হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই
সেনসিবল মানুষ ছাড়া অন্য কাউকে পারতপক্ষে কখনোই পথের দূরত্ব জিজ্ঞেস করবেন না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, অপরিচিত জায়গায় আগে থেকে কী করে বোঝা যাবে একজন মানুষ সেনসিবল কি-না। আসলে মানুষ সেনসিবল কি-না সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। এজন্য অন্তত কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলা জরুরি। আপনি আপনার পরিচিতজনদের জিজ্ঞেস করুন- ঢাকা থেকে তার বাড়ি যেতে কত লাগে কিংবা উল্টোটা।
আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, অধিকাংশ মানুষই যে সময় বলবে, সময় লাগবে তার চাইতে বেশি।
একই অভিজ্ঞতা হয়েছে ত্রিপুরাতেও। উদয়পুরে থেকেই ভাবছিলাম আগরতলা গিয়ে পরদিন কী করব। একসময় পরামর্শ এলো, উত্তরের দিকে যেতে। সেখানে অনেক পাহাড় আছে।
উত্তরে আছে উনাকুটি নামের একটি দর্শনীয় স্থান, কিংবা কৈলাশহর বা ধর্মনগর। আরো যেতে চাইলে আসামের গুয়াহাটি পর্যন্ত যাওয়া যায়। তবে সেটি আমাদের সময়ে কুলোবে না। আগরতলা থেকে আসামের গুয়াহাটি বাসে যেতে সময় লাগে পুরোপুরি ২৪ ঘণ্টা। ত্রিপুরা সীমান্ত পেরুতেই ১২ ঘণ্টা সময় পেরিয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত আমরা ঠিক করলাম কৈলাশহর যাবো। আর কৈলাশহরে যেতে কতক্ষণ লাগবে- আমাদের এ প্রশ্নের জবাবে যে যার মতো একটি সময় বলে দিলো। একজন ভিনদেশিকে বিভ্রান্ত করতে আর কী চাই! এ কারণে সেদিন আর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো না। সবাই ভাবলাম, আগরতলা গিয়ে প্রদীপদার সঙ্গে পরামর্শ করে যা হোক একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। আপাতত লক্ষ সিপাহীজলা।
সিপাহীজলা একটি অভয়ারণ্য। একদম আমাদের লাউয়াছড়ার মতো। তবে পার্থক্য হলো, লাউয়াছড়াকে আমরা আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি; আর ত্রিপুরা সরকার সিপাহীজলাকে সাজাচ্ছে সেভাবেই। অথচ সিপাহীজলার চাইতে লাউয়াছড়া প্রাকৃতিকভাবে অনেক বেশি আকর্ষণীয়, অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর, অনেক বেশি জীবন্ত। তাছাড়া লাউয়াছড়ায় গিয়ে আপনি আপনার পাশে কী গাছ দেখছেন, সে সম্পর্কে লেখা পাবেন যা সিপাহীজলায় নেই।
ফলে বনে অগুনতি গাছের মাঝে দাঁড়িয়েও আপনি জানছেন না, আপনি কাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
সিপাহীজলার ব্যাপারে প্রথম আলোর এক সাংবাদিকের মুখে প্রশংসা শুনেছিলাম। তিনি আমাদের বলে দিয়েছিলেন পারলে একটি রাত সে বনে কাটিয়ে আসতে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ঈদের বন্ধ ও পূজা উপলক্ষে কটেজগুলো ভর্তি। সিপাহীজলা কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে এদের অনেকেই নাকি বাংলাদেশের।
ফলে দিনে গিয়ে দিনে ফেরত আসার প্ল্যান করতে হলো।
উদয়পুর থেকে আগরতলার বাসে করে সিপাহীজলার গেটে নামলাম। শেষ চেষ্টা হিসেবে আমরা আবার চেষ্টা করলাম কোনো কটেজ পাওয়া যায় কি-না। নেই। অবশ্য পরে এই না পাওয়ার বেদনা কেটে গিয়েছিলো যখন জানলাম, এই কটেজগুলো ভাড়া দেওয়া হয় শুধু দিনে থাকার জন্য।
রাতে বনে থাকা যায় না। যা হোক, আমাদের সাথে ব্যাগট্যাগ রয়েছে; থাকার জায়গা যেহেতু পাওয়াই যাবে না, তাই কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলাম অন্তত ব্যাগগুলো কোথাও রাখতে। সেখানকারই এক নিরাপত্তারক্ষীর বাসায় ব্যাগ রেখে টিকিট করে আমরা ঢুকলাম সিপাহীজলা অভয়ারণ্যে।
অভয়ারণ্যের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ বনের ভেতরের বিশাল চিড়িয়াখানা। গেট থেকে যার দূরত্ব সাড়ে চার কিলোমিটার।
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। অধিকাংশ পর্যটকই এই দূরত্বে অটো নিয়ে যায়। আমরা তিনজন যথাক্রমে উঠতি যুবক, যুবক এবং পড়ন্ত যুবক। বনের মধ্যে হেঁটে বন দেখতে দেখতেই যদি না যাই, তাহলে বন দেখার সার্থকতা কী? অটোর ভেতরে থেকে কী দেখব! গা ছমছম করবে? করুক। পিচঢালা রাস্তায় এটুকু কষ্ট সহ্য না করতে পারলে কীসের যুবক আমরা? অগত্যা ছাতা নিয়ে হণ্টন।
যাচ্ছি, গল্প করছি আর জীবজন্তু দেখার চেষ্টা করছি। একসময় গাছের ডালে দেখা গেল তাদের। তারা মানে, ওই যে তারা। ওনাদের পূর্বপুরুষ এবং আমাদের পূর্বপুরুষ একসময় একই প্রজাতিভুক্ত ছিলো। কালের বিবর্তনে তারা গাছে, আমরা মাটিতে।
কালের বিবর্তনে অহংকারে তাদের মাটিতে পা পড়ে না, কালের বিবর্তনেই আমরা বিনয়ে মাটির সঙ্গে মিশে আছি। তাদের নাম বানর, আমাদের নাম মানুষ। যেহেতু তাদের সাথে আমাদের একটি ম্যাসিভ মিল আছে, তাই ঢাকা চিড়িয়াখানায় গেলে শুরুতেই যেমন তারা আমাদের স্বাগত জানায়, সিপাহীজলায়ও তেমনি পশ্চাৎদেশ দেখিয়ে তারা আমাদের স্বাগত জানালো। তারা বসে আছে আমাদের দিকে পেছন ফিরে।
বানররাজ্যের মধ্যেও তারা কিন্তু স্পেশাল।
তারা চশমাবানর (চশমাবানরের ছবিটি দেখুন। মনে হয় চোখে চশমা পড়ে আছে। ছবিটি নেওয়া হয়েছে ত্রিপুরা পর্যটন বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে)। বলা হয়, পৃথিবীতে একমাত্র সিপাহীজলাতেই চশমাবানর আছে। তাদের নয়ন দিয়ে দেখে হৃদয় শান্ত করলাম।
এখন আমি গর্বভরে আওয়াজ দিতে পারি, এই ব্লগে কয়জন ব্লগার আছেন যে চশমাবানর দেখেছেন? (এই পোস্টের বানরটি ছাড়া)
পেট চোঁ চোঁ করছে এবং ওই সময়েই আমরা সাড়ে চার কিলোমিটার কচ্ছপহাঁটা শেষ করছিলাম। গেটে একজন বলেছিলেন, ভেতরে ক্যান্টিন আছে। খাবার পাওয়া যাবে। কিন্তু কোথায় কী? কোনো ক্যান্টিনই নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম, শুধু পথের দূরত্বের বিষয়েই নয়, যে কোনো বিষয়েই তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে সেনসিবল মানুষ ছাড়া আর কারো কাছ থেকে তথ্য নিবো না।
উল্টাপাল্টা তথ্য দিয়ে মানুষ যে কী শান্তি পায় কে জানে!
যাই হোক, আবার টিকিট কিনে চিড়িয়াখানায় ঢুকলাম। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, খাঁচার সিংহ নাকি মনে করে তাকে আনন্দদানের জন্যই এতোগুলো মানুষকে তার সামনে হাজির করানো হয়েছে। যেদিন চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকে, সেদিন নাকি তাই সিংহের মেজাজ খিঁচড়ে থাকে। আমরা বাঘ, সিংহ থেকে শুরু করে গাধা, উল্লুক সবাইকে আনন্দ দিয়ে আসলাম। আমাদের পাশে অন্য এক দর্শনার্থী বিকট শব্দে হঠাৎ করেই উল্লুকের মতো গলা ছেড়ে 'অওউ' 'অওউ' বলে ডেকে উঠল।
নিমিষেই চিড়িয়াখানার যতো উল্লুক আছে ডাকাডাকি শুরু করলো। আমরা জানতাম, কেউ যদি না বুঝে, বিচার-বিবেচনা না করে আরেকজনের সাথে তাল মেলাতে শুরু করে, তাকে নাকি উল্লুক বলা হয়। ‘উল্লুকের মতো কাজ করিস কেন’- হাকিম স্যারের যে অমৃতবাণী ছোটবেলায় আশির্বাদ হিসেবে পেয়েছিলাম, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝলাম এতোদিনে। এটাও বুঝলাম মানুষকে কেনো উল্লুক বলে গালি দেওয়া হয়। এনজিওরা নাকি সবকিছুতেই লার্নিং খুঁজে।
চিড়িয়াখানায় এসে আমাদের দারুণ লার্নিং হচ্ছে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।