আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'উৎকৃষ্ট' সামরিকতন্ত্রের চেয়ে 'নিকৃষ্ট' গণতন্ত্র বহুগুণ ভালো



প্রশ্ন : ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির রাজনৈতিক পরিবর্তনকে '১/১১-এর পরিবর্তন' বলা হয় কেন? আমরা তো সাধারণত ১১ জানুয়ারি ২০০৭ কে ১১-১-২০০৭ লিখি, ১-১১-২০০৭ বলতে বুঝি পয়লা নভেম্বর ২০০৭। ওই স্টাইলে লেখে আমেরিকানরা। যেমন ৯ সেপ্টেম্বর ২০০১ কে তারা লেখে ৯/১১/২০০১! এইভাবে বলে বলে আমাদেরকে কি আমেরিকান ব্যবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত করার চেষ্টা চলছে? কারণ কি? তথাকথিত ১/১১-এর পরিবর্তনের পর আমরা একটি কথা অহরহই শুনে এসেছি যে, গত পনের বছরে গণতান্ত্রিক সরকার ও রাজনীতিবিদেরা মিলে এ দেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। যেন সব দোষ এই গণতন্ত্র-বিশ্বাসী রাজনীতিকদের। যেন এর আগের সরকারগুলো (জিয়া বা এরশাদের সামরিক সরকার) দেশকে প্রায় সোনার দেশ বানিয়েই ফেলেছিলো, রাজনীতিকদের হটকারিতায় সেটি সম্ভব হয়নি।

গত পনের বছরের গণতন্ত্র-চর্চা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি, একথা ঠিক। অনেক বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতাও সুখের নয়, তা-ও সত্যি। অনেক অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার কথা আমি নিজেই বলতে পারি। যেমন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস, সংসদ অধিবেশন বর্জন, সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না করে রাজপথকেই ব্যবহার করা, বিদেশীদের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নীকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অসহায় আত্নসমর্পণ এবং তাদেরকে 'মাতব্বর'-এর ভূমিকায় অধিষ্ঠিত করা ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু তাই নয়- গত কয়েক বছরে আমরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় সামপ্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিপুল উত্থান দেখেছি।

দেখেছি একই পরিবারের এগারোজন সদস্যকে ঘরে আটকিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, পুড়ে মারা গেছে তারা, তাদের অপরাধ- তারা হিন্দু, সংখ্যালঘু। শুনেছি ঘরের মধ্যে কিশোরী মেয়ে, দরজায় মা মিনতি করছে- তোমরা একজন একজন করে যাও বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট, একসঙ্গে এতজনকে নিতে পারবে না। জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের তামাশা দেখেছি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী ও দেশের প্রধানমন্ত্রী আল বদর বাহিনীর প্রধানকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন! দেশজুড়ে কেবল বোমার শব্দ শুনেছি- রমনার বটমূলে বৈশাখ বরণে, উদীচীর অনুষ্ঠানে, সিপিবির সমাবেশে, গোপালগঞ্জের গীর্জায়, আহমদীয়া মসজিদে, ময়মনসিংহের সিনেমা হলে, শহীদ মিনারে, হযরত শাহজালালের মাজারে... আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছে, হুমায়ুন আজাদের মতো বরেণ্য লেখক আক্রান্ত হয়েছেন, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বুলুর মতো সাংবাদিকরা নিহত হয়েছেন, সাংবাদিকদের কাফনের কাপড় পাঠানো হয়েছে সত্য বলার অপরাধে, বিআরটিসি বাসে আগুন দেয়া হয়েছে, এগারোজন নিরীহ মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দেখেছি, যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করা হয়েছে সেই পাকিস্তানি ভুত আবার প্রবল বিক্রমে ফিরে আসছে, রাজাকাররা বলছে- একাত্তরে আমরা কোনো ভুল করিনি, তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে মোটাকাটা ক্ষমতাধর এক মন্ত্রী- একাত্তরে পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়ে তারা কোনো অপরাধ করেনি! দেখেছি, জিহাদ আর শ্রেণীসংগ্রাম সমার্থক বলে প্রচার করতে চাইছে কোনো কোনো ধুরন্ধর বুদ্ধিজীবী... তো এতকিছু দেখে কোনো সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে কি সুস্থ থাকা সম্ভব? সম্ভব নয়। একটা কথা আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, কোনো দেশেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা ছাড়া মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ-সামপ্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠা পায় না।

জনগণের মধ্যে এগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, থাকে না। কারণ মৌলবাদ মানুষের মৌলিক প্রবণতা নয়, বরং স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাপার। স্বভাবতই মানুষ মুক্ত হতে চায় আর মৌলবাদ চায় মানুষকে নানারকম শৃঙ্খলে বন্দি করতে। তো এত এত নেতিবাচক অভিজ্ঞতার পরও এমন অনেক অর্জনও হয়েছে এই পনের বছরে, যা এর আগে কখনোই হয়নি। এরশাদ সরকারের শেষদিকের বাজেটেও দেখেছি, অভ্যন্তরিণ সম্পদের যোগান ছিলো মাত্র ৬/৭ ভাগ, বাকিটা বিদেশী সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

পনের বছরের গণতন্ত্র চর্চা সেখান থেকে টেনে বাজেটের ৬৫/৬৬ ভাগই অভ্যন্তরিন সম্পদ থেকে যোগান দিতে পেরেছে। ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বেড়েছে। দেশের অর্থনীতির চাকা হাজার সমস্যা সত্ত্বেও সচল থেকেছে। রাষ্ট্র সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশও যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ রেখেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তাঁর আমলেই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিলো।

জিনিসপত্রের দামও জনগণের নাগালের মধ্যে ছিলো। গণমাধ্যমগুলোও এই সময়ে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করেছে। আর এখন? এখন আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা এক কথায় বীভৎস। আমরা, শিক্ষিত মানুষেরা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বারোটা বাজিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। সমাজ থেকে শুভ ও কল্যাণবোধগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।

নৈতিকতা, সততা, সত্যবাদিতা এই শব্দগুলো বাস্তব জীবন থেকে প্রায় নির্বাসিত হয়ে নিছক আভিধানিক শব্দে পরিণত হতে চলেছে। যারা এখন পর্যন্ত সততা নিয়ে বাঁচতে চায়, মেরুদণ্ড সোজা রেখে, মাথা উঁচু করে চলতে চায় তারা প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন কর্তাব্যক্তিদের ব্যর্থতা ও ভুলের জন্য মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করাই এখন দেশের ৯৯ ভাগ মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়েছে। বহু মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। গণমাধ্যম্যের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। জিনিপত্রের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে।

এটা সামলে উঠতে ঠিক কতদিন যে সময় লাগবে বলা কঠিন। দোষ যারই হোক, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এই ডিসকন্টিনিউটি দেশের জন্য সুদূরপ্রসারী খারাপ প্রভাব বয়ে আনবে। যে-কোনো মূল্যে প্রক্রিয়াটি চালু রাখা দরকার ছিলো। যে-কোনো দেশেই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে একটানা ২৫/৩০ বছর সময় দিতে হয়, আমরা ১৫ বছর পার করতে না করতে হোঁচট খেলাম। এখন আমাদের আবার নতুন করে শুরু করতে হবে, কিন্তু সেটি খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হয় না।

দেশে এখন একধরনের অপ্রকাশ্য সামরিকতন্ত্র চলছে। প্রকাশ্যই হোক আর অপ্রকাশ্যই হোক, 'উৎকৃষ্ট' সামরিকতন্ত্রের চেয়ে নিকৃষ্ট গণতন্ত্র বহুগুণ ভালো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে যত অনাচার-অবিচার-অন্যায় হোক না কেন, সেগুলো জানার একটা উপায় থাকে, সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটা পথ জনগণের সামনে খোলা থাকে। সবাই যে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন তা তো নয়, এই প্রতিবাদগুলো তাই প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না করা মানুষকেও সচেতন করে তোলে। সমাজের ভেতরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি মূল্যবোধ তখন তৈরি হতে থাকে।

সামরিকতন্ত্রে ঘটে ঠিক এর উল্টোটি। সবকিছু গোপনে সংঘটিত হয় বলে এবং প্রতিবাদ প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকার ফলে, একদিকে যেমন জনগণের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ জমা হতে থাকে অন্যদিকে একসময় এদের দ্বারা অনাচারগুলো সমাজের কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, সমাজ তখন তার নৈতিকতা ও মূল্যবোধ হারায়। এরশাদের আমলে এটি বিপুলভাবে ঘটতে দেখেছি। জাতি হিসেবে আমাদের নৈতিক অধপতনের শুরুও ওই সময় থেকেই। হয়তো এখনও সেটিই অপ্রকাশ্যে ঘটে চলেছে, যার প্রত্যক্ষ রূপ দেখা যাবে আরো কয়েকবছর পর।

একজন ব্যক্তির পতন বুঝে নিতেও ২/৪ বছর সময় লাগে, জাতির পতন প্রবলভাবে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে ২০/২৫ বছর পর। বর্তমানের এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি আমাদের সমাজটিকে টেনে আরো নিচে নামিয়ে আনবে বলে আমার ধারণা। যাহোক, এই অবস্থা থেকে আমাদের সহসা মুক্তি মিলবে বলে মনে হয় না। যা ঘটে চলেছে, তার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনারই অংশ বলে ধারণা করা যায়। আমাদের 'গণতান্ত্রিক সরকার' ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে।

'সংবিধান-সম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা' ব্যর্থ হয়েছে। 'সেনা-সমর্থিত অনিয়মিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা'ও ব্যর্থ হতে চলেছে, এটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাকি রইলো কি? রইলো 'মার্কিন সমর্থিত সামরিক সরকার' বা 'মার্কিন ও সেনা সমর্থিত জাতীয় সরকার'। সেই মহান দেশপ্রেমিক সরকার দেশের মানুষকে উদ্ধার করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, যে কোনো সময় নাজেল হবে। এই পরিস্থিতিতে সব মানুষেরই দায়িত্ব হচ্ছে, যার যার জায়গা থেকে প্রতিবাদটা জানানো।

একজন লেখক কিভাবে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারেন। তাদের হাতে তো কলম ছাড়া আর কিছু নেই। হঁ্যা ওই কলম নিয়েই নামতে পারেন তারা, এটিই তাদের প্রধান অস্ত্র। ফুটনোট : দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমি ‌'অশ্রু অথবা রক্তপাতের গল্প' শিরোনামে একটি গল্প লিখেছিলাম, যেটি একটি ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো। এই সময়ে এরকম একটি গল্প লিখলে যেসব ভোগান্তিতে পড়ার কথা তার কিছু অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে।

কেউ চাইলে নিচের লিংক থেকে গল্পটি পড়ে নিতে পারেন। http://www.amkamalbd.com/golpo/osru_othoba_roktopat.html

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.