যারা উত্তম কে উচ্চকন্ঠে উত্তম বলতে পারে না তারা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে শুকরকেও শুকর বলতে পারে না। এবং প্রায়শই আর একটি শুকরে রুপান্তরিত হয়।
ছুটির দিন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার তাড়া নেই। দীর্ঘদিনের বদভ্যাসের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে সত্যি সত্যি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারার পর নিজেকে এখন নির্বোধ মনে হচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই কি করব তা বুঝতে পারছিনা।
সকালের নাস্তা, সংবাদ পত্র, সাহিত্য পত্রিকা ইত্যাদি সবকিছুতে চোখ বুলিয়ে যাবার পরও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সবে দশটা, অর্থাৎ একটা দীর্ঘ দিন সামনে পড়ে আছে অথচ করার মত কিছু নেই।
ঠিক এমন সময় কলিং বেলের শব্দ। দরজা খুলে যা দেখলাম তাতে একটা সূ আশাবাদ সৃষ্টি হল, দিনটা বোধহয় ভালোই কাটবে। একেবারে চোখের সামনেই পয়ত্রিশ বৎসর ধরে প্রবলভাবে টিকে থাকা এবং নি:সন্দেহে পরিপূর্ণ ইন্দ্রীয় প্যাকেজ, ময়মনসিংহের আন্টি। সুন্দরী, সুগঠিত এবং সাবলীল সৌকর্যে ভাষ্মর।
তার সম্পর্কে যা শুনেছি, আসলে যা দেখেছি তাতে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে ইনি নিয়মিত স্বামী কতৃক নির্যাতিত হন। কিন্তু বিষ্ময়ের এখানেই শেষ নয় কেননা ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন শ্যামল বর্ণের বিদু্যৎসম তরুনী। আমি মনে মনে খুশী হয়ে উঠলাম, সব ছুটির দিন নিশ্চয়ই খারাপ যায় না।
তরুণীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে আন্টি বললেন, সাবরিনাকে তোমার কথা বলতেই ও দেখা করার জন্য আসতে চাইল। আমি ওকে বলেছি যে তুমি মানুষের হাত দেখে অনেক কিছু বলে বলে দিত পার।
আমি মনে মনে বললাম সেরেছে এইবার তো মাইনকার চিপায়, হাতদেখা হল বাংলাদেশের প্রেীতে গবেষণার জন্য খুবই কার্যকরী টুল। যে লোক আপনাকে সাধারণত এঙ্সে দেবে না সেও হাত দেখতে জানি শুনলে সুর সুর করে এসে কথা বলবে। আন্টির সাথে আগের সিটিংয়ে এই টেকনিক ব্যবহার করেছিলাম, কিন্তু উনি যে এমন সিরিয়াস হয়ে অন্য আরেকজনকে নিয়ে আসবেন তা স্বপ্নেও ভাবিনি। একদিক দিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। তবে আমি ঠিক করলাম গবেষণা নয় বরং প্রায় আমার সমবয়সী মেয়েটির সাথে আমি বন্ধুত্ব করব।
তরুনী একটা প্রাইভেট মেডিকেলে পড়েন এবং শেষ বর্ষের ছাত্রী। আমি খুব সচেতনভাবে গবেষণা বাদ দিয়ে বন্ধুত্বের জন্য যেসব বিষয় প্রাসঙ্গিক সেগুলি নিয়ে কথা বলছি। বরাবরের মতই আমি কথার সূত্র ধরিয়ে দেবার জন্য বলছি এবং তিনি শুনছেন, তবে আমার অশেষ শ্রমের কারণে অবশেষে তিনিও বলতে শুরু করেছেন। দীর্ঘণ ধরে কথা হচ্ছে অথচ তিনি বনানী-গুলশান, প্যারিস, সামপ্রতিক ভারত ভ্রমণ এবং মোবাইলের বাইরে আসতেই পারছেন না। এদিকে নি:শ্বাসে প্রশ্বাসে বাবার সচিব হওয়াটা শ দুয়েকবার মনে করিয়ে দেবার পর কথা এখন পারফিউম, বয়ফ্রেন্ড, ট্রেন্ড এগুলোর দিকে এগুচ্ছে।
আমিও বুঝতে শুরু করেছি যে এভাবে চলতে থাকলে আলাপচারিতা খুবই বোরিং হয়ে উঠবে।
আমি একটা সহজ পথ খুঁজতে থাকি, অবেশেষে তাকে নিজের বিষয়ে বলতে উৎসাহিত করি। তিনি বললেন তার এমনিতেই বন্ধু কম, কেননা অনেকেই তাকে অহঙ্কারী মনে করে, কিন্তু আসলে তিনি মোটেই অহঙ্কারী নন। আসলে কেউ তাকে বুঝতে পারে না। আমি খুবই বিণীত হয়ে বললাম নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই তাই হয়ত হবে, আপনি বোধহয় একটু রিজার্ভ ধরণের।
কিন্তু আপনার বয়ফ্রেন্ডও কি আপনাকে বুঝতে পারে না? উনি বললেন ও পারে কিন্তু সবটুকু নয়।
এভাবে দীর্ঘসময় আলাপচারিতার পর যখন আমার মনে হতে শুরু করেছে যে আর যাইহোক একজন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হল ঠিক তখনই তিনি একটি দূর্দান্ত কাজ করে বসলেন। তিনি বললেন, আপনি কি আসলেই বিশ্বাস করেন যে আপনি মানুষ সম্পর্কে বলতে পারেন? প্রশ্নটা আমার জন্য আকষ্মিক ছিল। আমি বললাম হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? তিনি বললেন, আন্টির কাছে আপনার অনেক নাম শুনেছি হাতে কাজ ছিলনা তাই আজকে এসেছিলাম বিষয়টা পরীা করতে। আপনি আসলে কিছুটা জানলে তারপর সেটির উপর ভিত্তি করে কিছু বলতে পারেন কিন্তু আপনার অন্য কোন মতা নেই।
নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা রাখবেন না। আমি এতণ এজন্যই চুপ করে ছিলাম যে দেখি আপনার কোন মতা আছে কিনা।
তরুণীর কথা শোনার পর আমি একটা ধাক্কা খেলাম, প্রথমে মনে হল পরিষ্কার করা দরকার যে আমি গবেষক, গণক নই। আমিও একটু নাগরিক গণিতে ঝাঁপ দিলাম। বুঝতে পারলাম যে বালিকা ভিকানুনের কাস এইটের ছাত্রীই রয়ে গেছেন এবং এখানে এসেছেন একজন হিমু খুঁজতে।
ধাক্কা সামলে ওঠার পর ভেতরে ভেতরে আমিও মজা পাওয়া শুরু করলাম। যেহেতু তিনি হিমু খুঁজতে এসেছেন তাকে তো খালি হাতে ফেরানো যায়না। খুব বেশি কষ্ট করতে হল না। কেননা ইতোমধ্যে যিনি যা তথ্য দিয়ে ফেলেছেন তাতে তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক চরিত্রের একটা মোটামুটি চিত্র স্পষ্ট এবং এটি কয়েক হাজার হাতদেখার চাইতে অনেক বেশি নিখুঁত।
কিছু সাধারণ বিশ্লেষণ উপস্থাপনের পর তরুনী চমৎকৃত হলেন কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলেন না।
তাকে আরেকটু কনফিউজড করার জন্য, মনে মনে হাসতে হাসতে আমি বললাম, আমি বিশ্বাস করি যে আমার কিছু দৈবিক মতা আছে। এবার বালিকা আর আগের মত প্রতিরোধ করতে পারলেন না, একটু আমতা আমতা করলেন এবং নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। হিমু নাকি মিসির আলী এই দ্বন্দ্বের মধ্যে আবর্তিত হতে হতে যখন তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, তখন তিনি আবার আমাকে সতর্ক করলেন যে আমার কোন বিশেষ মতা নেই এবং এটি নিয়ে আমার যেন কোন ভ্রান্তি না থাকে। আমি উত্তর দিলাম না।
গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়ে আমার একটা দৃশ্যের কথাই কেবল মনে পড়ল।
রাজধানী থেকে সরকারের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা যখন মফস্মল ভিজিটে যেত তখন নিম্নপদস্থরা তার ফেরার সময় হলে ঘুষ হিসেবে টাকা পয়সার সাথে সাথে বড় বড় মাছ দুহাতে দিয়ে দিত। আর উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা সেই মাছ নিয়ে এসে সে তার স্ত্রীর কাছে বাহাবা নিত। বালিকাটিকে দূর থেকে দেখে আমার ঠিক মনে হল যে এখন ওর দুই হাতে একটা হিমু আর একটা মিসির আলী ঝুলছে। কিন্তু বেচারা ঠিক করতে পারছেননা যে নিম্নপদস্থর কাছ থেকে তিনি উপঢৌকন পেয়েছেন সেকি তাকে কিছু প্রদান করল নাকি শেখানোর চেষ্টা করল। কনফিউজ্ড লাইফটা টোটাল কনফিউজ্ড।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।