সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
মালয়েশিয়ায় এসে আমি মালয় মুসলমান, আরব মুসলমান, আফ্রিকান মুসলমান, ভারতীয় মুসলমান, পাকিস্তানী মুসলমান, ইন্দোনেশীয় মুসলমান -- এরকম হরেক জাতের মুসলমানকে কাছে থেকে দেখলাম। বলা দরকার এসব নানান জাতের মুসলমানকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে একটি মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণার সুবাদে। সব জগতের মুসলমানকে পর্যবেক্ষণ করে আমার উপলব্ধি হলো, বাংলাদেশী মুসলমান হলো সবচেয়ে লিবারেল। অন্য অর্থে ধর্মীয় আচার পালনে ও ধর্মীয় চিন্তা লালনে বাংলাদেশীরা হলো সবচেয়ে 'ফাঁকিবাজ'। আরেকভাবেও বলা যায়, পৃথিবীর সব মুসলমান একরকম, আর বাংলাদেশী মুসলমান অন্যরকম।
পাকিস্তানীরা যে বাঙালিদের 'সাচ্চা মুসলমান নয়' বলতো, তা তারা ঠিকই বলতো।
নামাজ-রোজার প্রসঙ্গেই তুলনাটা প্রথমে করা যাক। আরবসহ পৃথিবীর সব মুসলমানই নামাজটা পাঁচ ওয়াক্ত কায়েম করার চেষ্টা করে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদটা মূল গেটের পরপরই এবং তা সবসময় বিদেশী মুসল্লি ছাত্রদের পদচারণায় মুখরিত। রোজার দিনে কোনো মুসলমানের প্রকাশ্যে খাওয়া সরকারীভাবে নিষিদ্ধ, সরকারী মাওলানা বাহিনী ঘুরে ঘুরে তা নিশ্চিত করে।
পুলিশ তো আছেই। আমি যে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকি, সেখানে আরব আর আফ্রিকান মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কোনো গানবাজনার আওয়াজ আশপাশ থেকে শোনা যাবেনা, কেবলই কোরান তেলওয়াতের অডিও বাজে। এখানকার বিদেশী ছাত্ররা এপয়েন্টমেন্ট দেন ও নেন মসজিদে।
মালয়েশিয়ার শতকরা ৪০ ভাগ মানুষই অমুসলিম, কিন্তু মুসলিম পরিমণ্ডলে পরম মুসলিম আবহাওয়া পাওয়া যাবে।
মালয় মেয়েরা পর্দা করে মাথায় স্কার্ফ বেধে, যদিও তাদের অনেকেই সঙ্গে জিন্স-টিশার্ট পরে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মালয়েশিয়া সরকারের 'ইসলাম হাদারি' প্রকল্প রয়েছে। ইসলাম হাদারি হলো ইসলামনির্ভর উন্নয়নপরিকল্পনা। আমাদের দেশে এমনটা ভাবা যাবেনা, তা যতই সংবিধানের মুসলমানি দেয়া হোকনা কেন।
চীনা মেয়েদের স্বল্পপোশাক আপনাকে (যদি আপনি পুরুষ হন) যতই ভিস্যুয়াল প্লেজার দিক না কেন, মুসলমান হয়ে মালয়েশিয়ায় বাস করা মানে আপনাকে ইসলামী পরিমণ্ডলে বাস করতে হবে।
টুরিস্ট হিসেবে যদি আপনি আসেন তবে মডার্ন মালয়েশিয়াকে পাবেন। আর বাস করতে আসলে মুসলিম মালয়েশিয়াকে পাবেন।
গড়পড়তা বাংলাদেশী মুসলমান হিসেবে আমি এই ইসলামী চাপে চ্যাপ্টা হয়ে আছি। আমি জানি আমাদের দেশের অনেক মানুষই ধর্মপ্রাণ। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই নিয়মিত আচার পালন করেনা।
একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়মিত নামাজ পড়ে, কিন্তু তার চাইতে বড়ো অংশ নামাজ পড়েনা। সেই বৃহত্তর অংশের একজন হয়ে এখানে এসে মুশকিলে পড়েছি। এতটা ইসলামী পরিবেশে আমি কখনোই বসবাস করিনি -- পরিবার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মজীবন -- কখনোই না।
সত্যি বলতে কি, আমি এই লিবারেল বাঙালি-মুসলমান পরিচয়ে গর্বিত। পূর্ববঙ্গের ইসলামের ইতিহাস অন্য যেকোনো অঞ্চল থেকে ভিন্ন।
এখানে তুর্কিদের অস্ত্রের কিংবা আরবদের কড়া অনুশাসনের চাইতে ইরানীয় সুফি ধারা বেশি প্রভাব রেখেছে ইসলামপ্রসারে। সুফি-দরবেশদের শান্তির বাণী অবিকৃতও থাকেনি, স্থানীয় বৈষ্ণব ও বৌদ্ধ তান্ত্রিকতার মিশেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ইসলামের জন্ম হয়েছে। আমাদের মুসলমানিত্ব তাই নামাজসর্বস্ব নয়, আমাদের মেয়েরা তাই পর্দায় বন্দী নয়।
তবে রাজনৈতিক অসততার অবসরে ইসলাম বাংলাদেশে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে, দ্রুত মানুষের মনোযোগ পাবার জন্য। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখনও কেবলই মুসলমান নয়, বাঙালিও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।