আলোয় ভুবন ভরা
যায়যায়দিন-এ লেখাটি ছাপা হয়েছে
শরীরের ঘাম, কাচা মরিচের ঝাল এবং একটি চার্ট
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
একটি সমাজকে বুঝতে হলে দুটি জায়গায় যাওয়া প্রয়োজন। একটি বইয়ের দোকান, অন্যটি কাচাবাজার। বইয়ের দোকানে গেলে সে এলাকার মানুষের জ্ঞান ও মননের স্তর আর কাচাবাজারে গেলে জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
প্রয়াত জাতীয় প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের কথার সূত্র ধরে যে কেউ এখন কাচাবাজারে গেলে বুঝতে পারবেন, বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা কেমন চলছে। প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলায় কেউই বুঝতে পারছেন না দাম বাড়ার গাড়িটি কোথায় গিয়ে থামবে।
বর্তমান সময়ে সাধারণ মানুষের সামনে এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বিরামহীন সন্ত্রাস, বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে বল্গাহীন দুর্নীতির পর বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টিতে এসে জিনিসপত্রের বিরতিহীন দাম বাড়া নিয়ে মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়েছে। এ দাম বাড়ার বিষয়টি মানুষের প্রতিদিন, এমনকি প্রতিবেলার জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। কেননা এতে করে উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত সবাই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সূত্র থেকে জানা যায়, মানুষের মোট আয়ের ৫৪ ভাগই খরচ হয় খাবার কিনতে।
গ্রামে এর পরিমাণ ৫৮ ভাগ। যেখানে খাবার কিনতেই অর্ধেকের বেশি আয় চলে যায় সেখানে যদি সেই খাবারের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে তবে তা কিছুতেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না।
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর শুরুতেই যে উদ্যোগ নিয়েছিল তার একটি ছিল মজুদদারদের বিরুদ্ধে। অসংখ্য গোডাউনে তালা ঝুলেছিল তখন। খাবারের সিন্ডিকেট ভাঙতে চেষ্টা করে এক পর্যায়ে সরকার হাল ছেড়ে দেয়।
গোডাউনের তালা খুললেও দামের ঘোড়ায় লাগাম পরানো যায়নি। যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ, বিডিআরকে দিয়ে সহনীয় দামে জিনিসপত্র বিক্রি, মার্কেট টহল প্রভৃতি উদ্যোগ নিলেও দ্রব্যমূল্য লুকিয়ে বা চুপিচুপি নয়, সবার সামনেই বেড়ে চলেছে।
বাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের বর্তমান পরিস্থিতি ছয় মাসেও পরিবর্তন হবে না।
তবে তার চেয়েও বেশি অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো উপায় সরকারের হাতে নেই।
কেউ কেউ মনে করেন, তারা সত্য স্বীকার করে নিয়েছেন। এর আগে আওয়ামী লীগ আমলে পেয়াজের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পেয়াজ খাবেন না। পেয়াজ না খেলে কি হয়?
বর্তমান সরকারের কেউ এ ধরনের কথা এখনো বলেননি। তবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল অভিযোগ করে বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য ব্যবসায়ীরাই দায়ী। তারাই নানাভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ায়।
এতো কিছুর পরও মূল সত্য হলো, রাজনীতিবিদদের কুবচন কিংবা বর্তমান সরকারের সুবচন কোনোটাই সাধারণ মানুষের পকেটকে শান্ত রাখতে পারেনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের এক রিপোর্টে জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতির চাপে গত দুই বছরে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রকৃত আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৮ ভাগ। সরকারি বেতনের বর্তমান সর্বোচ্চ স্কেল ২৩ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন স্কেল দুই হাজার চারশ টাকা।
সরকারি সুবিধাভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কর্মরত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, পেনশনভুক্ত ব্যক্তি, এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক ও কর্মচারী, সরকারি অনুদান পাওয়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকসহ এ সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ১৭ লাখ ৮০ হাজারে।
এই মানুষদের অফিশিয়াল হিসাব আছে।
এবং এ কারণে তাদের আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জরিপ চালানো যায়। কিন্তু ১৫ কোটি মানুষের দেশে এ সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। এখনো আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ থাকেন গ্রামে। নিম্নআয়ের মানুষের পক্ষে প্রতিদিন খাবারের চাল কেনাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। কেননা তাদের আয়ের বড় অংশই চলে যায় চাল কিনতে।
ফলে এদের প্রকৃত আয় কমতে কমতে কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তার হিসাব বের করা জটিল ও কঠিন কাজ। বিডিআর প্রধান হয়তো এ কারণেই বলেছেন, আমাদের হাতে কোনো সঠিক তথ্য নেই, বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা আসলে কতো।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নির্ভর করে তার সাপ্লাই ও ডিমান্ডের ওপর। দেশে ডিমান্ডের তুলনায় সাপ্লাই কম। বাজারে দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে খাদ্য আমদানি করে আনা হয়।
যেমনÑ বর্তমানে মসুর ডালের চাহিদা প্রায় সোয়া তিন লাখ মেট্রিক টন। দেশের ভেতর থেকে আসে সোয়া লাখ মেট্রিক টন। বৈধভাবে আমদানি হয় এক লাখ মেট্রিক টন। বাকিটা চোরাকারবারিদের মাধ্যমে দেশে আসে।
দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে ১২ লাখ মেট্রিক টন।
দেশে উৎপাদিত হয় মাত্র এক লাখ মেট্রিক টন। বাকি পুরোটাই আসে দেশের বাইরে থেকে।
সব পণ্যই আমদানি করতে হয় তা নয়। যেমন আলু। দেশে আলুর চাহিদা ৪৪ লাখ মেট্রিক টন।
এবার আলু উৎপাদিত হয়েছে ৫০ লাখ মেট্রিক টন। হিসাব অনুসারে উদ্বৃত্ত থাকার কথা ছয় লাখ মেট্রিক টন।
এসব হচ্ছে সরল হিসাব। কিন্তু পুরো বিষয়টি খুবই গরল ধরনের। উৎপাদন বেশি থাকায় আলুর দাম বাড়ার কথা নয়।
কিন্তু তা বাড়ছে। কারণ এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী আলু স্টোর করে রেখে দিচ্ছে বা নষ্ট করছে। তারা আলু আমদানি করতে চায়। এছাড়া সুকৌশলে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ানোর খেলায় আলুকেও ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। একই খেলায় গত ১০ বছরে গমের দেশীয় উৎপাদনের পরিমাণ নেমে এসেছে অর্ধেকে।
দেশের ভেতর থেকে আলুসহ অন্যান্য উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের সময় অবিশ্বাস্য দাম বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদক থেকে বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে এসে ক্রেতা পর্যন্ত দাম বেড়ে যায় শতকরা ৪০ থেকে ৩০০ ভাগ পর্যন্ত। কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব) তাদের বক্তব্যে জানিয়েছে, মধ্যস্বত্বভোগী, ফরিয়া, আড়তদার ও বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে ক্যারিং কস্ট বা পরিবহন ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। এ যুক্তিতে দাম বাড়িয়ে দিতেও বিক্রেতারা দেরি করেনি।
আমদানির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারের দুর্নীতি বিরোধী কঠোর অবস্থানের জন্য অনেক ব্যবসায়ী এলসি খুলতে ভয় পান। ফলে বৈধ পথে আমদানি যাচ্ছে কমে। ইনডিয়া ডালের মতো পণ্য রফতানি বন্ধ করায় বৈধ ও অবৈধ পথে ডাল আসা কমে গেছে। ফলে খাদ্য সঙ্কট তীব্র হচ্ছে।
ইনডিয়ার বাজার এবং বাংলাদেশের বাজারে পণ্যমূল্য কাছাকাছি হলেও ইনডিয়ান মানুষের মাসিক গড় আয় বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে দেড় গুণেরও বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজারেও দ্রব্যমূল্য নিয়ে খুবই অস্থির সময় যাচ্ছে। এ কারণে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের দেশগুলো আগে থেকেই প্রস্তুতি নিলেও বাংলাদেশের প্রস্তুতি ছিল শূন্য। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের উচ্চহার প্রভাবিত করছে বাংলাদেশের বাজারকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও জানিয়েছে, আগামী ১০ বছরে খাদ্য ও পণ্যের দাম বাড়তে পারে ৫০ ভাগ পর্যন্ত। বিশ্বে এখন ১৯৭০ সালের পর সর্বোচ্চ খাদ্য ঘাটতি রয়েছে।
আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ারও গত ২৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম খাদ্য মজুদ করতে পেরেছে।
এসব বিষয় ও হিসাব সাধারণ মানুষ বুঝতে চান না। কারণ তাদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জীবন চালাতে হয়। এ অবস্থায় ব্যর্থতার দায় সরকারের ওপর গিয়েই পড়ে। বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে, এখন শহর থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি।
একই সঙ্গে কাজ হারানো এবং নতুন কর্মসংস্থান না থাকায় সেখানে দুঃসহ অবস্থা চলছে। সিডর পরবর্তী সময়ে খাদ্য ঘাটতি আরো বেড়ে গিয়েছে। দেশে দুর্ভিক্ষ হয় কিনা সেই আশংকাও করছেন অনেকে।
আগে বলা হতো, নিম্নআয়ের মানুষ ভাতে কাচা মরিচ ডলে খায়। কিন্তু কাচা মরিচের দাম যখন ৩২০ টাকা কেজি হয় তখন অনেকের সারা মাসের আয়ও তার সমান হয় না।
নিজেকে ডলে যে শ্রম লোকটি দেয় তার পক্ষে এখন আর কাচা মরিচ কেনাও সম্ভব হয় না।
শরীরের ঘামের চেয়ে কাচা মরিচের ঝাল অনেক বেশি দামি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।