‘প্রাণের ছবি, গানের ছবি
মন মাতানো প্রেমের ছবি
পাগল মন পাগল মন পাগল মন’
...হাঁ ভাই, আসিতেছে আসিতেছে, দর্শন সিনেমা হলের রুপালি পর্দায়, আগামি শুক্রবার থেকে, তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত, পাগল মন, পাগল মন, পাগল মন...ও পাগল মন, মন রে, মন কেন এতো কথা বলে...ও পাগল মন, মন রে, মন কেন এতো কথা বলেএ এ এ এ এ এ...!!
সারাদিন টইটই করে ঘুরে রাজ্যের বাঁদরামি করা আমি হঠাৎ করে মাইকের এই শব্দ শুনে দিক্বিদিক হয়ে ছুট লাগালাম বড় রাস্তার দিকে, রাস্তায় উঠে অবাক চোখে দেখলাম একটা ভ্যানগাড়ির চারিদিকে রঙ বেরঙের পোস্টার লাগিয়ে একজন লোক এই সিনেমার মাইকিং করে বেড়াচ্ছে। বড়ই উত্তেজনাকর আর নতুন একটা ব্যাপার আমার কাছে।
আমাদের গ্রাম শহর থেকে বেশ দূরে হওয়াই সিনেমার এই ধরনের মাইকিং আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আর আমাদের বড় রাস্তা বছরের বড় একটা সময় কাদায় পরিপূর্ণ থাকে, এতটাই কুখ্যাত আমাদের গ্রামের কাদা যে ইয়া তাগড়া তাগড়া মোষও গাড়ি নিয়ে পার হতে গিয়ে চোখে শর্ষে ফুল, গেন্দা ফুল সব দেখে ফেলে, সেইখানে রিকশা ভ্যান তো কোন ছার!! যদিও এখন শীতকাল, তারপরেও আমাদের গ্রামের রাস্তায় সিনেমা হলের মাইকিং আমাদের মত ছোট পুলাপাইনের কাছে অতি আশ্চর্যের একটা বিষয়ই বটে। তাই সব বিচ্ছুর দল ভ্যানগাড়ির পিছন পিছন দৌড়াতে থাকলাম যতদুর যাওয়া যায়।
বাসায় ফেরার পথে বিষণ্ণ মুখে চিন্তা করতে লাগলাম, ইশ এই সিনেমাটা যদি সিনেমা হলে গিয়ে দেখতে পারতাম! কে জানতো এই স্বপ্ন শীঘ্রই পূরণ হতে চলেছে!
বাসায় আসার পর আমার বোন আর তার বান্ধবীদের বলাবলি করতে শুনলাম আমাদের গ্রাম থেকে ৮-১০ মাইল দূরে যে শহর, সেইখানে নতুন একটা সিনেমা হল হয়েছে, আর সেই সিনেমা হলটা চালু হবে এই পাগল মন সিনেমা দিয়ে। কিন্তু আমি তখন এতই ছোট যে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার কোন সুযোগ নাই, তাও আবার এতো দূরে!! ওই সময় আমাদের সিনেমা বলতে ছিল বিটিভি থেকে প্রচারিত বাংলা সিনেমা, রবি অথবা সম্ভবত সোমবার কোলকাতা ডিডি ৭ এর বাংলা সিনেমা, আর না হয় স্কুলের বড় মাঠে যখন সার্কাস পার্টি আসে, তখন বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা অস্পষ্ট কিছু সিনেমার ডায়লগ।
কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই রেডিওতে নানারকম বাংলা সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনতাম। বাণিজ্যিক কার্যক্রম কথাটা তখন তো আর ঠিক বুজতাম না, খালি মনে হত ‘বানি জিক্কার জক্কম’, আর এইটার ফাঁকে ফাঁকেই সেই ভরাটকণ্ঠের আকর্ষণীয় করে বলা প্রেম যমুনা, অনন্ত প্রেম, নাগ নাগিনির প্রেম এইরকম অসংখ্য ছবির ধারাবিবরণী। “আসিতেছে আসিতেছে গহর বাদশাহ বানেছা পরি...ওদিকে পরির বাবা ভেঙ্গে দিয়েছে পরির ডানা, কিভাবে এখন পরি গহর বাদশাহ’র কাছে আসবে?...গহর বাদশাহ কি পারবে সবকিছু ছেড়েছুড়ে পরির কাছে ফিরে যেতে?...আর এইসব প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষা করুন...’!!......’আমার লাইন হয়ে যায় আঁকা বাঁকা, ভালোনা হাতের ল্যাখা, আসো যদি বাঁশবাগানে, আসো যদি বাঁশবাগানে, আবার হবে দেখা বন্ধু আবার হবে দ্যাখা’, এইসব শুনতে শুনতে সারাক্ষণই কল্পনা করতাম, ইশ কবে যে বড় হব আর সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখবো!!
কিন্তু আমার আব্বা ছিলেন হাইস্কুলের রাগি শিক্ষক, উনার হাতের ডাস্টারের বাড়ি খেয়ে কতজনের মাথা যে আলু হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
তার ছেলে হয়ে সিনেমা দেখার কথা বলবো সেইটা আমি কল্পনাও করতে পারতাম না। তবুও এই পাগল মন দেখার জন্য মার কাছে গিয়ে আবদার করলাম, মা ভাবলেশহীন চোখে বলল আমার আব্বাকে বলতে, আর আমার পাগল মন দেখার ওইখানেই সমাপ্তি!!
কয়েকদিন পর হঠাৎ করেই আমার ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো, আব্বা জানালো আমি বৃত্তি পেয়েছি আর তিনি তো বেজায় খুশি, আমি যদিও এইটা পেয়ে কি লাভ হল কিছুই বুঝলাম না, তবে এই সুযোগে আমি আব্বাকে পাশের শহরের চিনির কল দেখতে যাওয়ার কথা বললাম(অন্য ইচ্ছাটা গোপনই থাকল)!! আব্বা খুশিমনেই মাথা নাড়লেন এবং যথারীতি এই দায়িত্ব পড়ল আমার ছোট চাচার উপরে যে ওই শহরে কলেজে পড়ে। আমি তো বেজায় খুশি চাচাকে পাওয়াই, সাথে সাথে আমার সিনেমা দেখার ইচ্ছার কথাও চাচাকে বলে ফেললাম। কেও দেখে ফেলে আব্বাকে বলে দিলে জানে মেরে ফেলবে বলে প্রথমে ভয় পেলেও চাচা কিভাবে যেন আমার মাকে কনভিন্স করে ফেললো। আহ আমার স্বপ্ন পূরণ হতে আর বেশি দেরি নেই তাহলে।
যাই হোক নির্দিষ্ট দিনে বেশ ভালো একটা সাজগোজ করে চাচার সাথে রওয়ানা দিলাম দর্শনার উদ্দেশ্যে। কোন রকমে চিনির কল দেখেই চাচা দৌড় দিলো সিনেমা হলের দিকে। আমার উত্তেজনা তখন তুঙ্গে। সিনেমা হলের সামনে লোকজনের ম্যালা ভিড়, তবে চাচার বয়েসি সুন্দর সুন্দর কিছু মেয়েই চোখে পড়ল বেশি!! সিনেমা হলে ঢুকেই সুন্দরীদের ভিড় যেখানে একটু বেশি ওইরকম দুইটা সিট দেখে চাচা বসে পড়লেন এবং বেশ আয়েশ করে ভাব মারতে লাগলেন। ছবি শুরু হতেই আমার উত্তেজনা আর দেখে কে, বিশাল এক পর্দাজুড়ে জ্বলজ্বলে রঙ্গিন ছবি, আর আমি ঘাড় উঁচু করে দেখতে থাকলাম সবকিছু।
আসল কাহিনী শুরু হল এরপর। ছবিটা যেহেতু প্রেমের সেইখানে অনেক কান্না আর বিচ্ছেদের দৃশ্য থাকবে এইটাই স্বাভাবিক। আর সেইখানেই আমার যত সমস্যা। পর্দায় নায়ক নায়িকার কষ্ট দেখে আমার কলজে ফেটে কান্না বের হয়ে আসার মত অবস্থা। একটা দৃশ্য আসলো এমন, নায়িকার বাবা নায়িকার পায়ের তলা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় যাতে নায়িকা বাইরে বের হয়ে নায়কের সাথে দেখা করতে না পারে, আর ওইদিকে নায়ক কিছুদিন নায়িকাকে না পেয়ে সামনে যাকে পায় তাকেই কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, ‘তোমরা আমার জান কে দেখেছ? তোমরা আমার জান কে এনে দাও, তোমরা আমার জান কে এনে দাও’...সাথে কান্না আর বিলাপ!! আর তার ওই ‘জান কে দেখেছ, জান কে এনে দাও’ বিলাপ করা দেখে আমি আর সইতে পারলাম না, এতক্ষণ না হয় চোখ দিয়ে দুই এক ফোঁটা পানি পড়ছিল, এইবার ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে বলতে থাকলাম, কেন ওরা জান’কে আটকে রেখেছে, কেন ওকে ছাড়ছে না !!
আমার এই অবস্থা দেখে চাচার প্রেস্টিজ তো পুরাই পাংচার হওয়ার অবস্থা, এম্নেই সুন্দর সুন্দর সব মেয়ে আছে এমন জায়গায় বসেছে, সেই জায়গায় যদি এইরকম ভেউভেউ করে কাঁদি তার কি আর ইজ্জত থাকে!? চাচা আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে এইটা ছবি, একটু পরে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু কে শুনে কার কথা, আমার কান্না আর থামেনা নায়কের বুক চাপড়ানো আর নায়িকার কান্না দেখে। চাচা আর সহ্য করতে পারলেন না, গজগজ করতে করতে আমাকে নিয়ে সোজা বের হয়ে আসলেন সিনেমা হল থেকে। আর বাসায় আসার পর মাকে বলে দিলেন আমাকে নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়ার ওইখানেই সমাপ্তি এই জীবনে!!
অবশ্য এরপর আর চাচার সাথে কোনদিন ছবি দেখতে যাওয়া হয়নি, জেলা শহরের নামকরা একটা স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। আর তখন কেবল সালমান শাহ যুগ শুরু হয়েছে, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা একেবারেই ডালভাত আর কি। তবে হাঁ...কান্না কিন্তু আমার এরপরও থামেনি!!
-নিহাদ-
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।