আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সারপ্রাইজ (কল্পগল্প)

কত অজানারে!

ঘরের মধ্যে ধুমসো কালো জিনিসটা দেখলেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে যুথীর। এমনই কাল যেন এর গা দিয়ে অন্ধকার ঠিকরে ঠিকরে বেরচ্ছে! আশপাশের জিনিসও অন্ধকার করে ফেলছে। হঠাৎ করে ঘরের ঐ দিকে চোখ পড়লে বুকের মধ্যে কেমন ছ্যাত্‌ করে উঠে। আরে বাবা, যেটা যার কাজ না সেটা তার করার কি দরকার? এইতো কয়েক দিন আগেরই ঘটনা। কথা নেই বার্তা নেই চার জন লেবার নিয়ে হাজির ইফতেখার।

তার পর সবাই মিলে দরজায় কি জানি মাপ জোখ করল। এর পরই সিড়িতে ঢুস ঢাস শব্দ। হেইও, হাইও করতে করতে ভারী কিছু একটা তুলে নিয়ে এসেছে সবাই মিলে! এমনিতে চার জন লেবারই যথেষ্ট। কিন্তু তাহলে মাতুব্বারিটা করবে কে? বীরত্ব দেখাতে গিয়ে তাই ইফতিও হাত লাগিয়েছে ঐ চারজনের সাথে। লেবাররা বিরক্ত।

তাদের মত প্রফেসনালদের মধ্যে এরকম আনাড়ি একজনকে নাক আর হাত গলাতে দেখে। ইফতির আনাড়িপনায় জিনিসটা দেয়ালে গুতা খেয়েছে কয়েক বার। অবশ্য গুতা খাওয়া নিয়ে লেবারদের বিরক্ত হবার কথা না। কারণ ইফতির জিনিস চার তলায় আস্ত পৌছাল, নাকি টুকরা টুকরা হয়ে পৌছালো সেটা ইফতির মাথা ব্যথা। কিন্তু ওই বস্তুর সাথে তাদের হাতও বিস্তর বাড়ি-ছ্যাচা খেয়েছে দেয়ালে! ইফতেখার ভেবেছিল দারুণ একটা সারপ্রাইজ দেবে যুথীকে।

তাই পুরা জিনিসটা আবার র‌্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়ে নিয়ে এসেছে। যেন বিশাল একটা গিফট বক্স!! ভেবেছিল কাধে করে বড় গিফট বক্সটা বাসার মধ্যে নিয়ে একটা বিজয়ের হাসি দেবে। তারপর যুথীকে বলবে, বলতো ভিতরে কি? কিন্তু কোন কিছুই ঠিক মত হয়নি। ভারী জিনিসটা নামিয়ে রাখার সময় পড়েছে তার পায়ের উপর! বিজয়ের হাসি দেবে কি? যন্ত্রনায় মুখ কুচকে গেছে!! নখ টখ ফেটে গেছে মনে হয়। এদিকে সারপ্রাইজের কিছু বাকি নেই! টানা হেচড়াতে র‌্যাপিং পেপার ফেটে চিরে গেছে।

ভিতরের কাল ওয়্যারড্রোভ বেরিয়ে পড়েছে। সেটা দেখে যুথীর মুখ আরো বেশি কুঁচকে গেছে। যেন সেটা পড়েছে ইফতির না, যুথীর পায়। এদিকে লেবাররা বেশি টাকা দাবি করছে। তাদের সাথে নাকি কন্ট্রাক্ট ছিল একটা ওয়্যারড্রোভ চার তলায় উঠানোর।

নরমালি তারা চারজন আগে চারটা ড্রয়ার খুলে নিয়ে উঠে। এর পর বাকি খোলসটা সবাই মিলে উঠায়। কিন্তু র‌্যাপিং পেপারের কারনে ড্রয়ার সহ উঠাতে গিয়ে তাদের নাকি কাজ হয়েছে দুইটা ওয়ার ড্রোভের সমান! ইফতেখার সেটা মানতে রাজি না। একটা জিনিস ভাঙা ভাঙা ভাবে উঠানো হল। নাকি আস্ত উঠানো হল।

সেটা নাকি ব্যপার না! মোট কাজ ওয়্যারড্রোভের মোট ওজন আর বাসার উচ্চতার সমানুপাতিক! এই কথা সে গাণিতিক যুক্তি দিয়ে বুঝানর চেষ্টা করছে লেবারদের। উপরন্তু, তার মতে পুরোটা একসাথে উঠানোর কারণে নাকি তাদের বার বার ওঠা নামার এনার্জি সেভ হয়েছে। এসবতো কয়েকদিন আগের কথা। তখন হৈ হল্লার মধ্যে তেমন কিছুই বলতে পারেনি যুথী। তবে খুশি যে হয়নি, তা বুঝিয়ে দিয়েছে ঠিকই।

অনুরোধে ঢেকি গেলে মানুষ। কিন্তু যুথীকে আস্ত ওয়্যারড্রোভ গিলতে হচ্ছে! কোনমতে গিললেও হজম করা যাচ্ছে না! এমনই বিদঘুটে জিনিষ। তার উপর এটার আশপাশে থাকলেই মুখ তিতা হয়ে যায়। মনে হয় নিম কাঠের তৈরি! আচ্ছা, নিম কাঠ দিয়ে কি কোন আসবাবপত্র হয়? মা কে জিজ্ঞেস করতে হবে। কি বার্নিশ করেছে কে জানে? এখনো শুকায়নি ঠিক মত।

হাত দিলে আঠা আঠা লাগে। তার উপর র‌্যাপিং পেপার এর নিচের রুপোলি রঙ জায়গায় জায়গায় লেগে আছে। আর দেয়ালে গুতো খাবার চিরস্থায়ী দাগ তো আছেই! এই জিনিসটা দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়। এর মধ্যে আবার বার্নিশের তিক্ত গন্ধ। এসব নিয়ে দুজনের খিট মিট লেগেই আছে।

এইতো গত রাতের কথা। ভাল মনে যুথী বলল, এই শোন, মা বলেছে এটার গন্ধ যখন এতই খারাপ লাগছে তখন এটা বাদ দিতে। মানে নিশ্চই শরীর এটার কেমিক্যাল গুলা এক্সেপ্ট করছেনা। তা না হলে এত খারাপ লাগবে কেন। ওমা!! যেইনা বলা অমনি ইফতেখার তেলে বেগুনে জলে উঠল! বলে, তোমার মা বলেছে মানে! ওহ্‌ আমি তো ভুলেই গেছিলাম।

তোমার মাতো আবার মহাজ্ঞানী আইনস্টাইন। আমার মা তো ভাই আইনস্টাইন না। আমার মা পারে খালি কুয়া থেকে পানি তুলতে আর সেই পানি দিয়ে ভাত রাঁধতে। যুথী বলল, দেখ আমার কিন্তু সত্যিই বমি পাচ্ছে। তবে এখন আর এই কাল ভুতের বাসাটার জন্য না।

তোর কথা শুনে। ছিঃ তুই এত নিচ! এই বলেই যুথী দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে হড় হড় বমি করতে লাগলো। ইফতি আর যুথীর তুই তোকারি সম্পর্ক ছিল বিয়ের আগে। কিন্তু বিয়ের পর দুজনেই তাদের শশুর শাশুরির মন রাখতে গিয়ে অনেক কষ্টে ‘তুমি’ বলা অ‌ভ্যাস করেছে কিন্তু ঝগড়া করার সময় আবার তুই তোকারি শুরু হয়ে যায়। যেমন এখন শুরু করল যুথী।

ইফতেখারও যুথীর নিচতায় হতবাক হয়ে গেছে। সে ভাবল, আসলেই এবার খুব বাড়াবাড়ি করছে যুথী। বলল, থাক থাক, এখন আর গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে দেখাতে হবে না। তোর যখন এতই আপত্তি তখন ফেলেই দেব শালার ওয়ারড্রোভটাকে। পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি।

তাই ফেলে দিতে কষ্ট হচ্ছে। যুথী বলল, কি? তুই কি আমাকে টাকার গরম দেখাস? ইফতি বলে, না না টাকাতো জীবনে চোখেই দেখিনাই। তার আবার গরম দেখাবো কি করে? দাড়া কালই কুড়াল কিনে আনবো। সেই কুড়াল দিয়ে এইটা ভাঙ্গবো। চিরে চলা কাঠ বানাবো।

সেই কাঠ পাঠাবো বাড়িতে। আমরা তো আর টাকা পয়সা দেখিনি কোন দিন। আমার মা তো রান্ধে কাঠে চুলায়। এই কাঠ দিয়ে মা ভাত রাঁধবে সেই ভাত এনে তোকে খাওয়াবো। তোর মাকেও খাওয়াবো।

রাগে ঘৃণায় যুথীর গা রি রি করে উঠলো! সে আবার গেল বমি করতে। ছিঃ ইফতি এমন ভাবে ঝগড়া করছে কেন? বস্তির রিকশাওয়ালারাও তাদের বউয়ের সাথে এরকম করে না! যুথী রেগে সারা রাত ড্রয়িং রুমেই কাটিয়ে দিল। সকালে যুথীর ঘুম ভেঙেছে দেরিতে। ইফতেখার আগেই বেরিয়ে গেছে। সারারাত মশা কামড়িয়েছে।

যুথির আবার মশায় অ্যালার্জি। মনে হয় একশটা দাগ হয়ে গেছে তার হাতে আর মুখে। এই দাগ সারা জীবনে আর উঠবেনা। সকালে শার্মিন ফোন করেছিল। যুথী তাকে বলেছে নিজের দুঃখের কথা।

এসব শুনে শার্মিন ইঙ্গিত পুর্ণ হাসি দিয়েছে। বলে, ইশ্‌শ তোদের ভাগ্য দেখলে আমার ইর্ষা হয়রে। শোন আমি দুয়েক ঘন্টার মধ্যেই আসছি। তোকে নিয়ে কাজ আছে। মনে হয় তোর এখন থেকে এক মুঠ করে বেশি খেতে হবে।

হে হে হে। কেমন যেন ফাজিল ব্যাটাদের মত হাসি দিচ্ছে শার্মিন। যুথী ফোন কেটে দিল। শার্মিনের এই এক সমস্যা। তার সাথে কথা বলে মন ভাল হবার কোন চান্স নেই।

সব কিছুর মধে সে কিছু না কিছু উলটা পালটা বের করবেই! এখন আবার তার মাথায় কি খেলছে কে জানে? সময় বিকাল। সোফার উপর থম মেরে বসে আছে যুথী। যে খবরটা সে শুনেছে। সেটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, নাকি সে নিজেই আকাশের উপর উঠে গেল সেটা বুঝতে পারছেনা!! শার্মিন মেয়েটা এত কিছু জানে কি করে। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে নেট থেকে! সে নিজে তো জানে না।

সেও তো নেট ইউজ করে। যাই হোক শার্মিন এর কথা বিশ্বাস যোগ্য। কারণ তার মূল কাজই হল নেটে চ্যাট করা আর এইসব সার্স দেওয়া। তবু এই খবর টা হজম হচ্ছে না। সে কারণেই মনে হয় বমি বমি ভাব লাগছে।

আবার এই কারণেই খবর হজম করতে বাধ্য হচ্ছে যুথী। শার্মিন কি কি জানি টেস্ট করে। প্রমান করে ফেলেছে যে যুথী কনসিভ করেছে! এই কথা মাকে জানাতে হবে। কিন্তু যুথীর লজ্জা করছে। ইফতেখার কেও জানাতে হবে।

তবে যুথী ভাবছে ইফতিকে জানাবে না। ব্যাটা খবর শুনেই তো খুশি তে বাগ বাগ করা শুরু করবে। ব্যাটা আস্ত রিকশাওয়ালা! বস্তির খ্যাত!! এত সহজে ওকে খুশি করা উচিৎ না। আগে একটা শিক্ষা দেওয়া উচিৎ। কিন্তু শিক্ষা দেওয়ার কোন প্লান মাথায় আসছে না যুথীর।

কি ভেবে ভেবে যেন সে চমকে চমকে উঠছে? তার মনে হচ্ছে কিছু বুঝি নড়ে উঠলো! যদিও জানে সেসবের এখনো অনেক দেরি। নিজের বোকামিতে নিজেই হেসে উঠছে মাঝে মাঝে। মাকে এখনো বলা হয়নি। তবে শারমিন যে বাচাল। সে নিশ্চই ফোন করে সবাইকে জানিয়ে দেবে।

তার লজ্জা শরম নেই। এইতো দুপুরে গিয়েই শত শত ফুল কিনে এনেছে। বলে ঘর দোর নাকি ফুল দিয়ে ভাসিয়ে দেবে!! তার সব কিছুতেই বেশি বেশি। ইফতি সেই যে সকালে কিছু না বলে বেরিয়ে গেছে। এখনো আসার নাম নেই।

ফুলের গন্ধটা ভাল লাগছেনা যুথীর। কিন্তু তার সবচেয়ে কাছের এই ফাজিল বান্ধবীর পাগলামিকে সে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। আটলিস্ট ফুলের গন্ধ বার্নিশের চেয়ে ভাল। শারমিন এর কাছে খোজ পেয়ে যুথীর আরো কয়েক জন বান্ধবী এসে গেছে। যুথীর বান্ধবীদের গ্রুপে এই ঘটনা এটাই প্রথম।

তাই তারাও যার পর নাই এক্সাইটেড! আবার কলিং বেল বেজে উঠেছে। বেলের ভঙ্গিতেই বুঝা যাচ্ছে ইফতি এসেছে। যুথী উঠে গেছে দরজা খুলতে। ইফতেখারের মাথায় একটা কিছু ঢুকলেই হল। সহজে বের হয়না।

এবার যুথীর নীচতায় সে আসলেই প্রচন্ড রেগে গেছে। ছিঃ ছিঃ গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমিও করে!! কত্ত বড় ছোটলোক। ইফতেখার এমনিতে এসব নিয়ে আলোচনা করেনা কারো সাথে। কিন্তু আজ সে হাসান কে খুলে বলেছে সব। হাসানের অতি উৎসাহেই সে একটা কুড়াল কিনে ফেলেছে শেষমেশ! হাসান বলে, শোন একে বলে বিড়াল মারা।

যদিও বাসর রাতেই মারার কথা ছিল। কিন্তু তুই তখন মিস করেছিস। এই সুযোগেই বিড়াল মেরে দে!! বিড়াল মারার কুঠার হাতে নিয়ে সিড়ি ঘরে ঢোকার সময়ও ইফতেখার বেশ উত্তেজনা অনুভব করছিল তার রক্তে। কিন্তু ভারি কুড়াল হাতে হাফাতে হাফাতে চার তলায় উঠার পর, এখন কেমন যেন বোকা বোকা লাগছে নিজেকে! মনে হচ্ছে চরম গাধামি হয়েছে। কুড়ালটা কি আগে ছাদে লুকিয়ে রেখে আসবে? না থাক।

কেনা যখন হয়েছেই, একটু ভয় দেখিয়ে নেওয়া যাক অন্তত। কলিং বেল চাপে সে। যুথী দরজা খুলেছে। দরজায় একজন কাঠুরিয়া দাঁড়িয়ে আছে!! আসলেই কুদাল বেলচা হাতেই বেশি মানায় এই ছোটলোককে! ইফতি কেমন যেন বোকা বোকা হাসি দিচ্ছে। কুড়াল টা হাতে নিয়ে মাথা চুলকানোর ভাব করছে।

শারমিন বাড়া বাড়ি শুরু করেছে। তার বুদ্ধিতে এক বান্ধবী কিছু ফুলের পাপড়ি ছাড়িয়ে একটা পিরিচে নিয়ে দরজা আরালে লুকিয়ে আছে। পুষ্প বর্ষণ হবে। আর শারমিন ক্যামেরা হাতে রেডি। খবর শোনার পর ইফতির ফার্স্ট এক্সপ্রেশন ভিডিও করবে।

সেটা নাকি আবার ইউটিউবে আপলোড করে দেবে!! এখনি কি কান্ড শুরু হবে ভেবে প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে যুথীর। বকলুটা কুঠার হাতে দাঁড়িয়েই আছে দরজায়। ভিতরে আসবে কিনা ইতস্তত করছে। যুথী মনে মনে হাসছে, হা হা হা! ঐ গাধা কুড়াল নামা! এখনি তো আবার নিজের পায়েই ফেলবি...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।