হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই
আমরা ফিরছি নিজ দেশে, মাতভূমিতে। সবার মনেই আনন্দ। বেড়াতে গিয়ে যতোই আনন্দ করি না কেনো, মাতৃভূমিতে ফেরার আনন্দের তুলনায় তা কিছুই নয়। মামুন ভাই তো উচ্ছ্বাসে বলেই বসলেন, আমার ঢাকা শহরে যাচ্ছি। হোটেলের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি।
যাদের সাথে টুকটাক পরিচয় হয়েছিলো, তাদের সঙ্গে বিদায়ের পালা শেষ করে রেখেছি আগের রাতেই। হোটেল থেকে আগরতলা সীমান্ত মাত্র ১০ রুপি রিকশাভাড়া। মাত্র এটুকু দূরত্বের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন প্রদীপদা। সকাল থেকেই তিনি ফোন করছেন বারবার। আচ্ছা, প্রদীপদা যদি বাংলাদেশে আসবেন, ঢাকার এই ব্যস্ত জীবনে তাঁর জন্য সময় বরাদ্দ রাখতে পারবো কতটুকু? উত্তর পেলাম নিজের মনেই, আন্তরিকতা থাকুক বা না থাকুক, তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন সেটুকুর জন্য কর্তব্যবোধে হলেও তাঁকে সময় দিতে হবে।
কর্তব্যবোধের সঙ্গে আন্তরিকতা মিশলে চমৎকার, না মিশলেও কর্তব্যবোধ যেন বজায় থাকে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত। আন্তরিকতা আছে কিন্তু কর্তব্যবোধ নেই, সেটি খুব একটা কাজের কথা নয়।
ভারতের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস লাগোয়া। সেখানে এক ভদ্রলোক পুরো বাংলাদেশের গোষ্ঠী উদ্ধার করছিলেন। কাকে যেনো মেরুদণ্ডহীনও বললেন।
আমি একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম, কিছুই তো জানি না। না জেনে বলাটা কি ঠিক হবে?
একটু পর বাংলাদেশের সীমান্ত যখন পার হলাম পকেট থেকে বেরিয়ে গেলো ৫০টি টাকা। খুবই সামান্য টাকা। কিন্তু তার জন্য আমরা নিজেরাই মনে হচ্ছে লজ্জিত।
বোধহয় কিছুটা হলেও ধরতে পেরেছি ওই ভদ্রলোকের উষ্মার কারণ। ব্যাপার আর কিছুই না- খাতায় নাম-ঠিকানা উঠানোর পর একজন কর্মকর্তা যেভাবে যে ভঙ্গিতে আমাদের কাছে ৫০টি টাকা চেয়ে নিলেন, বোধকরি ভারতের ওই ভদ্রলোকের কাছ থেকেও নিয়েছেন। ভদ্রলোকের টাকা চাওয়ার ধরন দেখে লজ্জ্বা লাগছে আমাদেরই, কী আর বলব! আমাদের অভ্যাস কি পাল্টাবে না?
নিরাপদেই ফিরলাম ঢাকা। কিন্তু কী রেখে আসলাম পিছনে?
ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের মধ্যকার কোনো তুলনা করা যায় না, উচিতও না। প্রথমটি প্রদেশ, দ্বিতীয়টি স্বাধীন দেশ।
কিন্তু এই দুই অঞ্চলের মানুষ একই সুরে গাঁথা ছিল একসময়। ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির অবশ্যম্ভাবী নীতির পরিণতি- দুটি আলাদা অঞ্চল। কিন্তু আর কোনোভাবেই কি আলাদা করা যাবে দুই অঞ্চলের মানুষদের?
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে শুরু করে আমরা যেখানেই গিয়েছি, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-চাঁদপুর-ফেনী ইত্যাদি এলাকার মানুষের ভাষা শুনেছি। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের বলা শুদ্ধ ভাষা তারা বুঝতে পারেননি। ঠিক তেমনি খাবার-দাবার-পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছুতেই তারা কোথায় আমাদের চেয়ে আলাদা? আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
আমরা যেখানেই গিয়েছি, একটু বেশি বয়স্ক বা প্রৌঢ় মানুষেরা ডেকে ডেকে কথা বলেছেন আমাদের সাথে। জানতে চেয়েছেন, অমুক জায়গাটি এখন কেমন, অমুককে চেনো কি-না। তারা সবাই যে বাংলাদেশের! নাড়ির টান অনুভব করেন এখনো তারা। তাই বাংলাদেশ থেকে কেউ গেলে তারা যেনো আকুল হয়ে যান। প্রায় প্রতিটি মানুষই যেনো আমাদের আপন করে নিয়েছে।
তাদের মধ্যে অনেক হাহাকার। অনেকেই বাপ-দাদার ভিটা দেখেনি। অনেকেই ভিটা খালি রেখে চলে এসেছেন। কারো বোনের বাড়ি অমুক জায়গায়, তার সাথে দেখা নেই অনেকগুলো বছর। এই বিচ্ছেদের হাহাকার তাদেরকে পুড়িয়ে মারে।
একজন তো বললেনই, দাদা, আপনি জানেন আপনার বড় বোন থাকে তিরিশ মাইল দূরে, কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলার কারণে গত পাঁচটি বছরেআপনি তাকে দেখতে যেতে পারেননি, তাহলে কেমন লাগবে আপনার? তাঁর এই খারাপ লাগা আমাকে তীব্রভাবে হয়তো আহত করবে না, কারণ অনুভূতি যার যার, কিন্তু আমাকে উপলব্ধি করতে শেখায় দূরত্বের বিচ্ছেদ যে মানুষকে কতোটুকু যন্ত্রণা দেয়।
আচ্ছা, একটা কাজ কি করা যায় না? ত্রিপুরার যেমন অনেক বড় বড় পাহাড় আছে। আমাদের তো তেমনি আছে সমুদ্র, যা ত্রিপুরার নেই। দু’দেশের সাংস্কৃতিক বন্ধন বাড়ানোর একটি উদ্যোগ দেখেছিলাম কিছুদিন আগে। সেটির পাশাপাশি পর্যটনকে বিশেষ গুরুত্ব দিলে এবং এ সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে তারা যেমন আমাদের সমুদ্র দেখতে আসতে পারতো, আমরাও তেমনি খুব সহজেই তাদের পাহাড়গুলো দেখতে যেতে পারতাম।
এ প্রক্রিয়ায় হয়তো আমরাই লাভবান হতাম বেশি। যতো লোক পাহাড় দেখতে যেতো, তার চাইতে বহুগুণে মানুষ আসতে সমুদ্র দেখতে। কলকাতা ত্রিপুরার চাইতে অনেক দূর। তার চেয়ে ঢাকা তাদের অনেক আপন। সত্যি বলতে কি, ত্রিপুরার অনেক মানুষের মুখ থেকেই শুনেছি এই কথা।
কলকাতা এবং ত্রিপুরা- উভয় দেশের মানুষ কথা বলে বাংলায়। কিন্তু তারপরও তাদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের সাথেই বোধহয় বেশি। এই বোধটিকে কি আমরা কাজে লাগাতে পারি না?
সবার মধ্যে হাহাকার, প্রিয়জনদের দেখার, প্রিয়জনদের সাথে মিলনের হাহাকার। ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের আত্মিক যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে এখন অনেকটাই, কিন্তু বিচ্ছেদে যে মিলনের বোধ, সেটা বোধহয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।