আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি।
এত চিনি, তবু রনি ভাইয়ের মন খারাপÑ এটি একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের বিজ্ঞাপনের সংলাপ। টেলিভিশনে নিয়তই প্রচার হচ্ছে। সংলাপের পেছনের গল্পটা হলোÑ এক তরুণ পাশের ফ্যাটের তরুণীকে দেখার অজুহাত হিসেবে বারবার চিনি আনতে যায়।
প্রতিদিন চিনিও আনা হয়, তরুণীর সাথে দেখাও। কিন্তু একদিন তরুণীর মায়ের হাতে ধরা পড়া, অতঃপর হোলসেলে চিনি! এতে মন খারাপ করা রনির জন্য শিশু মডেলের আফসোস ঝরে পড়ে ওই সংলাপে!
এটা সংলাপনির্ভর বিজ্ঞাপন হলেও, একটি বিউটি সোপের বিজ্ঞাপনে ভারতীয় কিং খানের উপস্থিতি ও নারী মডেলের গলায় তার নাকের স্পর্শ সহজে মেনে নেয়া যায় না। কিংবা ভাটিকা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে হাফ স্কার্ট পরা তরুণীর বুকের ওপর থেকে ফাঁকা অংশ দেখে নিশ্চয় কেউ শালীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন।
টেলিভিশনে আজকাল এ রকম বিজ্ঞাপন হামেশা হচ্ছে। সেটি এখন ছড়িয়ে পড়ছে বিলবোর্ডেও।
অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশানের বিপণিবিতান আর জুয়েলারিগুলোর বিজ্ঞাপনে সমাজের চেহারা ফোটেনি। ফুটেছে বিকৃত কামাচারের চেহারা। এতে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তবে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলছেন, সমাজ, সভ্যতা ও শালীনতা বিসর্জন দিয়ে বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়া কোনো তরুণীরই উচিত নয়।
ভাসাভি নামে যে ফ্যাশন মলটি রয়েছে গুলশান ১ নম্বরের লেকপাড়ে, তাদের বিজ্ঞাপনে বরাবরই নারী দেহের উন্মুক্ত প্রদর্শনী।
শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো মেলে ধরে বিজ্ঞাপনে প্রচার করে তারা। ভাসাভি তাদের জন্ম থেকেই এ রকম আগ্রাসী ও খোলামেলা বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। সংবাদপত্রের পাতায়ও এসব বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে।
হাতিরঝিল থেকে মগবাজার রেলগেট দিয়ে বের হওয়ার সময় চোখে পড়বে ভাসাভির মস্তবড় বিলবোর্ড। সম্প্রতি চালু হওয়া ভাসাভি ডায়মন্ড জুয়েলারির বিজ্ঞাপন চিত্রে অংশ নেয়া মডেলের বুকের ওপর থেকে গলা পর্যন্ত খোলা।
তাতে শোভা পাচ্ছে হিরের গয়না। কী বোঝানো হচ্ছে এটা দিয়ে? এ বিষয়ে জানতে ভাসাভিতে যোগাযোগ করলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একই রকম বিজ্ঞাপন প্রচার করছে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। ডায়মন্ড পরতে হলে যেনো শরীর খুলে দিতে হবে, এমন একটা ভাব বিজ্ঞাপনে। একই রকম অবস্থা দেখা গেছে আপন জুয়েলার্সের বিজ্ঞাপনেও।
ক্যাটস আই, এক্সটেসির পোশাকআশাক আর প্রাইড শাড়ির বিজ্ঞাপনে একই হাল।
পুরুষের ব্যবহার করার বডি ¯েপ্রতে নারীর অবস্থান। কুল বডি ¯েপ্রর বিলবোর্ডে দেখা যাচ্ছে অর্ধনগ্ন পুরুষকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছেন এক নারী। যৌনাবেদনময়ী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে নারী মডেলকে। একই বিজ্ঞাপন টিভি ও পত্রিকার পাতায় যাচ্ছে।
মহাখালী ফাইওভারের নিচে, বনানী, উত্তরা ও গুলশানে এসব বিজ্ঞাপনের আধিক্য। হরহামেশা এসব বিপণিবিতানে আসছেন ভারতীয় তারকা মডেলরা। এসব এলাকার শপিং মলের বড় একটা অংশ কিন্তু ভারতীয় পণ্যে ঠাসা। নামটাও ভারতীয় ধাঁচের। যেমন রূপ মিলান কিংবা জারা।
বনানী ও ধানমন্ডিতে সরাসরি ভারতীয় ফ্যাশন হাউজ মান্যবর শোরুম খুলে ব্যবসা করছে।
যাদের লক্ষ্য করে এমন বিজ্ঞাপন তারা এটি কিভাবে দেখছেন? জানতে চাইলে গুলশানের নিকেতনের বাসিন্দা নিশা বলেন, এ সব বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনে বাস্তবতার প্রতিফলন নেই। মানুষ বাসায় বা এক্সকুসিভ ফ্যামিলি পার্টিতে যে রকম পোশাক পরেন, সে রকম সাজ পোশাক বিলবোর্ডে দেয়া কোনোভাবেই সমীচীন হতে পারে না।
তিনি বলেন, ঘরের বিষয়গুলো বাইরে টেনে আনার মধ্যে কোনো আভিজাত্য নেই। এতে করে নারীর প্রতি মানুষের একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।
এ থেকে বের হয়ে আসারও দাবি করেন তিনি।
একই রকম কথা বলছেন বনানীর ই-ব্লকের বাসিন্দা সামিহা। তার মতে, বিলবোর্ডে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যেটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
তিনি বলেন, পুরুষের ব্যবহার্য জিনিসেও নারীকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
বিলবোর্ডে এমন সব বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে, যেটি নৈতিকতাবিবর্জিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উন্নত বিশ্বের কোনো দেশেই এ রকম বড় বড় বিলবোর্ড নেই। এবং নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রেখেই সেসব বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিলবোর্ডে সাইজের ক্ষেত্রে নীতিমালা না থাকায় এখানে সেখানে বড় বড় বিল বোর্ড বসানো হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মাসুদা এম রশীদ চৌধুরীর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নারীকে দিয়ে সব ধরনের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করার পেছনে অনেকে মনে করেন এতে বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করা সম্ভব।
এটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। নারীকে পণ্যের গ্রাহক আকর্ষণের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা, নারীর সম্মানহানির শামিল।
তার মতে, সরকারের তরফে এমন একটা নীতিমালা থাকা উচিত যেখানে সেখানে চাইলেই নারীকে ব্যবহার করা যাবে না। বিলবোর্ড বা টিভিতে আজকাল যেসব বিজ্ঞাপন যাচ্ছে সেখানে নারীদের মূল আব্রু থাকছে না। এখানে উপস্থিত হচ্ছে ওয়েস্টার্ন ও ভারতীয় ধারা।
এ ধারা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মেলে না। তাই এটা পরিত্যাগ করা উচিত।
অধ্যাপক মাসুদা বলেন, অনেক পর্দানশিন পরিবারে এসব বিজ্ঞাপনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মানুষ যেসব পোশাক আগে লুকিয়ে পরত, এখন তা প্রকাশ্যে চলে আসছে। বিলবোর্ড ও টিভিতে জায়গা করে নিচ্ছে।
এতে করে মূল্যবোধের একটা অবক্ষয় তৈরি হচ্ছে। নারীদের ব্যবহার ও প্রদর্শনের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা তৈরিতে এসব বিজ্ঞাপনের কোনো ভূমিকা আছে কি নাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমাজে যে ধর্ষণ হচ্ছে তার একটা কারণ হতে পারে এ ধরনের অশালীন বিজ্ঞাপনে নারীদেহের বিকৃত উপস্থাপনা। এখানে মানুষের বিকৃত রুচিও কাজ করছে। তবে আপসে সেকচ্যুয়াল একটিভিটিজ বেড়ে যাচ্ছে।
এর প্রধান কারণ আমরা আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমি বলছি না পুরনোকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। তবে মূল্যবোধ বিসর্জন দেয়া চলবে না।
তিনি বলেন, যেসব মডেলকে আমরা বিলবোর্ড বা টিভিতে অশালীনভাবে দেখি, তাদের সে উপস্থাপিত বিজ্ঞাপনের পেছনে অনেক কিছু রয়েছে। এ বিজ্ঞাপন তৈরির সাথে জড়িতরা নারী নন, পুরুষ।
তারা তাদের শরীর স্পর্শ করছেন, এটা ওটা দেখিয়ে দিচ্ছেন। এতেও একটা পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে।
তার মতে, মেয়েদের ব্যবহার্য জিনিসের বিজ্ঞাপন মেয়েরা করবে, ছেলেদের ব্যবহার্য জিনিসের বিজ্ঞাপন ছেলেরা করবে। এবং সেটি অবশ্যই হতে হবে আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিল রেখেই।
নয়া দিগন্ত অনলাইন থেকে নেয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।