যারা উত্তম কে উচ্চকন্ঠে উত্তম বলতে পারে না তারা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে শুকরকেও শুকর বলতে পারে না। এবং প্রায়শই আর একটি শুকরে রুপান্তরিত হয়।
প্রায় ৭ বছর আগে তোলা স্যাটেলাইট ছবির সাথে ঝিলের ওপারের হলদুটোর কি কি মিল অমিল আছে সেটা নিয়ে রহমত গভীর চিন্তায় মগ্ন। সে যেখানে বসে আছে ঠিক তার বিপরীতে ঝিলের ওপারেই মেয়েদের এই দুটো হল। তার কাছে সব সময়ই গভীর কৌতুহল আর রহস্যের জায়গা।
হয়ত এজন্য যে, সে চাইলেও সেখানে ঢুকতে পারেনা অথবা সেখানে বসবাস করে এমন কারোর সাথে তার নৈকট্য কখনো এই পর্যায়ে পৌছায়নি যে সে হল দুটোর যে কোন একটি কিংবা ভাগ্য ভাল হলে দুটোরই সামনে যেয়ে কারো জন্য নিয়মিত অপেক্ষা করতে পারে। প্রথম কয়েক বছর হলের ভেতরে ঢোকার বিষয়টা তার কাছে ফ্যান্টাসিই ছিল, এখন যেটা একেবারে অসম্ভব না জাতীয় সম্ভাবনা হলেও কি এক মানসিক অবস্থা তাকে নিরুৎসাহিতই করে। বরং কল্পনা অনেক সুখকর এখন তার কাছে।
এই উপর থেকে দেখা ছবির সাথে কাছাকাছি দেখার তুলনা রহমতকে একটা অদ্ভুত সুখের অনুভূতি দিচ্ছিল, যেটা খুব সঙ্গত কারণেই আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষজনের পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব। এটা অনেকটা গোপনে নারীর প্রিয় স্তনকে কল্পনা করার মত।
এর উচ্চতা, এর তীক্ষ্ণতা, এর চূড়া, এর সুডৌল অবস্থিতি, এর/একে উন্মোচন আকাঙ্খা, এর গোপনীয় দৃশ্যমানতা ও প্রায় চিরকালীন অদৃশ্যময়তা এবং তারচেয়েও কষ্টকর অস্পর্শিতা। পর্ণগ্রাফিক মগজ যেটাকে সহজেই ট্যাগ করার চেষ্টা করবে এক কথায় ‘বুবস লাভার’ হিসেবে। যদিও বিষয়টা তেমন সরল নয় মোটেও; তেমনটা নির্বোধও নয় কখনই। রহমতের এই আত্ম রোমন্থন ভূগৌলিক ও মানবিক। তাই নিশ্চিতভাবেই কামজ।
কিন্তু ভোঁতা চোখে সেটাকে অনুমান করাও কষ্টসাধ্য। এটা রহমতও খুব ভাল করে জানে। তাই সে আশপাশের লোকজনার এই ভীরের মধ্যেও নিশ্চিন্ত মনেই মানবিক ভূগোলের মন্থনে নিজেকে সক্রিয় রেখেছে। অন্য বিষয়ের ক্ষেত্রে যেমনটা হয় ঠিক ঠিক তেমনটা না হলেও তার মগজ নিজস্ব গতিতে সুডৌল উচ্চতার যেসব প্রতিরূপ তার স্মৃতিতে গচ্ছিত আছে সেগুলোর একটা স্লাইড শো শুরু করে দিয়েছে। বিষয়টা রোমাঞ্চকর নি:সন্দেহে।
ঠিক তখনি অত্যন্ত দ্রুত গতির একটা বিশেষ উচ্চারণ তার সমস্ত মনোযোগকে বিশৃঙ্খল করে দিল। এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকল কেননা, অপরপক্ষ খুব দ্রুত ও জোরের সাথে একই কথা বলে চলেছে। বেদে মেয়েটির আগমন সে আগেই লক্ষ্য করেছিল কিন্তু সে যে তার সাথে মোকাবিলায় প্রস্তুত নয় রহমত তা ভুলে গিয়েছিল। এবং সাধারণত যা হয়না ঠিক সেটাই ঘটল, রহমতের চোখ নিচ থেকে উপরে ওঠা শুরু করল। বেদে মেয়েটিরও এক জোড়া দারিদ্র্যক্লিষ্ট দালান যা কোনভাবেই হল দুটোর সাথে তুলনীয় নয়।
যদিও সমগ্র গঠনে নতুন বাড়ী শুরু করার আনন্দ উছলে পড়ছে। রহমতের আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পরিমাণ-পরিসর ধারণাকে প্রশ্ন করতে করতে বেদে মেয়েটির সাচ্ছন্দ্য এবং পেশাদ্বারীত্ব একেবারে ছাপিয়ে উঠল। এবং রহমত বুঝল যে আজকে অন্তত তার স্মার্ট হওয়ার কোন মানে নেই, সে ইতমধ্যেই ফাপড়ে পড়ে গেছে।
মেয়েটি খুব দ্রুত বলে চলছিল, ‘মায়াবী মুখ,মনটা সরল, কন্যা রাশি; দেনা ভাই; এই বোনকে কয়েকটা টাকা দিবিনা। ‘ ‘তুই তো অনেক বড় হবি,মায়াবী মুখ,মনটা সরল, কন্যা রাশি; দেনা ভাই’।
এবং বারবার বলছিল। মধ্যবিত্ত অপ্রস্তুত রহমত এই পরিস্থিতির মধ্যে এক নিদারূণ বৈপরীত্যের স্বাদ পাওয়া শুরু করেছিল কিন্তু সর্বপোরি সে অসহায় বোধ করছিল। একজন নারীর কাছে সকল পুরুষ যেমনটা অসহায় বোধ করে, যেমনটা সে ঐতিহাসিকভাবেই বোধ করে এসেছে। রহমত তার শেষ সম্বল অর্থাৎ কৌতুহলকে আঁকড়ে ধরে মেয়েটির কাছ থেকে কন্যা রাশি সর্ম্পকে আরো কিছু জানতে চাইল। মেয়েটি ইতোমধ্যে রহমতকে প্রায় পেয়ে বসেছিল, তার আরো কয়েকজনের কাছে যাবার তাড়া ছিল, যদিও তার মধ্যে সেই ঐতিহাসিক দয়ার্দ্র অবস্থানটি অটুট ছিল।
যেটা হয়ত মেয়েটি নিজেও জানতো না। সে বলল, ’তুই মুখে যারে চাবি তারে তুই এমনিই; পাবি কিন্তু মন থেকে যারে চাবি তারে কখনই পাবিনা। ‘ এটা রহমতের জন্য ছিল তরবারীর শেষ আঘাতের মত। ভেতরে ভেতরে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হওয়ার ফলেই কিনা, এইবার রহমত একটু দুষ্টুমী করে বলল, কেননা দুষ্টুমী করার অধিকার যে তার আছে কি এক গোপন সংকেতে এই তথ্য সে ইতমধ্যেই মেয়েটির কাছে থেকে পেয়ে গিয়েছিল। তাহলে কি করলে নিজের মনের মানুষ পাওয়া যাবে? কথাগুলো এমন গুছিয়ে না বলতে পারলেও রহমতের প্রশ্নের ভাব বেদে মেয়েটি চট করে ধরে ফেলল।
সে বলল ,’ভাই তাইলে একটা তাবিজ নে মাদুলি নে। নে ভাই নে। ‘ এই বলে মেয়েটি তার হাতের ছোট বাক্সটা থেকে, যেখানে অন্তত একটা বিষহীন (যদিও রহমত সঠিক জানেনা, কেননা বেদে মেয়েটিকেই তার যথেষ্ট বিষমধুময় মনে হচ্ছিল) সাপকে তার ভরে রাখার কথা, সেখান থেকে একটা মাদুলি বের করে প্রায় দিয়েই দিচ্ছিল। কিন্তু রহমত এবার বেশ জোরালো ভাবে মাথা নাড়ানোতে বেদে মেয়েটি নিবৃত্ত হল। এর একটা কারণ এও ছিল যে ক্ষণিকের এই আলাপে রহমতের বেদে মেয়েটির উপর স্থানিক বিশ্বাস তাকেও কিছুটা প্রভাবিত করেছিল।
রহমত খেয়াল করল যে মাদুলীটা ছোট বাক্সটায় ঢুকিয়ে নেয়ার সময় মেয়েটি খুব পরিচিত একটা ভাব করে হেসে উঠছে। হাতের খুচরা টাকাগুলো বেদে মেয়েটিকে দিতে চাইলে, যদিও সে মানিব্যাগের দশ টাকার নোটকে নিয়ে আঁকড়ে থাকল। উপায়ান্তর না দেখে রহমত সেই দশ টাকাই তার হাতে তুলে দিল। এবং তার একটুও দু:খ লাগল না। হাতের খুচরোগুলো পকেটে ভরতে যাবার সময়ই বেদে মেয়েটির আরেক সহযোগী বন্ধু এসে আবারও যেন বাক-সম্মহনের মধ্য দিয়েই টাকাগুলো নিয়ে গেল।
এবং চলে যেতে যেতে অস্ফুটে যদিও তীব্র ভাবে রহমতের উদ্দেশ্যে বলল, ’ভাই কি আমাগো দিকে তাকাইবেন, আপনে তো আপাগো দিকেই যাইবেন......’।
রহমত ইতোমধ্যে পুরোপুরি বিদ্ধস্ত হয়ে পড়েছিল। কারণ নির্মিয়মান দালানের বেদে মেয়ে দুটির কথাকে কোনভাবেই কেবল বানিজ্যিক বলে মানতে পারছিলনা। ঢাকার বাস ছাড়িছাড়ি করছিল। রহমত খেয়াল করল যে বাসের জানালা দিয়ে তার হতে পারত প্রেমিকা বন্ধুটি এই পুরো ঘটনাটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছে।
কিন্তু এটা নিয়ে তার কোন বিকার বা লজ্জা ছিল না। কেননা তাকে নিয়ে রহমত খুবই হতাশ ছিল। অনেকটা সর্ম্পকের দালান ভেঙ্গে পড়ার হতাশা। বাস যখন একেবারেই ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, তখনি রহমত লাফ দিয়ে উঠে ইঞ্জিন কাভারের উপর বসল। যাত্রার পুরো সময়টাতেই রহমতের কেবলই মনে হচ্ছিল...সমস্ত বাসে যতগুলো নারী আছে তাদের কেউই সেই দারিদ্র্যক্লিষ্ট দালানের বেদে মেয়েটির কাছাকাছিও নয়।
কিন্তু কেন নয় তা সে এখনও বুঝতে পারছে না। সে তখনি সিদ্ধান্ত নিল, পরবর্তী সুযোগ পাওয়া মাত্র সে তার সাথে বন্ধুত্ব করবে; আর সে সুযোগ যদি নাও পায় তাহলে অন্তত সম্মৃদ্ধ দালানের খামতিগুলো বোঝার চেষ্টা করবে। এটা এখন রহমতের জন্য কেবল কৌতুহল নয় এটা তার অস্তিত্বের জন্য আবশ্যিক দরকারী একটা বিষয়। কেননা কল্পনার কাজ বাস্তবের রূপায়ন, বাস্তবতা বিচ্যুত হওয়া নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।