অমিত বাবু প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে কারুকাজ করা সেগুন কাঠের বাক্সটা আয়রন কিং কোম্পানীর মজবুত সিন্দুক থেকে বের করে ডালা খুলে পাথরটা দেখেন। পিংপং বলের সমান হীরের মতো চকচকে পাথরটাকে একবার চোখের দেখা না দেখলে তার ঘুম আসে না। গত চল্লিশ বছর ধরে তিনি এই কাজ করে আসছেন।
পাথরটা যথেষ্ট রহস্য তৈরি করেছে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে। কারণ তারা পাথরটা দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।
পাথর সংক্রান্ত গল্প শুনেই তাদের খুশি থাকতে হয় সব সময়। ইচ্ছে থাকলেও দেখার কোনো উপায় তাদের নেই। অমিত বাবু খুব সাবধানে সবার কাছ থেকে পাথরটাকে আড়াল করে রাখেন। বছর পনের আগে পাথরটার মূল্যমান পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। বাংলা টাকায় যার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা! পাথরটার নাম, যাইকোরিয়ান হেলুলিব্রিয়াম।
সমস্ত পৃথিবীতে এই পাথরের পরিমাণ মাত্র একুশ পিস। যার একটার মালিক অমিত বাবু।
অমিত বাবু'র বয়স এখন তেষট্টি। ঝকঝকে মুখে দাড়ি গোফ কোনোটাই নেই। চুল এবং গায়ের পশম সব সাদা হয়ে গেছে আরো দশ বছর আগেই।
ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারার গম্ভির মানুষ। হাত পা কাঠি কাঠি এবং রুক্ষ। শরীর দেখলে বোঝা যায় এক জীবনে কঠোর পরিশ্রম করেছেন কিন্তু এখন আরামে আছেন। অমিত বাবু'র চোখের তারায় সব সময় শয়তানিসুলভ চাহনি ঝিলিক দিয়ে বেড়ায়। তার চোখ দুটো অসম্ভব রকমের স্বচ্ছ।
যা এই বয়েসর মানুষদের খুব একটা দেখা যায় না।
বুড়ো হয়ে গেলে কথা বেশি বলার যে প্রচলিত ধারণা তা তিনি কিছুটা হলেও ভেঙ্গে দিয়েছেন। তবে মনের মতো সঙ্গী পেলে আড্ডা দিতে ভালোবাসেন। আড্ডার বিষয়বস্তু বেশির ভাগ সময়ই অশ্লীল বিষয় নিয়ে হয়ে থাকে। এমনিতে কথা খুব কম বলেন।
কারণ তিনি মানুষ এড়িয়ে চলেন, গুটি কতককে ছাড়া। এই গুটি কতকের মধ্যে তার একুশ বছরের নাতনি আঙ্গুর বালা আছে। স্বেচ্ছা গৃহবন্দী অমিত বাবু নাতনিকে কাছে পেলে বেশ একটু গদগদ হয়ে যান। অসম্ভব জেনেও পঁচিশের উদ্যাম যৌবনে ফিরে যাবার একটা অদ্ভুত তাগিদ অনুভব করেন। বুড়ো বয়সটাকে তখন তিনি মনে মনে অভিশাপ দেন আর নিজের কুচকানো চামড়াকে করেন তীরস্কার।
সুন্দরী নাতনির হাতে তার কুচকানো চামড়ার খটখটে হাত রেখে প্রায়ই দু:খ করে বলেন,আহ! যদি আর একবার পঁচিশে ফিরে যেতে পারতাম!!! নাতনি দুষ্টু দাদুর আফসোস শুনে মিটমিট করে শুধু হাসে, কিছু বলে না।
আঙ্গুর বালা অমিত বাবুর তৃতীয় ছেলে অরিন্দমের দ্বিতীয় কন্যা। দেখতে দুধে আলতা টসটসে আপেলের মতন সুন্দরী। গত বছর লন্ডন থেকে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। আঙ্গুর বালা টের পায় বুড়ো দাদু তার সাথে কথা বলে খুব আনন্দিত হয়।
সে নিজেও দাদুর চটুল কথাবার্তার ভক্ত। সত্যি বলতে মনে মনে দাদুর মতন একজন শক্ত সামর্থ্য পুরুষকেই মনে মনে সে স্বামী হিসেবে পেতে চায়। পুরুষ মানুষ যদি মান্দার গাছের মতন না হয়ে কলা গাছের মতন ঢ্যাপসা টাইপের হয়, তাকে সে পুরুষই ভাবে না। বাস্তবিক সত্যিকারের মেয়েরা শক্ত খড়খড়ে মান্দার গাছই পছন্দ করে তাদের শিং ঘষে চোখা করার জন্য। নরম কলা গাছ না।
আঙ্গুর বালা জানে, তার দাদু হলো একজন সত্যিকারের মান্দার গাছ।
শনিবার রাত এগারোটা।
অমিত বাবু নাতনি আঙ্গুর বালার সাথে গল্প করছে তার শোবার ঘরে। অমিত বাবু বিছানায় শোয়া আর আঙ্গুর বালা নকশাদার কাঠের প্রাচীন চেয়ারে বসা। সাদা পোষাকে আঙ্গুর বালাকে পরীর মতন সুন্দর লাগছে।
বলা বাহুল্য, নিজের এই সৌন্দর্য বিকিরণের বিষয়ে সে পূর্ণ সচেতন। তার মুখ হাসি হাসি।
- দাদু, তোমার কপালের কাটা দাগটা নিয়ে কি তোমার মনে কোনো কষ্ট আছে? ওটা কিন্তু তোমাকে সত্যিকার পুরুষ হিসেবে ঘোষণা দেয়! তবু তো ক্ষুত বলে কথা!
- কপালের এই দাগটাকে আমি ভালবাসি! যাইকোরিয়ান হেলুলিব্রিয়াম পাথরটা পাওয়ার ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই কাটা দাগে। আহ! সে কত আগের কথা! যখন আমি টগবগে তরুন ছিলাম, যখন মেয়েরা আমাকে দেখলে খুশি হতো!
- দাদু, সত্যিকারের মেয়েরা এখনো তোমাকে দেখলে খুশি হয়। আমার বান্ধবি জান্নাত কী বলে জানো তোমার ব্যাপারে? বলে, তোর দাদু যখন যুবক ছিল, তখন কেন আমি জন্মিনি! তাহলেই বুঝে দেখো! কী গভীর আফসোস তার!!! হি হি হি...
- হুমম, জান্নাত সত্যিকারের একটি বাড়ন্ত মেয়ে।
জান্নাতের ফল-ই ওর জন্য সঠিক উপমা। রসালো, টক-মিষ্টি স্বাদ আর ব্যঙ্গ করাতে দক্ষ! ওর মতো মেয়েই মনে মনে চাইতাম আমি যৌবনে। যা চাওয়া যায় তা কখনো পাওয়া যায় না! শেষকালে কিনা পেলাম তোর দাদীর মতো একজন বেকুব মার্কা মহিলাকে! যে ধোপা বাড়ির গাধীর মতো খাটতে জানত, বিছানায় পড়ে থাকতে পারত প্রাণহীন পুতুলের মতো! ঘোড়ার তো একটা ঘুড়ী-ই প্রয়োজন! গাধী দিয়ে কাজ হয় না। তোর দাদী ছিল একটা গাধী! অপদার্থ মহিলা। আধুনিক কৃতদাসী! মরে নিজে বেঁচেছে আমাকেও বাঁচিয়ে গেছে! তবে তুই অন্য রকম! তোকে দেখলে আমার ভালো লাগে! তুই কী কারো সাথে প্রেম করিস না?
-দাদু! দাদীর ব্যাপারে যা বললে, তা কিন্তু সবটাই সঠিক নয়! বড় বাবা কিন্তু এজন্য তোমাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে! মেজো বাবাও! তুমি কেন সবাইকে ক্ষেপিয়ে বেড়াও বলো তো!
- সে তুই বুঝবি না! আমি চাই সবাই আমাকে ঘৃণা করুক।
ঘৃণার চোখ দেখতে আমার বড় ভালো লাগে! সে যাক, এখন তুই বল, কারো সাথে প্রেম করিস কিনা? মিনমিনে ভ্যান্তামার্কা প্রেম নয়, সত্যিকারের রসালো প্রেম! করিস?
- কিভাবে করব দাদু! পুরুষগুলো কেমন যেন সব ভ্যান্দা মার্কা হয়ে গেছে। আমার ভ্যান্দা পুরুষ দেখলে মেজাজ খারাপ হয়। চারপাশে এদেরই তো দেখি! আচ্ছা দাদু, তুমি কী আমাকে ভালোবাসো?
- এই বয়সে বৌ হারিয়ে শুধু এটুকুই করা যায়। হ্যাঁ, তোকে খুব ভালবাসি। কাছে আয় আমার আদরের নাতনি! যাহ! তোর জন্য একজন সত্যিকারের পুরুষ আমিই খুঁজে দিবো যদি বেঁচে থাকি! যে তোকে চূড়ান্ত সুখী করবে প্রতিদিন!!
- দাদু তাহলে তোমার সিন্দুকে রাখা পাথরটা একবার দেখাও আমাকে।
আমি দেখতে চাই, ছুঁতে চাই!
- হা হা হা...সে হবে না রে খুকি। পাথর দেখা হবে না। আজ চলে যা, আমি এখন ঘুমাবো। শরীরটা বেশি যুতসই লাগছে না! কাল সকালে আসিস...
অমিত বাবু লক্ষ করলেন, পাথরটা দেখাতে না চাওয়ায় তার নাতনি সুন্দরী আঙ্গুর বালা'র চকচকে লোভনিয় চোখ ভয়ানক ক্রোধে জ্বলে উঠল! তবে সে সামান্য সময়ের জন্য। তিনি মনে মনে হাসলেন।
ভাবলেন, লোভি চোখ দেখতে তোমার কেন এতো ভালো লাগে দুষ্ট বুড়ো অমিত বাবু? একদিন এর জন্যই মরবে! তা জানো? সবাই অপেক্ষায় আছে তোমার মৃত্যুর! এ তোমার কেমন খেলা? অমিত বাবু বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে মনে মনে নিজের সাথে কথা বলতে লাগলেন। চল্লিশ বছরে আজই প্রথম তিনি ভুলে গেলেন ঘুমানোর আগে পাথরটাকে এক নজর দেখার কথা। এমনকি দরজায় তালা ঝুলানোর কথাটাও।
যাইকোরিয়ান হেলুলিব্রিয়াম পাথরটা তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে নয়, নিশ্চিত হবে, এমনটা অমিত বাবু জানেন। কারণ এখন পর্যন্ত পাথরটা চুরি করার চেষ্টা করা হয়েছে মোট ছয় বার।
লাকি সেভেনে কী হয় কে জানে! সব থেকে মজার বিষয়, চোর তার ঘরের মানুষই। তবে সে যে কে তা তিনি জানেন না। তার তিন ছেলে, দুটি মেয়ে। মেয়েরা শ্বশুর বাড়ী বছর বছর বাচ্চা বিয়োতে ব্যস্ত। ছেলেরা কুটকচালিতে।
টাকা আয়ের দু:শ্চিন্তা তাদের না থাকায় তারা এ কাজ করার অঢেল সময় পায়। অমিত বাবু ঘুমের ঘোরে ছেলেদের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বললেন, সব শালা অপদার্থ কুকুর! এগুলো কার সন্তান কে জানে! এক একটা ভ্যান্দা মাছ!
রবিবার সকাল সাতটা।
সকাল বেলা খুব করে সেজেগুজে আঙ্গুর বালা তৈরি হয়েছে দাদুর ঘরে যাবার জন্য। বাঁ হাতে ঘড়িটা মাত্র গলিয়েছে এমন সময় শুনতে পেল বড় বাবা চিৎকার করে ডাকছে সবাইকে। চিৎকারে মিশে আছে ভয়ানক ভয় পাওয়া আর গভীর বেদনার ছাপ।
আঙ্গুর বালা ভাবছে, বড় বাবা কী দেখে ভয় পেল?
দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠে দেখল দাদুর ঘরের সামনে জটলা! সবার মুখেই ভয়ের ছাপ। কাজের ছেলে আর মেয়েটা কোনায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে! আঙ্গুর বালা জটলার কাছে গিয়ে দেখে দাদু বিছানায় গত দিনের মতই শোয়া। তবে গলাটা কেউ একজন প্রবল আক্রোশে চিড়ে দু'ফাক করে দিয়ে গেছে ধারালো ছুরি দিয়ে। বিছানার সাদা চাদর কালচে খয়েরী হয়ে গেছে। মেঝেতেও পড়ে আছে ছোপ ছোপ রক্ত! পাশেই আয়রন কিং কোম্পানীর মজবুত সিন্দুকটা ভাঙ্গা।
ভিতরে কাঠের নকশা করা বাক্স গায়েব। সিন্দুকের পাশে সাদা প্লাস্টিক পেইন্ট করা দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা...
'পাথরের মূল্য পরিশোধিত হলো বদলা রক্তের দাম দিয়ে। চল্লিশ বছরের পুরনো ঋণ। '
পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ রুটিনওয়ার্ক। পুলিশ এলো, গোয়েন্দা দল এলো।
অনেক ইনভেস্টিগেশন হলো কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। রহস্য অমিমাংষিতই থেকে গেল। পাথর রহস্য ভেদ হলো না। তবে এত কিছুর ফাকে একটা মজার ঘটনা ঘটল, যা কেউ ভাবেনি। সেটা...।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।