'সংস্কৃতি' শব্দটি আমরা অহরহ শুনি, ব্যবহারও করি। কিন্তু বিষয়টি যে আসলে কী, সে সম্বন্ধে কখনোই পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায় না। খানিকটা কৌতূহল থেকে আর খানিকটা প্রয়োজনে বিষয়টি নিয়ে তাই কিছু পড়াশোনা করেছিলাম। আপনাদের সঙ্গে সেটি শেয়ার করার জন্যই এই লেখা। 'সংস্কৃতি' নিয়ে আমার নিজের মতামত তো থাকছেই সেই সঙ্গে বাঙালি চিন্তাবিদরা এ বিষয়ে কী ভেবেছেন তার উদাহরণ হিসেবে কিছু রেফারেন্সও থাকছে।
আপনাদের মতামত পেলে আনন্দিত হবো।
সংস্কৃতি! সংস্কৃতি?
বাংলাদেশের মানুষের কাছে সংস্কৃতি শব্দটি প্রায় বিমূর্ত রূপ ধারণ করেছে। শব্দটি বাংলা ভাষায় গৃহীত হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত যত বিভ্রান্তি ও তর্ক-বিতর্ক তৈরি করেছে, আর কোনো শব্দ তা করেছে বলে মনে হয় না। সংস্কৃতি বিষয়টি বোঝার জন্য যাদেরকে নিয়ে কথা বলা দরকার- অর্থাৎ দেশের জনগণ- তারা এখন পর্যন্ত জানতেই পারলো না, বুঝতেও পারলো না যে, ওই বস্তুটি কী! দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষাবঞ্চিত নিরক্ষর জনগণ তো বটেই, এমনকি বহু 'শিক্ষিত' লোককেও বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এবং উচ্চতর পেশাগত মর্যাদায় অভিষিক্ত অনেক লোকও সংস্কৃতি বলতে কেবল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকেই বুঝে থাকেন।
অর্থাৎ নাচ-গান-নাটক-চলচ্চিত্র-শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদিকেই সংস্কৃতি বলে মনে করেন। বলাবাহুল্য এগুলো সংস্কৃতিরই অংশ, সংস্কৃতির পুরোটা নয়। 'সাংস্কৃতিক' শব্দটির সঙ্গে সংস্কৃতির মিল থাকায় এই বিপত্তি। এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকাও কম নয়। প্রতিদিন পত্রপত্রিকায় 'সংস্কৃতি সংবাদ' নামে যা কিছু ছাপা হয়, কিংবা টেলিভিশনের সংবাদে 'এ সপ্তাহের সংস্কৃতি' জাতীয় শিরোনামে যা কিছু প্রচারিত হয় তা পড়ে বা দেখে মনেই হবে না যে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া সংস্কৃতির অন্য কোনো অর্থ আছে! বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বিষয়টি নিয়ে মাথাই ঘামায় না, আর শিক্ষিত লোকদের ধারণা এই রকম।
অনেকে আবার বিষয়টিকে ধর্মবিরোধী বলেও মনে করেন (যেহেতু নাচ গান ইত্যাদি ধর্মসম্মত নয়)। ধর্মও যে সংস্কৃতিরই অঙ্গ এ কথা শুনলে সম্ভবত তাদের মাথায় বাজ পড়বে। বাংলাদেশে এই হলো সংস্কৃতি সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণা। তা, সংস্কৃতি-চেতনার এই করুণ হাল কেন? একটা কারণ হতে পারে- শব্দটি জনগণের পছন্দ হয়নি, কিংবা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, কিংবা বোধগম্য হয়নি। বাংলা ভাষায় শব্দটি চালু করার জন্য রবীন্দ্রনাথ যে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন তাতে প্রাথমিকভাবে জয়ী হলেও শেষ বিচারে তাঁর এই বিজয়কে নিস্ফলই বলতে হচ্ছে।
অবশ্য সংস্কৃতির এই ধরনের ইন্টারপ্রিটেশনের জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও দায়ী করা চলে। কালচারের প্রতিশব্দ হিসেবে তিনি কৃষ্টিকে পছন্দ তো করেন-ই নি, বরং তীব্র বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। কৃষ্টি যেহেতু কর্ষণ বা কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, এটা তাই তাঁর পছন্দ হয়নি, সংস্কৃতিকে তিনি নিয়েছিলেন সংস্কার অর্থে। অর্থাৎ মনের কর্ষণ নয়, সংস্কারই তাঁর পছন্দ ছিলো! এ থেকে তাঁর মনোজগতের কাঠামোটিও খানিকটা বুঝে নেয়া যায়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ-উপকরণ আর প্রয়োজনকে তিনি সংস্কৃতির মর্যাদা দিতে চান নি- হয়তো এগুলোকে তিনি স্থূল হিসেবেই বিবেচনা করতেন; বরং শিল্পসাহিত্যের মতো সূক্ষতম অনুভূতির চর্চাকে তিনি সংস্কৃতির মর্যাদা দিয়েছেন [সূত্রঃ কৃষ্টি কালচার সংস্কৃতি, নীহাররঞ্জন রায়]।
'কৃষ্টি'র বিরুদ্ধে এবং 'সংস্কৃতি'র পক্ষে তিনি কতোটা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তার উদাহরণ হিসেবে তাঁর কয়েকটি পংক্তি বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখ করছি-
কালচার শব্দের একটা নূতন বাংলা কথা হঠাৎ দেখা দিয়েছে; চোখে পড়েছে কি? কৃষ্টি? ইংরেজি শব্দটার আভিধানিক অর্থের বাধ্য অনুগত হয়ে ওই কুশ্রী শব্দটাকে কি সহ্য করতেই হবে? এঁটেল পোকা পশুর গায়ে যেমন কামড়ে ধরে, ভাষার গায়ে ওটাও তেমনি কামড়ে ধরেছে। মাতৃভাষার প্রতি দয়া করবে না তোমরা?..ইংরেজি ভাষার চাষ এবং ভব্যতা একই শব্দে চলে গেছে বলে কি আমরাও বাংলা ভাষায় ফিরিঙ্গিয়ানা করব? ইংরেজিতে সুশিক্ষিত মানুষকে বলে কালটিভেটেড- আমরা কি সেইরকম উঁচুদরের মানুষকে চাষ-করা মানুষ বলে সম্মান জানাব, অথবা বলব কেদারনাথ?...কালচারড ফ্যামিলিকে প্রকর্ষবান বললে সে পরিবার গৌরব বোধ করবে। কিন্তু কৃষ্টিমান বললে চন্দনের সাবান মেখে স্নান করতে ইচ্ছে করবে। ...(সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে লেখা চিঠি থেকে, পরিচয়, মাঘ ১৩৩৯)।
সংস্কৃতি বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন সেটাও বোঝা যাবে নিচের অংশটি পড়লে-
...আমাদের পেট ভরাবার জন্য, জীবনযাত্রার অভাব মোচন করবার জন্যে আছে নানা বিদ্যা, নানা চেষ্টা; মানুষের শূন্য ভরাবার জন্যে, তার মনের মানুষকে নানাভাবে নানা রসে জাগিয়ে রাখবার জন্যে আছে তার সাহিত্য, তার শিল্প।
মানুষের ইতিহাসে এর স্থান কী বৃহৎ, এর পরিমাণ কী প্রভূত! সভ্যতার কোনো প্রলয়ভূমিকম্পে যদি এর বিলোপ সম্ভব হয়, তবে মানুষের ইতিহাসে কী প্রকাণ্ড শূন্যতা কালো মরুভূমির মতো ব্যাপ্ত হয়ে যাবে! তার 'কৃষ্টি'র ক্ষেত্র আছে তার চাষে-বাসে আপিসে-কারখানায়; তার সংস্কৃতির ক্ষেত্র সাহিত্য, এখানে তার আপনারই সংস্কৃতি, সেখানে তাতে আপনাকেই সম্যকরূপে করে তুলেছে, সে আপনিই হয়ে উঠেছে। ... (সাহিত্যতত্ত্ব/সাহিত্যের পথে। )
বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশে সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে রবীন্দ্র-কনসেপ্টেরই সমপ্রসারণ। আমরা যদি রবীন্দ্র-ভাবনাবিশ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে চাই, তাহলে বাঙালির সংস্কৃতিকে বুঝে নেয়ার জন্য তাদের জীবনাচরণের প্রতিটি অনুষঙ্গ বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। অর্থাৎ বাঙালির খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ, সংস্কার, বিশ্বাস, ধর্ম, ধর্ম বিশ্বাসের ধরন, ধর্মাচরণের ধরন, পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক, শিল্প-সাহিত্য এসবই আলাদাভাবে বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে।
তার আগে, সংস্কৃতি বলতে আমরা আসলে কী বুঝবো সেটা বলে নেয়া দরকার। সংস্কৃতি বিষয়টি, এমনকি শব্দটিও, যেহেতু বরাবর বিভ্রান্তি তৈরি করে এসেছে; এ সম্বন্ধে নিজের অবস্থানটি পরিষ্কার করার জন্যই একেকজন একেকটি সংজ্ঞাকে প্রমিত হিসেবে ধরে নেন। আমরাও একই কারণে সংস্কৃতি সম্বন্ধে প্রচলিত অন্তত কয়েকশ' মতের মধ্যে দুটোকে আমাদের মতের কাছাকাছি বলে গ্রহণ করতে পারি। একটি-
culture is the man made part of the environment(হারস্কোভিটস)।
অধ্যাপক পবিত্র সরকার এটিকে ব্যখ্যা করেছেন এভাবে-
মানুষ আসার আগে পৃথিবী যে অবস্থায় ছিলো আর মানুষ আসার পর পৃথিবীর যে অবস্থা দাঁড়ালো এই দুইয়ের তফাত হলো সংস্কৃতির তফাত।
পৃথিবীর জীবন প্রতিবেশে মানুষের সৃষ্ট যা কিছু সে সবই সংস্কৃতি বাকিটা প্রকৃতি। (সূত্রঃ লোকভাষা লোকসংস্কৃতি, পবিত্র সরকার)।
এরকম আরেকটি সংজ্ঞাও নেয়া যায়-
Historically created designs for living, explicit and implicit, rational, irrational and nonrational which exist at any time as potential guides for the behaviour of men (ক্লাইড ক্লাকহোন ও উইলিয়াম কেলি)।
মানে দাঁড়ালো- ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্টি হওয়া জীবনযাপনের নানা ছক (ডিজাইন), যা কখনো প্রকাশ্য কখনো গোপন, কখনো যুক্তিসম্মত, কখনো অযৌক্তিক, কখনো যুক্তি নিরপেক্ষ (অর্থাৎ যেখানে যুক্তি-অযুক্তির প্রশ্ন তোলাই অবান্তর) এবং যা যে-কোনো সময়ে একটি জনগোষ্ঠীর আচরণকে পরিচালিত করে তা-ই হচ্ছে সংস্কৃতি। পবিত্র সরকার যুক্তিসম্মত উপকরণের উদাহরণ হিসেবে খাদ্য, পোশাক ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন, অযৌক্তিক উপাদান হলো ধর্ম বা সংস্কার-কুসংস্কার (যেহেতু এগুলো বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, যুক্তির ওপরে নয়), আর ভাষা হচ্ছে যুক্তিনিরপেক্ষ উপাদান।
অর্থাৎ, সংস্কৃতি বলতে একটি জাতির প্রতিটি অনুষঙ্গকেই বুঝবো আমরা_ পোশাক-আশাক, পেশা, খাদ্যাভ্যাস, ঘর-বাড়ির প্যাটার্ন থেকে শুরু করে তার বিশ্বাস-অবিশ্বাস-সংস্কার-কুসংস্কার ইত্যাদি সবই সংস্কৃতির অঙ্গ।
অবশ্য এই চিন্তাটি নতুন কিছু নয়। রবীন্দ্রোত্তরকালে, এমনকি তাঁর জীবদ্দশায়ই বুদ্ধিজীবীরা তাঁর ভাবনাবিশ্ব থেকে বেরিয়ে এসে সংস্কৃতিকে সামগ্রিক জীবনাচরণ হিসেবে মেনে নিয়েই এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে থাকেন। ৪০-দশকের গোড়ার দিকে (এপ্রিল, ১৯৪১) বিনয়কুমার সরকার 'বেঙ্গলি কালচার অ্যাজ এ সিস্টেম অব মিউচু্যয়াল আককুলটুরেশনস' শিরোনামে যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন, সেটি বাঙালির সংস্কৃতি সম্বন্ধে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। গোপাল হালদার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নিহাররঞ্জন রায় প্রমুখের রচনায় এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব চোখে পড়ে।
কয়েকটি উদ্ধৃতি দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
কালচার, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এইসব শব্দ যে ধ্যানধারনার মূর্ত রূপ তা জীবনের কোনও আংশিক কর্ম ও জ্ঞানকাণ্ডের ধ্যানধারণা নয়, বরং জীবনের সমগ্র কর্ম ও জ্ঞানকাণ্ডের আশ্রয়ে জাত ও বর্ধিত। (সূত্র : কৃষ্টি কালচার সংস্কৃতি, নীহাররঞ্জন রায়। )
গোপাল হালদার মনে করেন- সংস্কৃতির তিনটি অবয়ব বা তিন ধরনের অবলম্বন আছে : ১. জীবন সংগ্রামের বাস্তব উপকরণসমূহ (material means) ২. সমাজ যাত্রার বাস্তব ব্যবস্থা (social structure), এবং ৩. মানস-সম্পদ। তিনি সমাজ যাত্রার বাস্তব ব্যবস্থাকে সংস্কৃতির প্রধান আশ্রয় এবং মানস-সম্পদকে সমাজের ওপরতলার উপকরণ (superstructure) হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন-
সংস্কৃতি বলতে যে শুধু ঘরবাড়ি, ধন-দৌলত বুঝায় তাহা নয়।
শুধু যে রীতি-নীতি, আচার অনুষ্ঠান বুঝায় তাহাও নয়। সংস্কৃতি বলিতে মানস-সম্পদও বুঝায়_ চিন্তা, কল্পনা, দর্শন, ধ্যান-ধারণা, এই সবও বুঝায়... আসলে বাস্তব ও মানসিক সমস্ত 'কৃতি' বা সৃষ্টি লইয়াই সংস্কৃতি_ মানুষের জীবন-সংগ্রামের মোট প্রচেষ্টার এই নাম। ... সাধারণভাবে আমরা যে মনে করি কালচার জাতিগত, দেশগত বা ধর্মগত তাহা যেমন অর্ধসত্য, তেমনি সাধারণভাবে আমরা যে মনে করি কালচার অর্থ কাব্য, গান, চারুকলা, বড় জোর দর্শন বা বিজ্ঞান পর্যন্ত, তাহাও তেমনি আর একটি অর্ধসত্য। কথা এই যে, সংস্কৃতি সমাজ-দেহের শুধু লাবণ্যছটা নয়, তাহার সমগ্র রূপ। তাই সমাজের পরিচয় দিয়াই সংস্কৃতির পরিচয়।
(সূত্র: সংস্কৃতির রূপান্তর, গোপাল হালদার। )
গোপাল হালদার তিনটি বিষয়কে সংস্কৃতির প্রধান সত্য হিসেবে অভিহিত করেছেন- ফ্রিডম অব মাইন্ড (মনের স্বাধীনতা), ইউনিভার্সালিজম (বিশ্বমানবতা), এবং আর্বানিটি (নাগরিক শালীনতা)। সাধারণভাবে এই হলো সংস্কৃতির সদর্থ। কিন্তু তিনি মনে করেন- আর একটি বিষয়ও এর সঙ্গে যোগ করতে হবে। সেটি হচ্ছে- ক্রিয়েটিভনেস বা সৃষ্টিশীলতা।
'শুধু জানলে আর বুঝলেই মানুষের জীবনধর্ম শেষ হয়ে যায় না- তাকে কিছু করতে হয়, গড়তে হয়, সৃষ্টি করতে হয়। '
প্রসঙ্গক্রমে বাঙালির সংস্কৃতি কীরকম সেটি বোঝার জন্য আমরা এর দু-একটি অনুষঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি। যেমন, প্রশ্ন করা যায় খাদ্যাভ্যাস নিয়ে। বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত-মাছ কেন? (সবাই ভাত-মাছ পাচ্ছে কী না সেটা ভিন্ন প্রশ্ন, পাক আর না পাক তাদের প্রধান এবং প্রিয় খাদ্য যে ভাত-মাছ সেটা তো আর অস্বীকার করা যাবে না!) কেন ভাত-মাংস নয়? অথবা রুটি-মাংস নয়? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন নয়। কৃষিপ্রধান একটি দেশে- ধান যেখানে প্রধান শস্য- সেখানে ভাত যে প্রধান খাদ্য হবে তা আর অস্বাভাবিক কি? আর যে দেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আছে নদী-নালা-খাল-বিল-হাওড়-পুকুর-দীঘি এবং যেখানে প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর মাছের জন্ম হয়- সেখানে মাছও যে প্রধান খাদ্যতালিকায় স্থান করে নেবে সে-ও তো বিস্ময়কর নয়।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে, একটি জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সেই দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্টাবলী অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এ দেশের ভূ-প্রকৃতি যদি পানি প্রধান না হতো, তাহলে মাছ নিশ্চয়ই প্রধান খাবার হতো না! কোনো মরুপ্রধান অঞ্চলে মাছ প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয় বলে আমার জানা নেই। এরকম প্রশ্ন তোলা যায় পোশাক-আশাক নিয়েও। বাংলাদেশের মানুষ রুশদের মতো ফারকোট পড়ে না কেন, কিংবা আরবদের মতো আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে ঢেকে চলাফেরা করে না কেন? কারণ- বাংলাদেশের জলবায়ু বা আবহাওয়া ওই ধরনের পোশাককে অনুমোদন করে না, কিংবা এই আবহাওয়ায় ওই ধরনের পোশাক পড়ার দরকার নেই। রুশরা প্রবল শীত থেকে বাঁচার জন্যই ওরকম পোশাক পড়ে, অন্যদিকে মরুভূমির লু হাওয়া এবং প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া থেকে বাঁচার জন্য আরবদের তাপ প্রতিরোধক সাদা পোশাক পড়তে হয়।
শুধু জলবায়ু বা আবহাওয়াই নয়, প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য-বৈশিষ্ট্যও মানুষের স্বভাব-চরিত্র এবং তার সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। মরুভূমির রুক্ষতাও সুন্দর, যেমন সুন্দর আগ্নেয়গীরির অগ্নু্যৎপাত কিন্তু দুটোই আগ্রাসী সুন্দর বা অ্যাগ্রেসিভ বিউটি। যেসব দেশে এগুলো আছে সেখানকার মানুষ যে একটু রুক্ষ হবে, কিংবা তারা যে আগ্রেসিভ বিউটি পছন্দ করবে তা আর অস্বাভাবিক কি? অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোমল ও মায়াময়, এ দেশের মাটি নরম ও উর্বর। এই রুক্ষ ঢাকা শহরেও প্রায় অবহেলায় যে পরিমাণ গাছ জন্মায় তা পৃথিবীর আর ক-টি শহরে জন্মায় সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এ দেশের যে দিকেই তাকাবেন, দেখবেন সবুজ, দেখবেন শান্ত-রূপময়ী নদী।
এমন কোমল, মায়াময় প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো যে একটু আবেগপ্রবণ হবে সে তো বলাই বাহুল্য, পছন্দের বেলায় অ্যাগ্রেসিভ বিউটির চেয়ে তারা যে সফট বিউটিকেই বেশি গুরুত্ব দেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। নদীমাতৃক এই দেশের নদীনালা-হাওর-বিল যে শুধু মানুষের খাদ্যাভ্যাস তৈরিতেই ভূমিকা রেখেছে তা নয়, মানুষের স্বভাব-চরিত্র নির্মাণেও ভূমিকা রেখেছে। নদীতীরবর্তী বা পানিপ্রধান অঞ্চলের মানুষ সাধারণত অবৈষয়িক, উদাসীন এবং ভাববাদী ধরনের হয়। এদেশের বাউল সমপ্রদায়ের উৎপত্তি ও বিকাশের দিকে নজর দিলেও বিষয়টির সত্যতা উপলব্ধি করা যাবে। আমাদের বাউলরা প্রায় সকলেই পানিপ্রধান অঞ্চলের মানুষ।
সম্ভবত নদীর মধ্যে ঘর-ছাড়ার একটা ইঙ্গিত আছে, আছে ভাববাদিতা।
সংস্কৃতি সম্বন্ধে এভাবে অনেক কথাই বলা যায়, বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আমাদের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলীর প্রভাব নিয়েই রচিত হতে পারে আলাদা একটি প্রবন্ধ, যেমন হতে পারে খাদ্যাভাস, উৎপাদন পদ্ধতি, উৎসব-পার্বন, পোশাক-আশাক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি নিয়েও। কিন্তু বিশেষভাবে কথা বলা দরকার সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতির ওপর ধর্মের প্রভাব এবং প্রচলিত ধর্মসমূহের ওপর আমাদের সংস্কৃতির প্রভাব কী রূপে প্রত্যক্ষ করা যায়, বাংলাদেশে ধর্মচর্চার ধরন ইত্যাদি নিয়ে। পরবর্তী কোনো লেখায় তার একটু সুলুক-সন্ধান করে দেখার ইচ্ছে রইলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।