অন্যুন বৎসরকাল যাবৎ সবিশেষ অভিনিবেশসহকারে ব্লগ নিরীক্ষণ করিয়া যাইতেছিলাম; অদ্যাবধি কিছু কহিবার ফুরসৎ করিয়া উঠিতে পারি নাই। আজিও ফুরসৎ মিলিতো না যদি না গতকল্য কাকু'র সহিত কয়েকদন্ড কথা কহিবার পর বাহবা পাইবার বদলে তিরস্কৃত হইতাম। বস্তুত আমার এই অনিচ্ছাকৃত লেখনীর মূলে রহিয়াছে নিবারণকাকু'র সহিত আমার একটি নিদারুণ মতদ্বৈততা! মতদ্বৈততার পূর্বকথা অতীব সামান্য; আপনাদিগকে না কহিলেও চলিতো; আবার যদিচ কহি, তদ্দ্বারা কোন শুদ্ধ মহাগ্রন্থের শুদ্ধতায় সংশয় না ঘটিবার সম্ভাবনাই বেশী। পরন্তু এই কাইজ্জা-উপাখ্যান কিঞ্চিৎ হইলেও অসময়ে আমার এই অর্বাচীন লেখনীর উদ্দেশ্য আপনাদিগের সম্মুখে স্বচ্ছ করিবেক বলিয়া প্রত্যয় করি। যাহাই হউক; সংক্ষিপ্ত করিয়াই না হয় বলিবো; তবুও এইবেলা বলিয়া লই।
নিত্যদিনের ন্যায় গতকল্য অপরাহ্নেও কাকু বহির্বাটিতে বসিয়া মনোযোগসহকারে আফিং সেবন করিতেছিলেন আর আমি আমার ঘরে বসিয়া সামহোয়্যারইনের পাশাপাশি অন্তর্জালের বিবিধ গলিঘুপচিতে ঘুরিয়া মরিতেছিলাম। সামহোয়্যারইনের সাম্প্রতিককালীন অব্যবস্থাপনা তাহার তৃতীয় সংস্করনের জৌলুসকে ছাড়াইয়া গিয়াছে পূর্বেই; গত কয়েকদিন ধরিয়া মনে হইতেছিলো এবার বুঝি দেবী লক্ষ্মীও সামহোয়্যারকে ছাড়িয়া নতুন বাটী খুঁজিতে বাহির হইবেন। এমন অসামান্য চিন্তা সহসা ব্যাঘাতগ্রস্ত হইলো কাকু'র ডাকে; ডাক পাঠাইয়াছেন চাকরকে দিয়া। ডাক পাইয়া যারপরনাই স্বস্তি পাইলাম ইহা ভাবিয়া যে, যাহোক বিশ্রান্ত চক্ষুযুগল অন্তত কিয়ৎকাল বিশ্রাম পাইবেক। ব্লগরাজ্যে সুয়ো-দুয়ো'র ঝগড়া দেখিয়া দেখিয়া চক্ষুতে যে অদ্যপি পঁচন ধরে নাই ইহা অন্তত আক্ষরিক অর্থে মানিলেও মানিতে বাধ্য; কিন্তু বর্তমান হারে উহা দেখিতে থাকিলে ভবিষ্যতে কোনদিন কোন শুভক্ষনে এই পঁচনশীল চক্ষুযুগল যে পঁচিয়া যাইবেনা, উহা প্রত্যয় করিয়া কহিতে পারি না।
তথাপি অন্তর্জালে আমার মোট ব্যবহৃত সময়ের সিংহভাগই ব্যয় হয় এই সাইটটিকে দেখিতে দেখিতেই। কাকু আমার এই সামহোয়্যারপ্রীতির কথা বিলক্ষণ জানিতেন। বস্তুত কেবল নিবারণ কাকু-ই নহেন; অন্য কাহাকেও ইদানিংকালে কিছু কহিতে চাহিলে সর্বাগ্রে সামহোয়্যারইনবিষয়ক কহতব্যই চলিয়া আসে। সামহোয়্যারইনকে বাদ দিলে আমার ভান্ডারে কহিবার মতোন তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকেনা; যদিচ বেচারা সামহোয়্যারইনের অবস্থা এখন বলিতে গেলে 'ঢাল নাই তলোয়ার নাই' টাইপের হইয়া গিয়াছে; দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তথাকথিত ধারক ও বাহকেরা ফ্লাডিং করিবার অপরাধে সামহোয়্যারে এখন অচ্ছুৎ ঘোষিত হইয়াছেন! যদিও অচ্ছুৎদিগের মধ্যেকার অনেকেই স্বনামধন্য লেখক, কেহবা খ্যাতিমান গালিবাজরূপে এবং গালি'র ক্ষেত্রে কাহারো কাহারো স্পেশালাইজেশন রহিয়াছে সহবাসবিষয়ক গালিতে যাহা মতান্তরে কুরুচিকর বলিয়া দুষ্টব্লগারগণ বলিয়া বেড়ায়; তথাপি যে যত যাহাই বলুক না কেন, ইহারা না থাকিলে দৃশ্যত সামহোয়্যার দাঁড়াইয়া থাকিলেও আশানুরূপ হিট পাইবে কিনা ইহাতে আমার ঘোরতর সন্দেহ হইতেছিলো! অশ্লীল গালিগালাজ নেই তো "হিট"ও নেই; ইহাই ছিলো আমার সুচিন্তিত ধারনা। হিট না থাকিলে সৃজনশীল সাহিত্য কিংবা ভিন্নমতবিষয়ক যৌক্তিক আলোচনা কাহার কি কাজে আসিতে পারে আমি বুঝিতে চেষ্টা করিতেছিলাম কিন্তু ঘাম ব্যতিরেকে মস্তিষ্ক হইতে কিছুই উৎসারিত হইতেছিলো না।
তো সামহোয়্যার লইয়া ইত্যাকার সাত-পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে কাকু'র সমীপে উপস্থিত হইলাম। বহির্বাটীতে পৌঁছিয়া দেখি ইতোমধ্যেই আফিংয়ের প্রভাবে কাকু'র চক্ষু ঈষৎ ঢুলুঢুলু হইয়া অর্ধমুদিত হইয়া আসিয়াছে। অভিজ্ঞতা হইতে জানি, কাকু'কে কোনরূপ প্রশ্ন করিতে হইলে কিংবা কাকু'র সহিত হালকা মেজাজে কোন বিষয়ে আলোচনা করিতে চাহিলে এইরূপ অবস্থায় কাকু'কে পাকড়াও করা আদর্শ। এইরূপ অবস্থায় তাহার মেজাজ শীতল থাকে, যেই শীতলতা কিনা অপরাপরসময়ে আবার অশ্বডিম্বকের ন্যায় দূর্লভ! কতক ভাবিয়া কাকু কিছু কহিবার পূর্বেই ঈষৎ সংক্ষিপ্তাকারে সামহোয়্যারবিষয়ক আমার বর্তমান ভাবনা কাকু'কে ব্যক্ত করিয়াই ফেলিলাম।
আমার সুচিন্তিত মতামত শুনিয়াই কেন কে জানে, কাকু অতিশয় বিষন্ন হইলেন।
বিষাদমাখা স্বরে কহিলেন; জানিস তো যে যুবাকালে আমি নিয়মিত ডাম্বেল মুগুর ভাজিতাম; কাঁচা ছোলাসহযোগে প্রাতঃরাশ করিতাম? আমার সমুখে দেশের বিরুদ্ধে কথা কহিলে এই নিবারণ কোনদিনই কারুকেই ছাড়িয়া কথা কয় নাই। দেশবিরোধী কথাবার্তার প্রেক্ষিতে কারুকে গালি দেওয়া আর সাধারন অর্থে কারুকে গালি দেয়া কি এক হলো? আম আর আমড়া কি কদাপি এক? এটা তোকে সর্বাগ্রে বুঝিতে হইবে। আর তুই বুঝি কারুকে গালি দিসনা? কাকু'র বিষন্ন বদনের সহিত ব্যায়ামাগারের ডাম্বেল-মুগুর, প্রাতঃরাশের কাঁচা ছোলা এবং সর্বোপরি আমার গালি দেওয়া না দেওয়ার জটিল আন্তঃসম্পর্কের স্বরূপ উদঘাটনের নিমিত্তে মস্তিষ্কাভ্যান্তরে সিডর তান্ডব চালাইতে লাগিলাম; কিন্তু বরাবরের মতোই ইহাতে কেবল রক্তসঞ্চালনবৃদ্ধিজনিতকারনে খুলি'র চারিপার্শ্বস্থ অঞ্চলের উত্তাপই বাড়িয়া চলিলো; সমাধান মিলিলো না। সমাধান অপরিসমাপ্ত রাখিয়াই অস্ফুটে কাকু'কে কহিলাম; কেন কাকু, গালি দেওয়া কি ভালো? বাবা যে বলে গালি দেওয়া কাপুরুষের লক্ষ্মন; গালি দিলে কেবল নিজের দূর্বলতাই প্রকাশ পায়, তবে? ভ্রাতুষ্পুত্রের জিজ্ঞাস্য শুনিয়া কাকু এইবার একঝলক মৃদুহাস্য বর্ষণ করিলেন। হাস্যসহযোগে তৎপরবর্তী অর্ধঘটিকা যাবৎ যাহা কহিলেন তাহার সারকথা হইলো এই যে, ঈশ্বর এই ধরাধামে যাহা কিছুই সৃজন করিয়াছেন তাহার কোনটাই উপযোগিতার দিক দিয়া কোনটার চাইতে কম নহে।
অবস্থাবিশেষে সকলই বিশেষ ফলপ্রদায়ী হয় কিংবা অন্তত হইতে পারে; সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, সৎ-অসৎ, সুবচন-কুবচন কোনটাকেই অপ্রয়োজনীয় বলিবার কিংবা ভাবিবার জো নাই। ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের সঠিক মাত্রার মিশ্রনেই কেবল আসিতে পারে ফলদায়ী কোন সমাধান। যেমন ধরা যাউক কাহাকেও তুমি ভুল ভাঙাইয়া সত্যপথে আনিতে চাহো, তাহাকে সময়বিশেষে হয়তো তিরস্কার করিতে হইতে পারে; সময়বিশেষে হয়তোবা দিতে হইবে যুক্তি। অবিমিশ্র যুক্তিবাদ কিংবা অবিমিশ্র বকুনি দুইটাই দেশদ্রোহীদিগের দাওয়াই হিসেবে অচল বলিয়া সর্বসূত্রে প্রমাণিত। সুতরাং গালি দেওয়া সর্বকালে সর্বদাই খারাপ হইবে; চক্ষু বুজিয়া এই কথা বলিয়া দেওয়াটা বিশেষ এক ধরনের অজ্ঞতা হইতে উৎসারিত যদিও এই অজ্ঞতা নিরাময়যোগ্য।
প্রয়োজনে অপরাপরলোকদিগের কাছে ছোট হইয়া, আমনয়নে ইতর হইয়া হইলেও "ভিন্নমতাবলম্বীদিগকে সুপথে আনয়ন করিয়াই ছাড়িবো"; স্বীয় অন্তঃকরণ দ্বারা ইহা পরিপূর্ণরূপে বিশ্বাস করিয়া যাহারা ময়দানে লড়াই চালাইয়া যাইবে, বিজয় তাহাদের সুনিশ্চিত। দেশপ্রেমের বিজলীপিদিম যাহাদিগের অন্তরে একবার প্রোজ্জ্বলিত হইয়াছে তাহারা ভক্তবৃন্দের প্রশস্তিগীতি চাহিবে না; কর্মপন্থা লইয়া ভাবিবার দায়বদ্ধতাও উহাদিগের নাহি; উহাদিগের নীতি হইবে "মারি অরি পারি যে কৌশলে"; উহারা দায়বদ্ধ থাকিবে কেবল নিজের বিবেকের কাছে; টেবিলটকের ফাঁদে পা দিয়া অমূল্য সময় এবং সামর্থ্যের অনর্থক অপচয় উহারা করিবে না; সর্বোপরি উহাদিগকে হইতে হইবে সাহসী।
(ক্রমশঃ...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।