আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমিত আহমেদের 'গন্দম' পড়ে ব্লগীয় রিভিউ

জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।

অমিত আহমেদ যখন গন্দম দেয়া শুরু করেছেন সামহোয়ার ইন ব্লগে, সেই বছর খানেক আগে, তখন সবচেয়ে আগ্রহী পাঠকদের মধ্যে আমার নাম অবশ্যই আসবে। বিতিকিচ্ছিরি টাইপের ব্লগীয় পরিস্থিতিতে গন্দমের উপস্থিতি একমাত্র স্বস্তি ছিল! লেখক যখন সচলে হিজরত করলেন, তখন গন্দমের তল্পি তল্পাও গুটিয়ে নিলেন। এই আমি, গন্দমের লোভেই সচলে কিছু হিট বাড়ালাম। তারপর, ব্লগার অমিত আহমেদ যখন লেখক অমিত আহমেদ হয়ে উঠতে চাইলেন, তখন হুট করেই গন্দম ব্লগে দেয়া বন্ধ করে দিলেন।

কি নিষ্ঠুর, কি নিষ্ঠুর! ঋতু রাজীবের কি হয় জানতে মন খুশখুশ করে। সজীব ইশিতার স্বপ্ন পূরণ হয় কি না জানতে ইচ্ছা করে। এক সময় হুট করে শুনি করে অ.আ. বইও বের করে ফেলেছেন, মোড়ক উম্মোচনের ছবি টবি ঝুলিয়ে, ফেইস বুকে গন্দম ফ্যান ক্লাব খুলে টুলে কি এক অবস্থা! আর এদিকে, আমাদের মত বিশ্বস্ত পাঠকেরা, যারা গন্দমের জন্য আকুল কিন্তু কয়েক সাগর ডিঙিয়ে গন্দম হাতে পাবার আশা নেই, তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। খুব বেশি দিন ফেলতে হয়নি দীর্ঘশ্বাস। এক সহৃদ মানুষ আমার গন্দম আকুতি টের পেয়ে পাঠিয়ে দিলেন আস্ত একখানা চকচকে গন্দম! পাওয়ার দিনই রাতে দেড়টা অব্দি পড়ে গন্দমের রাজ্যির শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলাম।

ব্লগে পড়ার সময় ঘটনা জানার জন্য খুব তাড়াহুড়া করে পড়ছিলাম। দিন তারিখ, স্থানের ব্যাপারটা পুরাপুরি না দেখে ছিলাম। এবার মিনিটে মিনিটে সময় দেখলাম। ওহ, যারা জানেন না, বইটা ডায়রীর মত করে লেখা। দিন, তারিখ, মিনিট মিলিয়ে সময় আর ঘটনার শুরুতেই আলাদা করে জায়গার নাম ধাম।

এরকম উপন্যাস পড়ে অভ্যাস নেই। তাই প্রথম প্রথম হোঁচট খেতে হয়। দু’টো ভিন্ন সময় সমান্তরালে এগুচ্ছিলো। সেই ২০০৬ সালের শুরুর দিক আর ২০০৭ সালের শুরুর দিক। কিন্তু প্রথম কয়েক পর্ব পড়ার পরেই অভ্যাস হয়ে যায়।

এই স্টাইলটাই খুব ভালো লেগে যায়। সত্যি সত্যি দিন তারিখ আর জায়গার জন্য ঘটনাগুলোকে সত্যি মনে হয়। বইটা লিখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চবিত্তদের নতুন প্রজন্মের তরুণ তরুণীদের নিয়ে। বাংলাদেশে যাঁরা বাংলা বই লিখেন আর আমরা যারা বাংলা বই পড়ি, তারা প্রায়ে সবাই-ই মধ্যবিত (অন্তত: লেখা শুরু করার সময় কেউ উচ্চবিত্তের ছিলেন বলে আমার মনে পড়ছে না!)। সেই মধ্যবিত্ত লেথকেরা এক ধরণের হীনমন্যতা কিংবা ঔদ্ধত্য নিয়ে লিখে যান উচ্চবিত্ত শ্রেনী নিয়ে, ভিন্ন জাতের মানুষদের নিয়ে, তীব্র মমতা পাওয়া যায় না লাইনের ফাঁকে ফাঁকে।

পাঠকের মনেও তাই মমতা আসে না, সহানুভূতি আসে না। পাঠক ওদের সাথে নিজের জীবন কখনই মেলাতে পারে না, লেখক নিজে ওই জীবন বুঝে লিখে নি, পাঠক কি করে মেলাবে? চরিত্রগুলো তাই বড় দূরের থেকে যায়, কাঁচের ওপাশে, ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অমিত আহমেদের লেখায় সেই ভাবটা ছিল না, প্রচন্ড সাবলীলতা, আন্তরিকতা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি লিখে গিয়েছেন ওই প্রজন্মের কথা। আমি মধ্যবিত্তের ঘরের মেয়ে হয়েও বই শেষে ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি গাঢ় মমতা বাগিয়ে বসলাম। ওরা ড্রিংক করে, পার্টিতে নেচে, নারী পুরুষ নিয়ে আমার চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দর্শন পোষণ করে, ধর্মের ধার ধরে না, ড্রাগ নেই... তবু, তবু লেখকের কৃতিত্তে ওদের কেবলই মানুষ মনে হয়।

ভালোবাসা যায়, এমন মানুষ, আপন মানুষ। বইয়ের ভাষা একেবারে সাম্প্রতিক সময়ের তারুণ্যের ভাষা। ‘জোস তো!’, ‘তাফালিং করিস না’, 'চামে আছে', কিংবা কথার মাঝে হুট হাট ইংরেজি শব্দ, ‘আস্ক আউট’, ‘ডিসাইড’, ‘জাস্ট ফ্রেন্ডস’। গালাগালির ব্যাপারেও লেখক কোন সুচিবায়ুতা দেখান নি, যা বইয়ের অথেনটিসিটি বাড়িয়ে দিয়েছে। পড়ে চরিত্রগুলোকে পুরোপুরি চেনা যায়! লেখনী সাবলীল, গদ্য দারুণ রকমের ভালো।

গন্দমের কিছু অংশ কোলকাতায় আর কিছু অংশ ঢাকায় ঘটে। কোলকাতার অংশটুকুতে লেখক অমিত আহমেদ যেন হাত বদলে ফেলেন ছু মন্তরে। দিব্যি ‘আর্ধেক, মাইরি, পূজো’ মার্কা ওপার বাংলার বানানে বলে যান সেখানের গল্প। প্রথম বার ব্যাপারটা খেয়াল করে খুব মজা লাগে। লেখককে একটা ভীষণ ভালো কাজের জন্য অভিনন্দন দিতে চাই।

লেখক আমাদের মিথ্যা পৃথিবী দেখাতে চান নি। লেখক আমাদের, পাঠকদের বুদ্ধিমত্তাকে শ্রদ্ধা করেছেন। পাঠকদের নিজের লেভেলে বসিয়ে কথা বলেছেন, বাচ্চাদের মত সরলীকরন করে দেন নি কিছু। কি বলতে চাইছি বুঝাতে হুমায়ূনের উদাহরন ব্যবহার করি। হুমায়ূন আহমেদের মত লেখকের লেখা পড়ে একটা ঘোরে চলে যেতে হয়।

হুমায়ূন একটা আলাদা, অবাস্তব মায়া জগত তৈরি করেন, যেখানে সত্যি জীবনের সত্যিকারের দমবন্ধ করা ঝামেলারা নেই, এক জায়গায় গিয়ে হুট করেই পথ শেষ হয়ে যায় না। সেখানে বড় বেশি বুদ্ধিমতী আর মায়াবতী নারীরা দুমদাম হাবা হাবা ছেলেদের তীব্র প্রেমে পড়ে গিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দেয়। হিমু র‌্যাবের মুখো মুখি হয়ে এমন কথা বলে ছাড়া পেয়ে যায়, যা সবার বলতে বড় ইচ্ছা করে, কিন্তু কেউ বলতে পারে না। বই পড়ে পৃথিবীর কঠিন সমস্যাগুলোকে তুচ্ছ মনে হয়। এটা লেখক কেন করেন আমি জানি না।

লেখক মনে হয় ‘সবার’ জন্য লিখতে চান। নিজের বুদ্ধিমত্তার সাথে পাঠক কুলিয়ে উঠবে কিনা সন্দেহ করেন, তাই কঠিন বিষয়গুলো দূরে ঠেলে রাখেন। পাঠক এটা টের পেলে মেজাজ খারাপ করবে না? অমিত আহমেদ সেটা করে নি। তীক্ষ্ম চোখে দেখে, ছোটখাট বিবরনে মানুষের সাইকোলজি বুঝিয়ে দেন আমাদের। আমরা, খুব আটপৌরে সাধারন মানুষেরা ডক্টর ইউনুসকে নিয়ে তুমুল তর্ক করতে করতে যেভাবে অর্থহীন উত্তেজনায় মেতে উঠি, মাইক্রোইকোনমি, বিশ্ব অর্থনীতি আর নোবেল প্রাইজ, নন্দীগ্রামের মত সব ব্যাপার একেবারে প্রতিদিনের আড্ডায় নিয়ে আসি, অমিত আহমেদের চরিত্রেরাও তাই করে, একদম আমাদের মত করে, আমাদের ভাষায়।

তক্ক তুমুলে উঠলে একজন তুড়ি মেরে তক্ক থামিয়ে দেয়, ‘তোরা থামবি?’ আড্ডার অংশ হয়ে যাওয়া পাঠকেরা হঠাৎ ধাক্কা খায়, হঠাৎই যেন আড্ডাটা ভেঙে দিল কেউ, বুকের ভিতরের তার্কিক সত্ত্বাটা উসখুশ করে আরও কিছু বলার জন্য, আরও কিছু শোনার জন্য! সব বাস্তব, কিন্তু এর মধ্যেই সব হিসাব ভুল করা প্রেমরা চলে আসে, বাস্তবতার মতই। সজীব ঈশিতা কিংবা রাজীব ঋতু। চরিত্রগুলো দিয়ে অমিত আহমেদ কোন স্টেইটমেন্ট দিতে চেয়েছিলেন কি না আমি জানি না, কিন্তু আমি যেন শুনতে পেলাম... সমাজের যে কোন পর্যায়ে একজন ভালো মানুষ তৈরি করার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান তার পরিবার। মেয়ে ঘেষা প্লে বয় রাজীবের মাঝেও তাই এক সময় চলে আসে বিশ্বস্ততা, কমিটমেন্ট, আটপৌরে কিছুতে সুখ খোঁজা, শান্তি খোঁজার আকুতি। তার বাহ্যিক ড্যামকেয়ার, হিসাবী ভাবের আড়ালের ভালো মানুষটা হুট হাট বেরিয়ে পড়ে যখন তখন।

রানা মধ্যবিত্তের ছেলে, নওরীন মধ্যবিত্তের মেয়ে, ওদের প্রতি বিন্দুমাত্র মমতা জন্মে না পাঠকের। কিন্তু মধ্যবিত্ত ঈশিতা আর ঋতুকে পাঠকেরা খুব ভালোবেসে ফেলে। রানা, নওরীনেরা মধ্যবিত্তের চক্রে আটকে পড়া মানুষেরা, ঈশিতা, ঋতু সাহসী। হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখতে জানা মানুষেরা। গন্দম পড়ে মনে হয়, লেখকের দেখার চোখ আছে।

যা দেখেন, তা লিখার হাত আছে। বই শেষে কিছু অতৃপ্তি থেকে যায়, নিপুণ-দীপার গল্প শুরু হয়েও শেষ হয় নি। ওই ঘটনার সূত্রপাতের কারণ বোঝা যায় না, রানার চিন্তিত দৃষ্টি খুঁতখুঁতি রেখে যায়। এসব অভাববোধ ভুলতে সময় লাগে না, কারণ আগা গোড়া ভিন্নধর্মী এই বইয়ের স্ট্রং পয়েন্ট অনেক। আমি একজন খাঁটি পাঠক এবং ব্লগার, তবু দু:সাহস নিয়ে ভালো লেগে যাওয়া গন্দম নিয়ে একেবারে নিজের মত করে একটা রিভিউ লিখে ফেললাম।

কিছু ভালো লেগে গেলে আমি সবাইকে তার স্বাদ দিতে চাই। ইতিমধ্যে একজন পাঠক বাড়িয়েছি, আরেকজন বাড়ছে আগামীকাল । অমিত আহমেদের পথ চলা কখনও থেমে না যাক... গন্দম হোক তাঁর যাত্রাপথের শুরু।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.