আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ত্রিপুরা ভ্রমণ: বিচ্ছিন্নতায় মিলনের বোধ - ৯

হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই

আমরা ফিরে এসেছি আগরতলায়। পূজা শুরু হয়ে গেছে। অসম্ভব ভিড়। আপাতত পরিকল্পনা হলো আজকের রাতটি পূজা দেখে কাটাবো। সেই আসার দিন থেকেই প্রদীপদা বলছিলেন একদিন তিনি আমাদের নিয়ে ঘুরতে চান।

প্রদীপদার কথা আপনাদের আগেই জানিয়েছি। বয়স আমার চাইতে আড়াইগুণের বেশি। কিন্তু যেভাবে আমরা মিশেছি, তাতে দূর থেকে যে কেউ মনে করতে পারেন আমরা হয়তো তাঁর সহকর্মী। আমরা নিজেরা আলোচনা করে ঠিক করলাম, পরদিন আমরা প্রদীপদার সঙ্গে ঘুরতে যাবো, খাবো। রাতেই দেখা হলো প্রদীপদার সাথে।

কিন্তু পূজা উপলক্ষে তিনি অসম্ভব ব্যস্ত। আগামীকাল তিনি সময় দিতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের তিনি অবশ্যই সময় দিতে চান। কী আর করা! আমাদের পরিকল্পনার বাইরে আরো একটি দিন বেশি থাকতে হবে। খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা বেরুলাম পূজা দেখতে।

আসলে পূজা নয়, আমরা বেরিয়েছি মানুষ দেখতে। আমাদের পাশের দেশের মানুষ, ভিনদেশের মানুষ। তারা কীভাবে উল্লাস করে, তা আমরা দেখতে চাই। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই না হতে আরো বড়’। তারা কীভাবে গেয়ে বেড়ায় তাও দেখতে চাই আমরা।

তাদের কলকাকলিগুলো কীরকম শুনতে চাই। ছেলেমেয়ে-নারীপুরুষ প্রভেদ বা ভেদাভেদ কতটুকু তাও বুঝতে চাই আমরা। রাস্তায় বেরিয়েই হতভম্ব হয়ে গেলাম আমরা তিনজনই। এতো মানুষ! এতো মানুষ! তখন রাত বারোটা। আলোকোজ্জ্বল সব পূজামণ্ডপ।

রাত যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের উপস্থিতি। কি নারী, কি পুরুষ; কি যুবা কি বৃদ্ধ; কি বাঙালি কি আদিবাসী- সবাই শামিল এই পূজার উৎসবে। আর কী প্রাণবন্ত একেকজন! ভাবছেন আমি বেশি উচ্ছ্বসিত! হয়তো বা। কিন্তু আপনি যদি একটিবার পূজার সময় আগরতলা ঘুরে আসেন আর আপনার ভাব ব্যক্ত করেন, আমি জানি আমার এই লেখা আপনার কাছে পানসে মনে হবে। পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাস্তায় মানুষজনের উচ্ছ্বাস দেখেছেন নিশ্চয়ই! ঠিক একইরকমের উচ্ছ্বাস সেখানে।

তবে কোলাহল কম মানুষের তুলনায়; রাস্তার ধারের দোকানপাট অনেক কিন্তু সজ্জিত ও শৃঙ্খলিত; ভিড় প্রচুর কিন্তু কেউ কারো গায়ে গড়িয়ে পড়তে চায় না; হৃদয় আকুল করা তরুণী অনেক কিন্তু মুগ্ধ হয়ে তাকানোটাই একজন তরুণের সবচেয়ে বড় অভিব্যক্তি সেখানে। আমি মনে মনে স্মরণ করলাম কবিগুরুকে- ‘ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে বহে কি বা মৃদু বায়, তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়। পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু কুহু গায়, কী জানি কিসেরই লাগি প্রাণ করে হায় হায়। । ’ হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম এক বাড়ির কাছে।

ঢাকের ছন্দ উঠানামা করছে চমৎকারভাবে। উঁকি দিতেই বাকহারা আমরা সবাই! নাচছে সবাই। বাড়ির সবাই! বাবা-মা-ভাই-বোন-দাদী-ভাবী- ছয় বছর থেকে শুরু করে ষাট বছরের সবাই। একটা পুরো পরিবার এক হয়ে নাচছে! একজন আরেকজনের হাত ধরে নাচছে! এই দৃশ্য আমি কি আর কোথাও দেখেছি? দু’জন ঢাক বাজাচ্ছে। নাচছে অন্তত বারো জন।

আর তিনজন বিমুগ্ধ দর্শক ব্যাকুল হয়ে দেখছে সেই নাচ। পূজার নাচ। কিন্তু নাচলেও গৃহকর্তার দৃষ্টি এড়ায়নি। কাকে যেন ইশারা দিলেন, অমনি হাজির পূজার প্রসাদ আর জিলাপি। আমরা সেই জিলাপি খেতে খেতে ভাবছি- এই স্বতস্ফূর্ততা কতোদিন ধরে নেই আমাদের মাঝে! কয়েক ঘণ্টা হেঁটে শরীর ক্লান্ত, মন সজীব।

ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা হলো আমাদের সবার। আলাপ করে জানলাম, এখানকার নারীরা পুরুষের চাইতে আলাদা কিছু নন। রাতবিরেতে বের হন একাই। সাইকেল চালিয়ে শাড়ি পরা নারী চলে যান কর্মস্থলে। পুরো রেস্টুরেন্টে সব কাজ করছেন একা এক নারী।

দোকানে দোকানে নারীর উপস্থিতি। ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করছেন নারীরা। দু’একজন বেয়াড়া পথচারীকে ধমকধামকও দিচ্ছেন আইন ভঙ্গ করার কারণে। তাও আবার তাদের একটি বিরাট অংশ আদিবাসী নারী। পাশাপাশি দুটি দেশ, একই ভাষা, সংস্কৃতি প্রায় একই- কিন্তু সেখানে নারীদের কী অবাধ উপস্থিতি, অবাধ স্বতস্ফূর্ততা, অবাধ তাদের স্বাধীনতার প্রকাশ! আমরা কি তাদের দেখে শুধু মুগ্ধই হবো? আমরা কি আমাদের দেখে শুধুই আফসোস করবো?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.