নয়া যামানার নয়া পথিক,পথ হারিয়ে ছুটনা দিক্বিদিক বাংলাদেশে শত শত বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থান করছে,কিন্তু কখনই তারা নিজদের স্বকীয়তা ভুলে যায় নি কিংবা এক জনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অপরের উপর চাপিয়ে দিতে চায় নি। উভয় ধর্মের মানুষের মাঝে এমন কিছু বিশ্বাস আছে যা পুরোপুরি সাংঘর্ষিক ,তাই একজন মুসলমানের পক্ষে যেমন হিন্দুদের সব জীবনাচার একজন মুসলিম নিজ জীবনে সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিতে পারে না। এমন কিছু বিষয় আছে যা ইসলামে নিষিদ্ধ, যা হিন্দুদের কাছে পরম আরধ্য, ইসলামে অনেক কিছু নিন্দিনীয় তাই আবার হিন্দুদের কাছে প্রশংসনীয়, ইসলামে যাকে বলা হয় অশ্লীল তা করে হয়তো হিন্দুরা হয় সুশীল। এই বিশ্বাস ও জীবনাচারে পার্থক্য থাকার পরেও ইসলাম তাদের বিশ্বাস ও জীবনাচারে কখনোই বাঁধা দেয় না। শুধু যারা ইসলামে বিশ্বাসী তাদের এসব থেকে বেঁচে থাকার তাগিদ দেয়।
তাই দেখা যায় ইসলাম হিন্দুদের পূজা-পার্বণ পালন করতে বাঁধা দেয় না,কিন্তু মুসলমানদের সেখানে উপস্থিত হতে কঠিনভাবে নিষেধ করে। তাই মুসলমানরা তাদের সাথে সহাবস্থান করলেও নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধকে ভুলে যায় নি,আর তাতে কোন সমস্যাও সৃষ্টি হয়নি এত কাল। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম নামধারী কিছু সুশীল হিন্দুদের সব জীবনাচারকেই বাঙালি সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিতে চায়, এবং তা পালন করার জন্য তাগিদ দেয়।
কিন্তু কিছু কিছু কাজ আছে যেগুলো মুসলমানদের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক এবং তা শিরকের দিকে নিয়ে যায় এগুলো মুসলমানদের পক্ষে কখনোই পালন করা সম্ভব না, এখন যে সব নামধারী মুসলিম এগুলো পালন করতে চায় এগুলো তাদের নিজস্ব সুবিধার ব্যাপার,কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের সকল মুসলিমকে তা পালনে উৎসাহী করতে চাইলে অবশ্যই সেখানে প্রতিবাদ করা উচিৎ। যেমন ধরুন মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোর ব্যাপারটি, তা আজ অনেক সুশীল মুসলিমকেই তা সচরাচর করতে দেখা যায়,কিন্তু মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো বাংলাদেশী মুসলমানদের কখনো সংস্কৃতি হতে পারে না,কারণ তা হিন্দুদের ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত,আর তার ইতিহাস হলো-
"ভগবান বিষ্ণু শঙ্খচূড়ের স্ত্রী তুলশী দেবীর সাথে ব্যভিচার করার ফলে তুলশী দেবীর অভিশাপে বিষ্ণু গোলাকার পাথরে পরিণত হয়ে গেলেন।
শালগ্রাম নামক স্থানে এই ঘটনাটি ঘটেছিল বলে ঐ পাথরটির নামকরণ করা হয় শালগ্রাম শিলা।
কিন্তু পাথরে পরিণত হওয়ার পর দেবতাদের ভয়ে তুলশীদেবী গাছ হয়ে সেই পাথরের পাশে দাঁড়িয়ে যান। তখন দেবতাদের হুকুম হলো পূজার সময় প্রতিদিন মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে ঐ শীলার বুকে ও পিঠে তুলশি পাতা সংযুক্ত করতে হবে,অন্যথায় ভগবান বিষ্ণুর পূজাই সিদ্ধ হবে না। "
এ উপমহাদেশে বিশেষকরে বাংলাদেশে মুসলমান এবং হিন্দুরা পাশাপাশি অবস্থান করলেও তারা কখনো তাদের নিজ সংস্কৃতিকে অপরের সাথে গুলিয়ে ফেলেনি। ইংরেজ লেখক স্যার জন মার্শাল এদেশের সংস্কৃতির স্বরূপ আবিষ্কার করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন-
"মানবেতিহাসে আর কখনো দেখা যায় নি যে, দুটি বিপরীতধর্মী সংস্কৃতি এরূপ বিরাট পার্থক্য ও বলিষ্ঠতা সত্ত্বেও পাশাপাশি অবস্থান করেছে,অথচ একটি অপরটিকে গ্রাস করতে পারেনি। "
এ দু'টি হিন্দু সংস্কৃতি ও মুসলমান সংস্কৃতি। তাদের মধ্যে বিপরীত মেরুর ব্যবধান, ধর্মে ও সংস্কৃতিতে বিরাট পার্থক্য থাকায় পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে,তবুও স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হতে দেয় নি। (An advanced history of India)
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ইংরেজরা আসার পর। হঠাৎ করেই তখন হিন্দু সংস্কৃতিকে সার্বজনীন করার জন্য ব্রিটিশরা চেষ্টা করল,কারণ হিন্দুরা ছিল তাদের অনুগামী এবং সাহায্যকারী, আর এ পথে আরো অগ্রসর হলেন হিন্দু সাহিত্যিকরা, যারা নিজেদের সাহিত্যের মাধ্যমে ব্রিটিশদের দালালী অনেক অগ্রগামী ছিল।
আর মুসলমানরা শুরু থেকেই ব্রিটিশদের বিরোধী,তাই প্রয়োজন ছিল তাদের নিজ সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখা, তা সম্ভব না হলেও অন্তত হিন্দু সংস্কৃতির সাথে মিশে যাওয়া। ভারতীয় হিন্দুকে যেমন একেবারেই অ-ইসলামীকরণ করা হয়েছিল,তেমনি ভারতীয় মুসলমানকে হিন্দুয়ানী করার প্রচেষ্টা তখন চালানো হয়েছিল,তা নিরদ চৌধুরীর মন্তব্যে সেই ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন রয়েছে। নিরদ সি, চৌধুরী তার 'কালান্তর সমস্যা'য় লিখেছেনঃ
"ব্রিটিশ শাসন ইসলামী কালচার চর্চা করার কিংবা হিন্দুদের সহানুভূতি মুসলমানের প্রতি আকৃষ্ট করার বিরুদ্ধে ছিল। আর এই পরিস্থিতিতে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার আবিষ্কার কর্মটা জোরদার করা হয়েছিল। এই রেনেসাঁর প্রথম ফল হয়েছিল ভারতীয় হিন্দুকে একেবারেই অ-ইসলামীকরণ ও হিন্দু ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন।
"
হান্টারের মন্তব্য দেখেও সে কথারই সমর্থন পাওয়া যায়। স্যার উইলিয়াম হান্টার তাঁর 'দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস' গ্রন্থে বলেছেন-
"কিন্তু নিম্নবঙ্গের মুসলমানগণ কিছুকাল থেকে এমনিভাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে চলে গেছে যে, তাদের ধর্মীয় প্রয়োজনগুলিই ধীরে ধীরে উপেক্ষা কয়া হয়েছে। ......যেখানে পালা-পার্বণে খৃষ্টানদের বাষট্টি দিন ও হিন্দুদেরকে বায়ান্ন দিন ছুটি দেয়া হয়, সেখানে মুসলমানদের ছুটি দেয়া হয় মাত্র এগার দিন। ......সর্বোচ্চ সরকার শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেন এবং মুসলমানী পর্বগুলোর জন্য কয়েক-দিনমাত্র ছুটি নির্দিষ্ট করে দেন। এ ছুটিগুলি অবশ্য মুসলমানগণ যতদিন চেয়েছিল ততদিন না হয়ে সরকারী কাজ-কর্মের সুবিধানুযায়ী যতদিন সম্ভব ততদিনই নির্দিষ্ট হয়েছিল"
ইংরেজদের আসার পর সেই যে শুরু হলো,আর আজকে তা এসে আমাদের ঐতিহ্যের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে।
ইংরেজ-পূর্ব-যুগের যে সংস্কৃতি আঁকড়ে থাকতে গিয়ে আমরা বঞ্চিত হয়েছিলাম , আজ আমারা সেই ঐতিহ্যের ভুলে গেছি। যে সংস্কৃতি গ্রহণ করিনি বলে একসময় আমরা লাঞ্ছিত হয়েছিলাম আজ অনেক দেরীতে তাকেই ঐতিহ্য বলে সগর্বে প্রচার করছি এবং ইংরেজ-পূর্ব যুগকে যারা ঐতিহ্য হিসাবে প্রচার করতে চায় তাদের মধ্যে আমরা দালালের গন্ধ অনুসন্ধান করি।
মাওসেতুং তার 'নিউ ডেমোক্রেসী' গ্রন্থে বলেছেনঃ " আমাদের অতীতকে আমরা শ্রদ্ধা করি এবং ইতিহাসকেও আমরা কখনো অস্বীকার করব না। " আমাদের এ কথাটি স্মরণ রাখা উচিত। কারণ, ইতিহাস অস্বীকার করে কোন জাতি স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে পারে না, তারা পরিণত হয় এক জারজ জাতিতে।
কেউ কেউ মনে করে থাকেন, সংস্কৃতির সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। মানুষের সৌন্দর্যপিপাসু মন যেখানে ছন্দ খুঁজে পায়,মানুষ যেখানে মনের খোরাক পায়,ধর্ম সেখানে বাধ সাধবে কেন? এ প্রশ্নের জবাব অত্যন্ত সহজ। হরি কীর্তন যতই ছন্দের আনন্দ থাকুক না কেন, মুসলমান সংগীতামোদী হরি সংকীর্তনের ভক্তজন হতে পারে না। কারণ এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও কীর্তন করা ইসলামে অমার্জনীয় পাপ। তেমনি শূকর মাংস যত সুস্বাদুই বলে শোনা যাক না কেন,মুসলমান তার স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না।
কারণ ধর্মতঃ ওটা নিষিদ্ধ। কম্বল থেকে পশম বেছে নিলে যেমন কম্বল আর কম্বল থাকে না,থাকে কতগুলি জঞ্জাল,তেমনি সংস্কৃতি হতে ধর্ম বাদ দিলে সংস্কৃতি আর সংস্কৃতি থাকে না,থাকে কতগুলি কুসংস্কার।
বাংলা হিন্দুরও ভাষা মুসলমানেরেও ভাষা। যেমন হিন্দু পাঁঠা হিন্দুতেও খায়,মুসলমানেও খায়। কিন্তু যখন হরি নাম নিয়ে বলি দেওয়া হয়,তখন তা মুসলমানের জন্য হারাম হয়ে যায়;অথচ তাই হিন্দুর পরম খাদ্য।
আল্লাহু আকবার বলে যবাই দিলেই শুধু তা মুসলমানদের খাদ্য হতে পারে। শরৎচন্দ্র যে কথা বলে নিজের অপাগরতার জন্য দুঃখ করেছেন,মুসলমান সাহিত্যিক তো তেমনি কথা দ্বারা নিজের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করতে পারে না,যেখানে এদেশের নব্বইজন মুসলমান।
হিন্দুরা যখন বৃটিশদের নেক নজরে ছিল মানে ১৯৪৭ সালের পূর্বেকার হিন্দু সংস্কৃতির প্রাধান্যতার যুগে, আভিজাত্যের জাল বিস্তার করেও মুসলমানদের ধূতি-চাদর পরানো যায়নি,পূজা-পার্বণে যোগ দেওয়ানো যায়নি,গোমাংস ভক্ষণ বন্ধ করা যায়নি। কিন্তু আজ এ কথা ভেবে কষ্ট হয় আজ অনেকে বাঙালি সংস্কৃতির নামে ঈদের দিনে ধুতি পড়ে,কেউ শ্রদ্ধার নামে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালে,কেউ বিয়ের আগে এই সংস্কৃতির নামেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করে ছেলে-মেয়ে প্রকাশ্যে ঢলাঢলি করে, কেউ কেউ চন্দন ফোঁটা দেয়,কেউ কেউ শঙ্খ বাজায়, আর কেউ কেউ উলু দেয়, এই সংস্কৃতির নাম করেই অনেক মুসলমান পূজাতে যায় যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, হয়তবা এ সংস্কৃতির নাম করেই তথাকথিত সংস্কৃতিপ্রেমী মুসলমানেরা একদিন মূর্তির পূঁজায় লিপ্ত হতে পারে, আর যত নোংরামীকে এই সংস্কৃতির নামে বৈধতাও দিতেও হয়ত আটকাবেনা।
তবে সবাই যে অন্ধভাবে এই সংস্কৃতি মেনে নেবে তা মনে করা ভুল।
মনে রাখা উচিৎ যে, মুসলমানি ঐতিহ্যের নামে এ দেশের মানুষ যেমন পাকিস্তানীদের চাপিয়ে দেয়া উর্দুকে গ্রহণ করেনি,তেমনি বাঙালি ঐতিহ্যের নামে পশ্চিম বংগীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য একশ্রেণীর হীনমন্য সংস্কৃতিবিদ যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, এদেশের মানুষ তাও কোনদিন গ্রহণ করবে না।
বিদ্রঃ এই পোস্ট তাদের জন্য যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করেন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।