হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই
প্রথম দু’ঘণ্টা বেশ নিরবিচ্ছিন্ন গতিতেই এগিয়ে চললাম। আগরতলা শহর থেকে বেরুনোর প্রায় পর থেকেই পাহাড়ের দেখা শুরু। ছোট পাহাড় আস্তে আস্তে বিশাল হচ্ছে। দু’ঘণ্টা পর বাস থামল তেলিয়ামুড়ায়। এখানে সারি সারি গাড়ির লাইন।
সবাই অপেক্ষা করছে স্কোয়াডের জন্য।
এখানে স্কোয়াডের বিষয়টি বিস্তারিত বলা দরকার। এই ঘন বন এবং পাহাড়ী রাস্তায় আদিবাসীদের একটি গ্রুপের তৎপরতা রয়েছে। এছাড়া আসামের উলফা কিংবা আশেপাশের রাজ্য থেকেও অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী মাঝে মাঝেই অপারেশন চালাতো। বছর পাঁচেক আগেও এ অবস্থা ছিলো।
শেষবার এ ঘটনা ঘটে তখনই। এ ধরনের একটি ঘটনা আসাম ও ওই এলাকার অন্য রাজ্যগুলো থেকে ত্রিপুরাকে বিচ্ছিন্ন রাখতে যথেষ্ট। ফলে ত্রিপুরা সরকার এ এলাকায় নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য সিআরপিএফ অর্থাৎ সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সকে দায়িত্বে রেখেছে। এই সিআরপিএফ একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর যাত্রীবাহী ও মালবাহী সব গাড়িকে স্কোয়াড করে পাহারা দিয়ে নিয়ে যায়। সবার সামনে ও পেছনে সিআরপিএফ-এর একটি করে স্কোয়াড-কার থাকে ও মাঝখানে বেশ কয়েকটি টহলকার থাকে।
প্রতিটি গাড়িকেই এদের কঠোর তত্ত্বাবধানে সারিবদ্ধভাবে অনেকটা আস্তে আস্তে এ পথ পাড়ি দিতে হয়। তেলিয়ামুড়া থেকে দু’ঘণ্টা পার হওয়ার পর কিছুটা বিরতি। তারপর আবার আমবাসায় এই স্কোয়াডের কাজ শুরু হয়। অর্থাৎ ধর্মনগর যেতে দু’বার স্কোয়াড পেরুতে হয়।
আমবাসা নামটিকে কি চেনা চেনা লাগছে।
হ্যাঁ, এখানেই চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। অবশ্য আমরা যখন যাই তখন এই তথ্যটি ভালোভাবে জানতাম না।
পুরো পাহাড়ী পথ। আমাদের বান্দরবান থেকে চিম্বুক যেতে যে ধরনের পথ, সেরকম। অনেক জায়গায় বিপজ্জনক সব বাঁক।
আমরা আস্তে আস্তে উঁচুতে উঠছি। আশেপাশে টিপরা, খাসিয়া নারীরা কাজে যাচ্ছে। পরনে তাদের নিজস্ব পোশাক। দু’একজন সেজেছও বেশ। কেউ কেউ গোসল করে ফিরছে।
মাথায় অবশ্যই একটা বড় ঝুড়ি। কারো পিঠে বাচ্চাকাচ্চা। বিচিত্র সব ভাষায় তারা কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। কেউ কেউ বাংলাও বলছে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম দু’একজনের সাথে কথা বলা যায় কি-না।
কিন্তু যে কঠোর স্কোয়াড, একবার লাইনচ্যুত হলে খবর আছে!
আমাদের জিপটির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। রাস্তার অবস্থাও মোটামুটি খারাপ। তবে লোকজন কম বলে আয়েশ করে যেতে পারছি। টানা ৯ ঘণ্টা ভ্রমণের পর যখন ধর্মনগর ট্যুরিস্ট লজে পৌঁছলাম, তখন ইচ্ছে করলেই শরীরের মাংস থেকে হাড়গুলো খুলে মুছে তেলটেল দিয়ে আলাদা করে রাখতে পারতাম। সুতরাং তখন প্রথম চিন্তা ছিলো- আহার সারতে হবে।
আমাদেরকে ধর্মনগরে রিসিভ করেছিলেন সুদর্শন দাদা। পুলিশের মতো টুপি মাথায় তার। হঠাৎ দেখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ ভেবে ভ্রম হয়। তিনি আগে থেকেই একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিলেন সেখানকার কিছু লেখক-সাংবাদিকদের সঙ্গে। আমাদের কাহিল অবস্থার মাঝেও তার অনুরোধ রাখতে ছুটতে হলো সেখানে।
অবশ্য গিয়ে ভুল করিনি। চিন্তাশীল কয়েকজনের সাথে কথা হয় যাদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা আমাদের বেশ মুগ্ধ করেছে। তারা আমাদের সিঙ্গারা ও মিষ্টি খাওয়ালেন। এবং এখানে আমি দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি- এমন সুস্বাদু সিঙ্গারা আমি আর কোথাও খাইনি।
পাহাড়ী পথ দেখতে গিয়েছিলাম, পুরোটাই দেখতে দেখতে এসেছি।
মনে আক্ষেপ নেই। তাই সিদ্ধান্ত হলো পরদিন বাসেই আগরতলা যাবো। কিন্তু পরদিন সকালে যখন বাসস্ট্যান্ডে টিকিট কাটতে গেলাম, তখন পেছনের কয়েকটি সিট ছাড়া আর সব টিকিট শেষ। এমনিতে এ অবস্থা হয় না। কিন্তু পূজা শুরু হচ্ছে।
সুতরাং সবাই ছুটছে আগরতলা। তাই এতো ভিড়!
এই ঘটনা কিন্তু আমাদের উল্টো ব্যাপার। সবদিক থেকেই। বাংলাদেশে ঈদের ছুটি তিনদিন, দুর্গাপূজার একদিন। ত্রিপুরায় ঈদের ছুটি একদিন, পূজার তিনদিন।
ঈদে আমরা সবাই ঢাকা ছাড়ি, নিজের বাড়ির দিকে যাই। এখানে সবাই নিজের বাড়ি ছেড়ে আগরতরার পূজা দেখতে আসে।
এই ভিড়ের মধ্যে সাহায্য করলেন স্থানীয় স্যন্দন পত্রিকার সাংবাদিক সুমন। তার সহায়তায় আমরা একটি অলটো প্রাইভেট কার ১৬০০ রুপি দিয়ে ভাড়া করলাম। একবারে চকচকে নতুন।
পুনরায় রওনা দিলাম আগরতলার পথে।
ঠিক ৯ ঘন্টা পর আমরা আবার আগতলায় পৌঁছলাম। আজকে আর কিছু নয়। শরীর চলছে না। মন চাইছে ঘুম।
কী যন্ত্রণা! ঘুমের কথা মনে হতেই এখন এই ঢাকায় কম্পিউটারের কি-বোর্ডেও যে আঙ্গুল চলছে না! কী করি? আজকের মতো বিদায় নিবো কি?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।