ঘাটের এই পারে বসে আছি ঐ পারে যাওয়ার অপেক্ষা।
পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার লিখার জন্য যখন কোনো লিখাই জমা পড়েনা, ঠিক তখনিই পত্রিকার সম্পাদক বন্ধু আমাকে স্মরণ করেন। বিশ্ব জুতা দিবসের ওপর একটি গল্প লিখে দিতে হবে । আজকের এই অন্ধবলয় জগতে আমিই উনার শেষ দীপশিখা। উনি প্রশংসা দিয়ে আমার লিখার প্রদীপে জ্বালানি দিয়ে যান।
এখন শুধু আলোকিত করার দায়িত্ব আমার।
এরকম দিবসের কথাতো আমি কস্মিনকালেও শুনিনাই। "বিশ্ব জুতা দিবস" এটা আবার কি? আমিতো বড়জোড় কুমোরপোকা-বাঁশের ছ্যাঁদার ঘুন করতে জানি। তাই নেটেই উঁকি দিয়ে..নেটঘুন করে যা পেলাম-তা হলো- ২০০৮ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর মার্কিনমুল্লুকের প্রেসিডেন্ট বুশ সাহেব সর্বশেষ ইরাক সফর কালীন সময়ে ইরাকের বিশিষ্ট সাংবাদিক মনতাদার আল জায়িদি প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করেন। সেই দিনটির স্মরণেই প্রচলিত হয়ে আসছে বিশ্ব জুতা দিবস।
মনে মনে বললাম, বাহঃ।
কিন্তু সমস্যা হলো - সম্পাদক বলেছেন গল্প লিখতে। কিন্তু জুতা নিয়ে গল্প লিখার কোনো মসলা, কোনো আইডিয়াইতো আমার নাই।
যদি বলতেন , কিছু একটা লিখে দিতে । তা হলে ল্যাটা চুকে যেতো।
জুতা বিষয়ক বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন তথ্য নেটে ঘাটাঘুটি করে কিছু একটা দাঁড় করিয়ে দিতাম।
কবিগুরু রবিঠাকুরের কথা মনে পড়ে গেলো। উনার কাছে জনৈক লেখক একবার একটা গল্প লিখে নিয়ে গেলেন। রবিঠাকুর সব পড়লেন- তারপর বললেন। লিখায় সাহিত্য, ভাষা শৈলী,শব্দ চয়ন, উপমার মুন্সিয়ানা ,চিন্তার উৎকর্ষতা, ভাবের গভীরতা সব ঠিক আছে।
কিন্ত, সবচেয়ে আসল যে জিনিস গল্পের মাঝে যদি গল্পই না থাকে তবে এটাকে আমি সুন্দর বর্ণনা হিসাবেই ধরে নিবো। গল্প বলতে পারবোনা। বর্ণনাকে গল্প বললে, ঝরণার জল আর কলের জল এক হয়ে গেলো। দুটোইতো উপর থেকে নীচে গড়িয়ে যায়।
আমি বুঝলাম, একজন লেখকের জন্য কোনো কিছুর বর্ণনা করা যত সহজ।
গল্পের ভিতর গল্প তৈরি করা হলো তত কঠিন। পড়লাম ফ্যাসাদে।
আমি জুতো নিয়ে গল্প লিখতে বসেছি। কলম দিয়ে সাদা কাগজে হিজিবিজি লিখছি। কিন্তু গল্পের কোনো আইডিয়া বের করতে পারছিনা।
আচ্ছা , যদি এরকম হয়। বাপের জুতা কিনার খুব শখ ছিলো। কিন্তু টাকার অভাবে কিনতে পারলেন না। ছেলে যখন বড় হলো। তখন টাকা পয়সা বেশ হলো।
কিন্তু বাপের আর জুতো পড়ার শখ রইলো না।
নাহ। আইডিয়াটা ভালো হলোনা। একেবারে গতানুগতিক। রবীঠাকুরের হাতে দিলে উনাকেই অপমান করা হতো।
এটা কোনো গল্পই হলোনা।
প্রিয় পাঠক। অনুগ্রহকরে আইডিয়া দিয়ে সাহায্য করুন। কালকেই লিখাটা জমা দিতে হবে। কোনো কিছুই আমার মাথায় আসছে না।
আচ্ছা, দেখুনতো। এই আইডিয়াটা কেমন? মনে করুন। বাবা সব সময় মনে করেন। এ মাসের বেতন থেকেই ছেলের জন্য একজোড়া নতুন লাল জুতো কিনে দিবেন। কিন্ত মাসের শেষে নানারকমের বিল মিটাতে মিটাতে আর কিনে দিতে পারেননা।
ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখেন। কিন্ত এবার শ্রষ্টা সহায় হলে কিছু উপরি মেলে। তাই বাজার থেকে ছেলের জন্য লাল জুতো কিনে এনে বাড়ি এসে শুনেন, স্কুল থেকে ফিরার পথে ছেলে গাড়ি চাপা পড়েছে। এখন হসপিটালে, একটা পা কেটে ফেলতে হবে ..
না হলোনা। এরকম আইডিয়া নিয়ে অনেক গল্প, নাটক , সিনেমা অলরেডি হয়ে গেছে।
এখানে রঙ লাগালেও পাঠক চালাকি ধরে ফেলবে । আজকালকার পাঠকরা অনেক স্মার্ট। এতটুকু ছাড় দিতে রাজী না।
প্রিয় পাঠক। দেখলেন, একটা আইডিয়া পাওয়া কত কঠিন।
আমি কলম মুখে নিয়েই বসে আছি। ঠিক এমন সময় একটা কাকতালীয় ঘটনা গঠলো।
বাড়ির বাইরে শুনলাম- জুতোর ফেরিওয়ালা চিৎকার করে বলছে- এই জুতো নিবেন, জুতো,জুতো, জুতো। নানা রকমের জুতো। একেবারে অরিজিনাল চামড়ার জুতো।
আমি জানালা দিয়ে জুতোওয়ালাকে দেখার আগে গল্পের প্লট তৈরী করে ফেলি। গরীব জুতোওয়ালা সারা দিন কষ্ট করে করে জুতো ফেরি করে। উত্তপ্ত গরমে পীচঢালা সড়কের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়। কিন্তু বেচারার নিজেরই একজুড়ো ভালো জুতো নেই। এরকম গল্পটা কি ভালো হবে? একটু দুঃখ দুঃখ ভাব।
মনে মনে গল্পটি বুনে আমি জানালার দিকে তাকালাম। কিন্তু না। আমার চিন্তার সাথে কোনো মিল নেই। মধ্য বয়সী একলোক ছাতা মাথায় নিয়ে আগে আগে হাঁটছে। আর পিছনে পিছনে জুতোর ঢালা মাথায় নিয়ে একটা কিশোর ছেলে জুতো জুতো বলে হেঁকে যাচ্ছে।
চার পায়ের দিকে এবার খেয়াল করলাম। মনে মনে প্রার্থণা করলাম- একটা পা যেন কারো খুঁড়া হয়।
পৃথিবীতেতো কত আঁতুড়, লুলা, ল্যাড়া , পঙগু ,বিকলাঙগ, পা কাটা পড়া, ,যুদ্ধে পা হারানো কত মানুষ আছে। কত মানুষ আছে হসপিটালে শুয়ে । কত মানুষ আছে গৃহি বন্দি হয়ে।
কত মানুষের জীবনের সূর্যস্রোত হুইল চেয়ারে বসেই মলিন হয়ে গেলো। এদের একজনের একটা পা লুলা হলে ক্ষতি কি। তাহলেইতো আমার জুতো নিয়ে লিখার গল্পটা পেয়ে যাই।
কিন্ত না। চারপায় ই সচল।
চার পায়েই বেশ ভালো জুতো। কী সুন্দর করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, দু জন মানুষ। চলার কি অপূর্ব ছন্দ। আমি আশাহত হলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে।
আমি এখনো একটা লাইনও লিখতে পারলাম না।
জুতোওয়ালা চলে গেছে, পা হেঁটে তার আপন ছন্দে। রৌদ্র বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসছে। জানালা দিয়ে বিকেলের মাঠ দেখি। সারাদিন বন্দি ঘর আর ভালো লাগেনা।
এই সব আকাশ নক্ষত্র, রোদ ,সত্য , উজ্জ্বলতা মনের ভিতর যেন কেমন হাহাকার করে ওঠে। নিজের শরীরটা নিজের কাছে খুব ভারি মনে হয়। এই ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলাকে মনে হয় নিজের চেয়েও প্রবীণ।
মাঠের ছায়া, হৃদয় আর হৃদয়ের ভিতরের রুধিরের ধারায় নিজেকে বড় বেশী অসহায় লাগে। বাইরের মাঠ ডাকে আয় আয়।
কিন্তু জাহানারা না আসা পর্যন্ত বাইরে যাওয়ার সাধ্যযে আমার নাই।
আমার কিশোর ছেলেটির মতো তপ্তরোদে জুতোর ডালা মাথায় নিয়ে জুতো নিবেন, জুতো, অরিজিনাল চামড়ার জুতো বলে হেঁটে যেতে বড় বেশী ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমিযে এক অসহায় পঙগু মুক্তিযোদ্ধা। হুইলচেয়ারই আমার ঘর। আমারযে আর কোনোদিন জুতো পায়ে হাঁটা হবেনা।
আমি জাহানারার অপেক্ষায় থাকি, অপেক্ষায় থাকি। আমার অপেক্ষার সূর্য লাল হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।