বিবাহপূর্ব গায়ে হলুদ মানেই সুখকর একটা কিছু। খা খা দুপুরের বিষন্নতা বোঝাতেও লাগে হলুদ রং। আবার প্রকট হলুদাভ বিকেলের আলো মুখে পড়লে বিনে আয়োজনে অনেকেই পেয়ে যান 'হলুদ সুন্দর কন্যা' খেতাব। হলুদ না থাকলে প্রকাশনা জগত কখনই ফোর কালারের বাহার দেখতো না। ব্যতিক্রম কেবল সাংবাদিকতা।
এর গায়ে হলুদ ছোপ পড়লে আর রক্ষে নেই। জাত কূল আর থাকে না। বিশ্বাসের আসন টলোমলো, এথিক্স অস্তমিত। হাজারো মশলার ভীড়ে খাবারের মতো হারিয়ে যায় খবরের মৌলিক ফেভার। চাঞ্চল্যের আতিশয্যে বস্তুনিষ্ঠতা ছাড়িয়ে সবার উপরে সত্য হয়ে দাঁড়ায় 'কাটতি'।
রঙিন মোড়কের ভারে মূল খবরের ত্রাহি দশা। মূলত খবরের এই অতিরঞ্জিত রূপটাই 'হলুদ সাংবাদিকতা'। কিন্তু হলুদ এলো কোত্থেকে? উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে প্রায় ১২০ বছর আগে। সেই সময়কার একটি জনপ্রিয় কমিক চরিত্র থেকেই জন্ম হলুদ সাংবাদিকতা তথা 'ইয়েলো জার্নালিজম'-এর।
সময়কাল ১৮৯৫-১৮৯৮।
তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে দুটো পত্রিকা দারুণ চলছে। একটি জোসেফ পুলিতজারের 'নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড'। অন্যটি উইলিয়াম র্যান্ডল্ফ হার্স্টের 'নিউইয়র্ক জার্নাল'। ওয়ার্ল্ড বেশ ক'বছর এক নম্বর অবস্থানেই ছিল। তবে জার্নালের দাপটে ক্রমশ ওটার কাটতি কমতে শুরু করে।
এক পর্যায়ে বেশি বেতনের প্রস্তাব পেয়ে হার্স্টের জার্নালে একে একে যোগ দিতে শুরু করে ওয়ার্ল্ড-এর কর্মীরা। উপায়ান্তর না দেখে প্রথমে পত্রিকার দাম কমান পুলিত্জার। তাতেও খুব একটা লাভ হলো না। শুরু হলো সংবাদকে আকর্ষর্ণীয় ও উত্তেজনায় টইটম্বুর করে উপস্থাপনের এক মরণপন লড়াই। শহরে প্রচণ্ড গরম? পুলিত্জার তার ওয়ার্ল্ড-এ ছাপলেন, 'যেভাবে শিশুরা পুড়ছে!', 'ছাদ থেকে খসে পড়ছে শিশুর পোড়া লাশ' ইত্যাদি।
অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড-এর অনুকরণে ছোটখাট দুর্ঘটনাতেও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের গন্ধ খুঁজতে লাগলো হার্স্টের জার্নাল। দুটো পত্রিকার কাটতি হু হু করে বাড়লেও ব্যাপারটাকে ভাল চোখে দেখলো না নিউইয়র্কের নীতিনির্ধারকরা।
অন্যদিকে হার্স্ট তার জার্নালের সাময়িকিতে চালু করলেন আনকোরা এক কমিক। তাতে আপাদমস্তক হলুদ কাপড়ে ঢাকা টেকো মাথার এক টোকাইকে দেখা গেল নিউইয়র্ক দাপিয়ে বেড়াতে। যে কিনা মাঝে মাঝেই তার লম্বা আলখাল্লায় অদ্ভুত সব বার্তা বয়ে বেড়ায়।
ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে গেল সেই কমিক চরিত্রÑ'ইয়েলো কিড' তথা হলুদ বালক। কিন্তু কিছুদিন না পেরোতেই জার্নালের দেখাদেখি পুলিত্জারও তার ওয়ার্ল্ডে হুবহু একই কমিক ছাপতে শুরু করলেন। দুটো পত্রিকার প্রতিযোগিতা এবার পরিষ্কার ধরা পড়লো পাঠকের চোখে। তবু কাটতি কমে না। শেষে সহ্য করতে না পেরে তলানিতে পড়ে থাকা নিউইয়র্ক প্রেস নামের একটি পত্রিকা বলে বসলো, 'পত্রিকা দুটো ঐ কমিক চরিত্র ইয়েলো কিডের মতোই আচরণ শুরু করেছে।
ওদের কাজকর্ম পুরোপুরি ইয়েলো কিড জার্নালিজম'। ব্যস, মুখে মুখে চালু হয়ে গেল খেতাবখানা। কমিক চরিত্রের নাম দিয়েই পাঠক বুঝতে শুরু করলো পত্রিকার চরিত্র। ইয়েলো কিড-এর কিড শব্দটা কাটা পড়লো কালের সম্পাদনায়। রয়ে গেল শুধু হলুদ।
এতদিনেও 'হলুদ সাংবাদিকতা'র সংজ্ঞা পাল্টায়নি। তবে নিত্য নতুন কৌশল আসায় ধরা পড়ার চান্স বেশ কমে গেছে। আর ধরা পড়লেই বা কী! হলুদ সাংবাদিকতার আসল জনক জোসেফ পুলিত্জারই তো কালের বিচারে বেকসুর খালাস। কেননা, তিনিই চালু করেছেন সাংবাদিকতায় সেরা পুরস্কার। তার নামে এখনও বিশ্বসেরা প্রতিবেদক পাচ্ছেন পুলিত্জার মেডেল এবং অবশ্যই তাকে হতে হবে 'হলুদ' বিবর্জিত!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।