বেঁধেছে এমনও ঘর শুন্যের ওপর পোস্তা করে..
এমন একটা সময় ছিল যখন আরব দেশের লোকেরা খোরমা খেজুর খাইয়া জীবন ধারণ করিত। এই বঙ্গদেশে তখন গোলা ভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ ছিল বলে জনশ্রুতি রহিয়াছে, বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ব্যাপার। তবে একথা সত্য যে গাছে গাছে ফুল ফুটিত ও বনে বনে পাখিরা ডাকিত। পাখির ডাক- এ এমনই এক জিনিস যে আনন্দ, বেদনা বা ক্ষোভ যাহা ব্যক্ত করিতেই ডাকুক না কেন তাহা সকল সময়েই সুমিষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। সুতরাং বনে বনে পাখি ডাকিত একথা সত্য হইলেও তাহারা কি মোটিভে ডাকাডাকি করিত তাহা পরিস্কার নহে।
এরকমই কোন একটি সময়ের কথা কহিতেছি। মহামতি বুদ্ধের অনুসারী ভিক্ষুগণ তখন সমগ্র ভারতবর্ষে অহিংসাব্রত প্রচার করিতেছিলেন। বঙ্গদেশেও তাহাদের কর্মপরিধি বিস্তৃতছিল। বঙ্গদেশে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের অন্যান্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন ছিলেন লুই'পা। এই ভিক্ষুগণ তাদের নিত্যকার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করিতেন যাহা পরবর্তীকালে চর্যাগীতিকা বা চর্যাপদ নামে খ্যাত হয়।
একদিন পাহাড়ী রাস্তায় হাটিতেছিলেন লুই'পা। একটি নির্জন টিলার ওপর উঠিয়া কান্তিবোধ করিলে ক্ষণকালের জন্য বিশ্রাম লইতে থামিলেন তিনি। তৃষ্ণার্ত বোধ করিয়া আশেপাশে চাহিলেন যে কোন ঘরবাটী দৃশ্যগোচর হয় কি না। টিলার একেবারে কোণের দিকে একটি কুড়ে দেখিয়া তৃষ্ণা নিবারণের নিমিত্তে সেইদিকে অগ্রসর হইলেন। তথায় হাজির হইয়া তিনি পানি বলিয়া উঠিলে কুড়ের ভেতর থেকে মধ্যবয়স্ক রোগা এক ব্যক্তি বাহির হইল।
ভিক্ষু দেখিয়া সে অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িল। কিরূপে এই সম্মানীয় অতিথির আপ্যায়ণ করিবে? মাটির সরায় পানি আনিয়া সে অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া কহিল, ভদ্র, আপনাকে আপ্যায়ন করিতে পারি এমন কিছুই আমার ঘরে নাই। লুই'পাও লজ্জিত হইয়া তরিৎ কহিলেন, তৃষ্ণার পানিই যথেষ্ট। অন্য কোন কিছুর আবশ্যক নাই। কথায় কথায় তিনি জানিতে পারিলেন, নি:সন্তান এই দম্পতির অন্য কোন সহায় নেই।
কোনমতে এই নির্জণে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করিতেছে। বিদায় বেলায় লই'পা দিধাগ্রস্থ হইলেন ইহা ভাবিয়া যে হতদরিদ্র এই ব্যক্তিকে তিনি কি অহিংসার বাণী শোনাইবেন? অত:পর আরো উঁচু উঁচু পাহাড়ে উঠিলেন এবং বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়া লুই'পা দিনের কর্ম সম্পাদন করিলেন। ফিরিবার পথে টিলাবাসী অসহায় ব্যক্তিটির কথাই তিনি পূণ:পূণ: ভাবিতেছিলেন। তাহার মাথায় কয়েকটি লাইন ঘুরিতেছিল। তিনি লিপিবদ্ধ করিলেন।
তাহার প্রথম দু'লাইন ছিল এরকম-
'টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী
হাড়িত ভাত নাহি নিতিআ আবাশী'
হেনকালে তিনি পাগল পীরের সম্মুখে পড়িলেন। তিনি পাগল পীরকে দেখিতে পাইলেন না কিন্তু পাগল পীর তাহাকে দেখিতে পাইল। লুই'পাকে দেখিয়াই পাগল পীর তাহার মনের যাবতীয় অবস্থা পড়িয়া লইলেন। বুঝিলেন, সংসারের দুঃখ দারিদ্র্য লইয়া ভিক্ষু বড়ই বিচলিত। সহসা তাহার গৌতমের কথা মনে পড়িল।
মনে পড়িল সেও মানুষের দুঃখ, দূর্দশা, জ্বরা-ব্যাধি, হিংসা-ক্রোধ দেখিয়া এরূপ বিচলিত হইতো। হঠাৎ করিয়া পাগল পীরের কি মনে হইল যে তিনি ভাবিলেন, এই ভিক্ষুর ঈমানের পরীক্ষা লইয়া দেখি না কেন?
টিলাবাসী অসহায় দম্পতির দূর্গতির কথা চিন্তা করিতে করিতেই লুই’পা টের পাইলেন, চকিতে তার চক্ষুদ্বয়ে যেন একটি আলোর ঝলক আসিয়া লাগিল। ক্ষণকাল পরেই পরিস্কার হইলো, ইহা সেই শবরী বালিকার গাত্রের রঙ্গীন জামার বর্ণচ্ছটা, যাহাকে অদ্য দ্বিপ্রহরেই আপন পিতামাতার সম্মুখে ধর্মপোদেশ দান করেছেন তিনি। লুই'পা বিচলিত বোধ করিলেন, শবরী বালিকার রঙ্গীন বস্ত্র তাহার চক্ষুতে ভাসিবে কেন? এখানেই যদি শেষ হতো তথাপি লুই'পা রক্ষা পাইতেন, শেষ হইলো না। শবরী বালিকার বর্ণময় বস্ত্রের অন্তরালে সদ্য বিকশিত পুস্পকমঞ্জুরী, যাহা বৃহৎ পর্বতমালার মধ্যেও ক্ষুদ্র টিলার মাধূর্যের মত স্বীয় আলোয় উদ্ভাসিত; তাহা অকস্মাৎ স্মরণে আসিয়া ভিক্ষুকে বিহবল করিয়া তুলিল।
ভিক্ষু প্রভু বুদ্ধের নাম স্মরণ করিয়া মস্তিস্ক হইতে বিভ্রম ঘুচানোর চেষ্টা করিলেন, সফল হইলেন না। টলিতে টলিতে আপন আশ্রমে ফিরিয়া আসিয়া লিখিতে বসিলেন। লিপিবদ্ধ হইলো-
উঁচা উঁচা পাবত তাহী বসই শবরী বালি,
মৌরঙ্গী পিচ্ছ পরহিন শবরী গেবত গুঞ্জরীমালী।
এর এভাবেই এতশত বছর পরেও আমাদিগকে শবরী বালিকার সৌন্দর্য হতে বঞ্চিত হতে হইলো না। সবই পাগল পীরের কল্যাণে।
জয় পাগল পীর!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।