললেন যে তিনি ফাইন্যন্স মিনিষ্ট্রির জয়েন্ট সেক্রেটারী, মাত্র মাস দু'য়েক হয় হোম মিনিষ্ট্রি থেকে বদলি হয়ে এসেছেন। তার পরিচয় পেয়ে ডিউটি অফিসার দুই আঙ্কেলকে ওসি সাহেবের রুমে নিয়ে বসালো। ভিতরে গিয়ে কি কথা হলো জানি না, তবে আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই থাকলাম।
হঠাৎ দেখি আব্বা। তার বগলে একটা ফোল্ডিং ছাতা। রাতের বেলা ছাতার প্রয়োজন কেন হলো ঠিক বুঝলাম না, বৃষ্টি-বাদলের তো কোন সম্ভাবনা দেখি নাই। আব্বাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম কে খবর দিয়েছে। উত্তরে আব্বা বললো ফারুকের আব্বা শাহিনকে দিয়ে খবর দিয়েছে।
ওসির রুমে ঢুকেই আব্বা আবার বেরিয়ে এলো, আমাকে বললো শিখা আপার মামার কাছে যাচ্ছে। শিখা আপা হলো আমার বোনের বান্ধবী আর আব্বার ইমিডিয়েট বসের মেয়ে আর তার মামা হলো পুলিশের ডি.আই.জি.। কথাটা মনে আসতেই একগাল হাসলাম। যাক বাঁচা গেল এযাত্রা। ঘরের এককোনে দেখলাম প্রচুর ম্যাগাজিন স্তুপ করে রাখা আর পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে পছন্দ সই ম্যাগাজিন বা চটি বই উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কেউ কেউ টেবিলে বসেই ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছে। এদিকে এক বয়স্ক কনষ্টেবল আমাদের ৫জনকে হাজতে ঢোকানোর তোড়জোড় করতেছে। আবার শুরু করলাম সমস্বরে চেঁচামেচি। সিনে আবারও তুষারের আব্বা - এইবার কিছুটা বাকবিতন্ডা হলো তার সাথে। ডিউটি অফিসার হাত জোড় করে বার বার একই কথা বলতেছে - স্যার আমার চাকরিটা খাইয়েন না।
ওসি স্যার আপনাদের সাথে পারবে না, কিন্তু আমার লাইফ নরক বানাইয়া ফেলবে। একটু বোঝার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত আপোষ হলো - আমাদের হাজতে ঢোকানো হবে না। তার বদলে হাজতের সামনে এক চিলতে একটা করিডোর আছে, সেখানে ঢুকতে হবে। ঢুকলাম সেখানে।
ঢোকার আগে আমাদের পকেটে যা ছিলো (টাকা বাদে) সব বের করে দিতে হলো, সাথে হাতের ঘড়িও। জানলাম প্রতিটা থানায় দু'টো করে হাজত থাকে - একটা ছেলেদের, আরেকটা মেয়েদের। দু'টো হাজতই পাশাপাশি, আলাদা দু'টো গেট। আর দুই হাজতের সামনে একচিলতে একটা করিডোর আর সেটার আরেকটা গেট। তারমানে আপনি হাজত থেকে পালাতে চাইলে কমপক্ষে দু'টো গেট ভাঙ্গতে হবে।
ঢোকার পর মনে হলো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘেলাম। সবারই মূখ শুকনো। কি আর করা। ঘুরে ফিরে হাজতটা আসলে কেমন বোঝার চেষ্টা করলাম। মেয়েদের হাজতটা খালি, ছেলেদের হাজতে দু'টো লোক।
প্রতিটা হাজতেই একটা করে বাথরুম আছে যার কোন দরজা নাই, মানে দরজার পাল্লা নাই। তার বদলে একফালি চটের পর্দা। কিছুক্ষণ পরপরই ইউরিনের গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা মারছিলো। যে দু'জন লোক হাজতে ছিলো তাদের সাথে কথা বললাম। দু'জনেই গুলিস্থানে ম্যাগাজিন বিক্রি করে।
তবে মূল ব্যবসা হলো চটি বিক্রি। পুলিশ তাদেরকে চটি সহই ধরে এনেছে। এতোক্ষণে স্তুপ করে রাখা ম্যাগাজিনের রহস্য বুঝলাম। তাদের কাছ থেকে আরো জানলাম, কাল ওদেরকে কোর্টে তুললে কেউ না কেউ ছাড়িয়ে নেবে। বিনিময়ে ??? যদি ২০০ টাকা খরচ করে থাকে তো আদায় করবে ৫০০ টাকা।
এটা নাকি কারও কারও ব্যবসা। হায়রে দূনিয়া !!! আমাদের সাথে কথা বলে দেখলাম দু'জনেই ঘুমের আয়োজন করছে। এবং আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকাতে শুরু করলো।
এদিকে আমাদের সময় তো আর কাটতে চায় না। কয়টা যে বাজে সেটাও বুঝতে পারছি না।
সেই কোন বিকালে নাস্তা করেছিলাম, ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। একসময় ক্ষুধাও মরে গেল। সারা শরীরে কেমন জানি একটা অবসন্ন ভাব। এরমধ্যে একবার তুষারের আব্বা এসে দেখে গেছেন। এরশাদ নাকি কার বিয়ে খেতে অফিসার্স ক্লাবে এসেছে, ওসি সেখানে।
প্রেসিডেন্ট না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের কোন আশা নাই। হঠাৎ চারিদিক সচকিত করে দিয়ে বেজে উঠলো সেন্ট্রির হুইসেল। কে যেন একজন দ্রুত পায়ে থানায় ঢুকলো। আমাদের সামনে দাঢ়ানো বুড়ো সেন্ট্রিও দেখলাম আলগোছে হাত তুলে সালাম নাকি স্যালুট দিল। কে জানতে চাইলে বললো - ওসি।
আমরাও একটু নড়ে-চড়ে দাড়ালাম।
(ক্রমশ...)
ছবি : মেঘের ছবি দিলাম কয়েকটা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।