আমার গোল্ডেন শৈশবের (কাশ থ্রি'র আগ পর্যন্ত) বেশিরভাগ কেটেছে কোলে চড়ে। বাবা আর আমি ছাড়া সংসারের বাকি সবাই নারী সদস্য। মা, তিন বোন, ছোট খালা, ছোট ফুপু; বাই টার্ন সবার কোলে ওঠা। আমাকে কোলে দেয়ার জন্য নাকি রীতিমত সিরিয়াল দিতে হতো (শোনা কথা)। তবে এক্ষেত্রে সবচে বেশি পাওয়ার ছিল 'বাম্মা'র।
ছোট খালাকে আমি দীর্ঘ সময় 'বাম্মা' ডেকেছি। এ সম্বোধনের পরিষ্কার অর্থ আমার জানা নেই। যাই হোক, বাম্মা আমায় কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে প্রায়ই কোমর ব্যথায় কাতরাতেন আর আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলতেন, 'এই ছেলেটাকে ধরে আছাড় দিতে ইচ্ছে করে! সারাদিন কোলে কোলে!' বাম্মার এই চোখ রাঙানো অদ্ভুত ভালবাসার চাপে আমার আহ্লাদের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। বৃষ্টির মধ্যে, কুয়াশার ভেতর, জোনাকির আলোয়, ভুতের গল্পে... কোলে চড়ার উপলরে যেন শেষ নেই।
দেড় বছর বয়সেই আমি মোটামুটি বেশকটি সবজি চিনে ফেলি।
কেননা, বেশিরভাগ সময় রাতের রান্না করতেন বাম্মা। আর একটা কিছুর দরকার হলে হামাগুড়ি দিয়ে আমিই সেটা এনে দিতাম। বাম্মার কথা এখনও কেমন যেন পরিচিত কোনও সূরে কানে ভেসে বেড়ায়, 'আমার সোনামানিক.. খাটের নিচ থেকে দুইটা আলু এনে দে...'।
ছোট ফুপুর নাম চামেলী। তার সঙ্গে বাম্মার প্রায়ই ঝগড়া লাগতো।
আমাকে নিয়েই। কে কতক্ষণ আদর করলো, এই ছিল কারণ। ক্লাশ টু থেকে থ্রি-তে ওঠার মাঝে যেকোনও একদিন চামেলী ফুপুর বিয়ে হয়ে যায়। উনি আমাকে মারাত্তক ভালবাসতেন ঠিকই। কিন্তু প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেতেন কম।
তারপর বাম্মার একক আধিপত্য শুরু। বুবু, বড় আপু ও ছোট আপু খুব একটা ফোর পেতো না। আমিও কম চালাক ছিলাম না। কড়া গলায় কেউ কিছু বললেই বিচার চলে যেত বাম্মা'র দরবারে। আর ভালবাসা মানেই তো ডার্ক জাস্টিস।
এমনও হয়েছে, আমাকে বকা দেয়ার কারণে বাম্মা চব্বিশ ঘণ্টা না খেয়ে ছিলেন! শেষে আমাকেই পাঠানো হতো বাম্মার রাগ কমানোর জন্য।
'দশটার নাস্তা' নামে একটা স্পেশাল আইটেম ছিল আমার শৈশবে। কাশ শেষে ঘরে ফিরতেই একটা কিছু খেতে দিতে হতো। এই 'দশটার নাস্তা'র উদ্ভাবক হলেন বাম্মা। ভালবাসা প্রদর্শনের জন্য হয়তো অনেক ভেবে চিন্তেই এ ডেঞ্জারাস উপায়টা আবিষ্কার করেছেন তিনি।
ডেঞ্জারাস বলার কারণটা হলো, বাম্মার মতে সকালের নাস্তা খেলেও স্কুল থেকে ফিরলে আমার পেট থেকে তা গায়েব হয়ে যায়। এ জন্য আবার খাওয়া উচি্ত। কিন্তু দ্বিতীয়বার নাস্তা তৈরির কষ্ট করা চলবে না। অগত্যা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত নাস্তার একটা অংশ আমার জন্য রেখে দেয়া চাই!
বাম্মার এ আত্তঘাতি সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন না আমার মা। প্রতিদিনই বকা দিয়ে গলা ফাটাতেন।
এক পর্যায়ে আমার জন্য দুবার নাস্তা তৈরির ব্যবস্থা করাও হলো। কিন্তু বাম্মার অভিনয়ের কাছে সব নস্যি। তিনি আমার জন্য লুকিয়ে খাবার রাখতে শুরু করলেন। দশটা বাজলে আমাকে চুপি চুপি রান্নাঘরে নিয়ে খাওয়াতেন। পেট ভর্তি থাকা সত্বেও সেই লুকিয়ে রাখা পিঠা ছিল আমার জন্য বাধ্যতামূলক।
এর এক থেকে দুই বছরের মধ্যেই বাম্মার বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু শিশুকালে আবেগ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই বাম্মার ভালবাসাটা দ্রুত ডাইভার্ট হয়ে যায় মা আর বড় আপুর দিকে। হ্যাঁ... দশটার নাস্তার কথাও আমি একসময় ভুলে যাই।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।