হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই
আমরা কেউই ক্যামেরা নিয়ে যাইনি।
ক্যামেরার ব্যাপারে আমার কিছুটা অ্যালার্জি আছে। এমনিতে মাঝে মাঝে জন্তু-জানোয়ার-গাছপালা-আকাশ-বাতাস-মাঠ-ক্ষেত-নারী-পুরুষের ছবি তুলি। কিন্তু কোথাও বিশুদ্ধ বেড়াতে গেলে ক্যামেরা নিই না। আমার মনে হয়, ক্যামেরা নিয়ে গেলে আমার দৃষ্টিটুকু আটকা পড়ে যাবে ক্যামেরার শাটার স্পিড ও কালো রঙের ফিল্মের মাঝে।
আমি যা দেখতে চাই তা পুরোপুরি দেখতে পাবো না। মনোযোগ অনেকটাই চলে যাবে ক্যামেরার প্রতি। বারবার মনে হবে- অনেক ছবি তুলছি, গিয়ে আরো ভালোভাবে দেখে নেব এই জায়গাটাকে। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা।
তাই সেটা করতে দিইনি কখনোই।
যা দেখার চোখ ভরে মাথায় তার স্মৃতিটুকু নিয়ে ফেরত এসেছি। ক্যামেরার ফিতায় সেগুলো বন্দী করিনি। ফলে আজও যখন চোখ বন্ধ করি, ভাবি সেই বেড়ানোর দিনগুলোর কথা, তখন আশ্চর্য প্রশান্তিতে ভরে যায় মন। এ-ঘটনা ও-ঘটনা কত কী যে মনে পড়ে! অনেক সময় তো রাতই কাবার হয়ে যায়। আমার এই অখণ্ড মনোযোগ আমি কখনোই ক্যামেরাকে দিতে চাই না।
ফলে আমি ক্যামেরা নিইনি। অন্য দুজনের মধ্যে একজনের ক্যামেরা নেই। আরেকজন আনেনি ইচ্ছে করেই। পরে আলাপ করে দেখলাম, তিনজনই আসলে কাছাকাছি মানসিকতার- অন্তত এ ব্যাপারে। দেখতে এসেছি, দেখবো দুচোখ দিয়ে।
সিপাহীজলা থেকে আগরতলা ফিরলাম। শহরে নেমে ভাবলাম হোটেল চেঞ্জ করি। আরেকটি হোটেলে থেকে দেখি কেমন লাগে। ব্যাগ নিয়ে হাঁটাহাঁটি ও রুম দেখাদেখির পর মনে হলো আগের হোটেলটিই ভালো। আবার ফেরত গেলাম সেখানে।
যাওয়ার আগে শঙ্কর হোটেলে খেয়ে নিলাম। শঙ্কর হোটেলর বেশ নামডাক আছে আগরতলায়। কেউ কাউকে খাওয়াতে নিয়ে গেলে এ হোটেলেই নিয়ে যায়। তবে খেয়ে আমরা কিন্তু খুব বেশি ইমপ্রেসড হইনি। কারণ খাওয়ার স্বাদ নিউ আদর্শ হোটেলের কাছাকাছিই কিন্তু দাম অনেক বেশি।
আগরতলা ফিরে রাতে দেখা করলাম প্রদীপদার সাথে। তাকে বললাম, আমরা এবার যেতে চাই উত্তরের পাহাড়ের দিকে। প্রদীপদা প্রথমে মাথা নাড়লেন। ওদিকে যাওয়া ঝামেলার। কী কী ঝামেলা তা বললেন।
শুনে আমাদের উৎসাহ আরো বাড়ল। তখনই ঠিক করলাম আগামীকাল উত্তরে যাচ্ছি। পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে পাহাড় দেখতে দেখতে পাহাড় দেখতে যাবো। আমাদের উৎসাহ দেখে প্রদীপদা নিমরাজি হয়ে ধর্মনগরের সুদর্শন দাদাকে বলে দিলেন সেখানকার ট্যুরিস্ট লজ বুকিং দিতে এবং আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে।
সকালে হোটেল থেকে বেরুবার সময় হোটেল ম্যানেজারের চোখ ছানাবড়া।
জীবনে অনেক ট্যুরিস্ট দেখেছেন তিনি, কিন্তু এরা আবার কোন্ ধরনের? কোনো স্থিরতা নেই, পারলে আগরতলা থাকেই না, থাকে বনে-বাদাড়ে, পাহাড়ে, লেকে! তাঁকে বলে গেলাম, আবার আমরা আগামীকাল আসব এবং থাকব এ রুমটাতেই। তিনি আশ্বাস দিলেন, যদিও পূজার জন্য ভিড় হবে, তবে তিনি আমাদের জন্য রুমটি রেখে দিবেন। ভালো কথা, আমরা ছিলাম হোটেল প্যালেস ইন। আমাদের রুমে সার্ভ করতো যে ছেলেছি, ১৭/১৮ বছর বয়স, তার সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো। সেই আমাদের রিকশা ঠিক করে দিলো।
টিআরটিসি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে শুনি বাস ছাড়বে ১২টায়। তখন মাত্র ১০টা বাজে। দু’ঘণ্টা বসে থাকবো? তাছাড়া বাসের চেহারাও খুব ভালো নয়। আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী- যারা এই মতের সমর্থক, তাদের অনেকসময় বিরোধিতা করেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে বাসটিকে প্রথম দর্শনে আমাদের কারোরই ভালো লাগেনি।
ফলে বিকল্প খুঁজতে লাগলাম।
একসময় আবিষ্কার করা হলো, বাসের পাশাপাশি জিপের মতো দেখতে কিছু মাহিন্দ্র গাড়ি চলে। স্থানীয়রা এটিকে জিপই বলে। ঠিক করলাম, জিপেই যাবো। কিন্তু জিপের কাছে গিয়ে দেখি যেভাবে মানুষ গাদাগাদি করে বসেছে, তাতে পাহাড় আর দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে না; বরং যাওয়ার পর ডাক্তারকেই আসতে হবে আমাদের দেখতে।
সুতরাং এ চিন্তাও বাদ।
আর কোনো বাহন নেই। একসময় চিন্তা এলো জিপ রিজার্ভ করে নিয়ে যাই। শুনে দু’একজন অদ্ভুতভাবে আমাদের মাথার দিকে তাকালো। এর অর্থ বুঝতে পারছেন? না পারলেই ভালো।
সবার অদ্ভুতুরে দৃষ্টি কাটিয়ে আমরা জিপ রিজার্ভ করতে গেলাম।
মামুন ভাই দরাদরি করতে পারেন এবং দরাদরি করেই ভালোটা বাছাই করতে পারেন- তা সে জামা কেনা হোক, আর জিপ রিজার্ভ করাই হোক। সুমন ভাইকে ব্যাগ পাহারা দিতে বলে আমি তার সঙ্গী হলাম। সে কী যুদ্ধ! এমনিতে হয়তো পুরো গাড়িতে যাত্রী বোঝাই হয়ে গেলে ভাড়া ওঠে ১১০০ টাকা। কিন্তু রিজার্ভ নিতে গেলেই ১৬০০ টাকা।
আমরা বললাম, আমরা রিজার্ভ নিবো না, কিন্তু তিনজন যাবো আর সবার ভাড়া দিবো। তখন তাদের হাসি আর কে দেখে! ‘দাদা, এইডারেই তো রিজাব কয়!’
কোনোকিছুতেই কিছু হচ্ছে না। প্রখর রোদ্রে দাঁড়িয়ে এ গাড়ি ও গাড়ি আলাপ করতে করতে ইতোমধ্যে গড়িয়ে গেছে ৪৫ মিনিট। মামুন ভাইয়ের উদ্যম আছে এখনো আর আমার পেয়েছে চায়ের তৃষ্ণা। সটকে এলাম।
সুমন ভাইকে বললাম, আমি পাহারা দিচ্ছি, আপনি ও মামুন ভাই মিলে জিপ ঠিক করেন। এই ফাঁকে আমি দু’কাপ চা খেয়ে নিলাম। অবশেষে সুমন ভাই ও মামুন ভাই ১৫০০ টাকা দিয়ে জিপ রিজার্ভ করে নিয়ে এলেন। ততক্ষণে অবশ্য পার হয়ে গেছে আরো একটি ঘণ্টা।
আগামীকাল বলবো সেই কাহিনী।
পাহাড়ের মাঝখানে প্যারা-মিলিটারি বাহিনীর অস্ত্রসজ্জিত গাড়ি সামনে পেছনে ও পাশেপাশে থেকে আমাদের কীভাবে কমান্ডো স্টাইলো স্কোয়াড করে নিয়ে গেলো- সেই কাহিনী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।