আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিঠি লিখেছে সে আমায় ভাংগা ভাংগা হাতে

আমার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে আজও ভাল লাগে । আমি একটা প্রেমের চিঠি হবো, নীল খামে সাদা চিঠি । ডাকপিয়ন আমাকে তোমার হাতে তুলে দেয়া মাত্রই তুমি আনন্দ পুলকে শিহরিত হতে হতে বাতাসে ভেসে ভেসে দৌড়ে যাবে তোমার ঘরে । দরোজাটুকু বন্ধ করে চরম আগ্রহে পরম মমতায় খাম ছিড়ে তুমি আমাকে খুলবে । আমার শরীরটুকু সযতনে খুলে নেড়েচেড়ে দেখবে ।

তারপর দু'হাতে ধরে নাকে চেপে আমার শরীরের সুভাষটুকু শুষে নেবে । আমার স্পর্শ পেয়ে তোমার শিরদাঁড়ায় বয়ে যাবে আনন্দের শিহরন । তারপর আমার ভাঁজ খুলে যেই না পড়তে যাবে, বাইরে কিসের যেন শোরগোল । তুমি চকিতে আমাকে ভাঁজ করে লুকিয়ে রেখে দিবে তোমার বুকের ওমে । আমিও তোমার বুকের উষ্নতা থেকে উত্তাপ শুষে নিয়ে সুধা পান করবো ।

তারপর যখন নিশ্চিত হলে তোমার ঘরে কেউ আসছেনা, আমাকে বের করে আনবে ওম থেকে । আমাকে হাতে নিয়ে নাচের মূদ্রার মত চক্কর দিয়ে তোমার শরীরটা এলিয়ে দিবে বিছানার উপর । উপুর হয়ে আবার আমার ভাঁজ খুলে এক নিঃশ্বাসে পড়ে নিবে । তারপর আবার পরম মমতায় বুকে চেপে ধরবে । আমি কান পেতে শুনতে থাকবো তোমার বুকের ধুকপুক আওয়াজ, সংগীতের গভীর মূর্ছনায় ।

শুধু আমাকে আবার রেখে দিওনা যেন তোমার বালিশের নিচে, তাহলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে ক্রমশ । আমাকে ঠাঁই দিয়ো তোমার প্রেমময়ী বক্ষ জুড়ে । আজ মেইল-চ্যাট-ম্যাসেজের যুগে চিঠি'র আবেদন শুন্য প্রায় । কি আবেগ, কি আবেশ, কি ভালোবাসা নিয়ে আমরা চিঠি'র প্রতিক্ষায় থাকতাম । কিংবা সারা রাত ভেবে ভেবে কাটিয়ে দিতাম চিঠিতে কি লিখবো বলে ।

স্কুলে পড়ার সময় টুকটাক ছড়া-কবিতা লিখে বেশ নাম করেছিলাম । আমার বাবা প্রবাসে থাকতেন, চিঠি'র মাধ্যমে বাবার সাথে চমৎকার একটা বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো । কিন্তু চিঠি লিখতে গিয়ে জীবনে প্রথম সংকটে পড়ি ক্লাস টেনে পড়ার সময় । আমার এক আদুভাই ক্লাসমেট সদ্য এক বালিকার প্রেমে পড়েছে । সে একদিন আমাকে চেপে ধরলো, আমার নাকি ভাষা সুন্দর তাই তার হয়ে আমাকে প্রেমপত্র লিখে দিতে হবে ।

কি লিখবো, কিভাবে লিখে প্রেমের চিঠি, সারা রাত ভেবে ভেবে পাগল প্রায় । পরেরদিন আদুভাই আসলে বললাম সাদা কাগজে প্রেমের চিঠি লেখা যায়না, চিঠি লেখার প্যাড কিনে আনো । বিকেলেই সে আমাকে প্যাড দিয়ে গেলো । সুন্দর রোল করা প্যাডের পাতায় লাল গোলাপের জলছাপ, উপরে ডিজাইন করে লেখা 'মনে রেখো' । তারপর সারা রাত জেগে জেগে প্যাডের সমুদয় পাতা নষ্ট করে যা লিখলাম, এখনও মনে আছে ওগো আমার সুন্দরী হরিনী, তুমি রাইতের ঘুম কাড়িনি ।

ঘুমাইলে খালি তুমারেই খোয়াবে দেখি । দুর থাইকা যখন চাইয়া থাক, আমার কইলজায় খালি মোচড় পাড়ে । আমার প্রানের কোকিল তুমি, সারাদিন কুহুকুহু ডাকো কেনে ? তুমারে একদিন না দেখলে আমার ভাত খাইতে ইচ্ছা হয়না । তুমারে না পাইলে আমি মজনু হইয়া যামু.. পরেরদিন ক্লাসে যাবার পর সবাই দেখি আমারে খেপানো শুরু করলো, তুমারে না পাইলে আমি মজনু হইয়া যামু.. । আদুভাই তার প্রেমিকাকে চিঠি দেয়ার আগে ক্লাসের আরো কয়েকজনকে দেখিয়েছে, চিঠি'র ভাষা ঠিক আছে কিনা জানতে ।

জীবনে একটাই চিঠি পেয়েছিলাম, তাও বেনামে প্রেম পত্র । তখন জাবি তে পড়ি । দেখলাম, চিঠি পোস্ট হয়েছে আমাদেরই ক্যাম্পাসের ডাকঘর থেকে । ভিতরে গুটিগুটি অক্ষরে সুন্দর করে লেখা একখানা প্রেম পত্র । চিঠি পড়ে বুঝলাম আমার জুনিয়র কোন মেয়ে লিখেছে, অসম্ভব আবেগী ভাষায় লেখা চিঠি ।

তিনি লিখেছেন, তিনি আমাকে দীর্ঘদিন থেকে দুর থেকে দেখে দেখে নিঃশ্বাস ছাড়তেন । মনে মনে ভালোবাসার স্বপ্ন বুনতেন । ভালোবাসার কথা মাত্র প্রকাশ করতে যাবেন, এ হেন সময়ে তিনি আবিষ্কার করেন আমি আরেকজনের সাথে.. । তাই মনের দুঃখে তিনি আমাকে প্রথম আর শেষ চিঠি দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করেছেন । আজো হায় খুঁজে খুঁজে ফিরি সেই বিরহী অনামিকা প্রেমিকার পরিচয় ।

তো যার সাথে ঘুরাঘুরি করার জন্য অনামিকা প্রেমিকা আমাকে প্রথম আর শেষ চিঠি লিখেছিলেন, তার সাথে তখনও তেমন কিছু হয়ে উঠেনি । বুঝতে পারছিলাম, যে পথ গিয়েছে হেঁটে অনেক দুর, ফেরার আর পথ রাখেনি বাকি । অথচ আমরা নিজেরা কেউই ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে পারছিলাম না । নিজের সাথে যুদ্ধ করে করে একদিন লিখেই ফেললাম একটা প্রেমের চিঠি, "প্রিয়তমাষু, যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলাম, সেদিনই বুঝলাম পৃথিবীতে আমারও অস্তিত্ব আছে । আমার অস্থিত্ব তোমার মাঝে ।

...জানো, আমি একটা নদীকে খুব ভালোবাসি । ছোট্ট শীর্ন নদী কিন্তু তার প্রতিটা বাঁক এমনই মোহনীয়, যেন কোন দেবীর শরীর । ...জানো, আমি একটা মানবী কে ভালোবাসি । তার মুখ মুখের মত, তার হাত হাতের মত, তার চিবুক চিবুকের মত, আর তার হৃদয় তোমার মত । ঐ নদীর বাঁকের মতই তুমি আমার কাছে দেবী, মানবী নও ।

...জেনো, যদি ভালবাসা না পাই, লন্ডভন্ড করে চলে যাব যেদিকে দুচোখ যায় । " যাইহোক সে চিঠি ম্যাজিকের মতই কাজ করলো । পথ আমাদের বন্ধহীন গ্রন্থিতে আবদ্ধ করলো । এই সময়েই আমার বাবা প্রবাস থেকে দেশে ফিরলেন । বিমানবন্দরে বাবাকে রিসিভ করে ঐ রাত এক সংগে হোটেলে কাটালাম ।

পরেরদিন বাবা আমাকে সাথে নিয়ে বাড়ি যেতে চাইলেন । আমি এক্সাম-ক্লাস-এসাইনমেন্টের ওজর দেখিয়ে বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম । জীবনে প্রথম প্রেম করেছি, তাই একদিনের জন্যেও দুরে থাকতে চাইনা । এদিকে বাড়িতে গিয়েই বাবা চিঠি দিলেন, কয়েকদিনের জন্য যেন বাড়ি যাই । আমিও যথারীতি একই ওজর দেখিয়ে কয়েকদিন পর বাড়ি যাব লিখে উত্তর পাঠাই ।

হঠাৎ একদিন বিকেলে ডাকঘরের মামা হলে এসে একটা জরূরী টেলিগ্রাম দিলো, মাদার সিক কাম শার্প । অজানা আশংকায় আমি ভয় পেয়ে যাই, রাতের ট্রেনেই বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত নেই । টেলিগ্রামের কথা শুনে আমার প্রেমিকারও মন খারাপ, বিভিন্ন কথা বলে আমাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে । পাশে থেকে হেঁটে যাওয়ার সময় আমার হাত চেপে ধরে আছে । রাত ৮টায় ক্যাম্পাস থেকে কমলাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব ।

হাটতে হাটতে দুজন লাইব্রেরীর পাশে এসে বসলাম । মায়ের চিন্তায় আমার মন খারাপ, সেও আমার কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে । হঠাৎ সে একটা কথা বললো, মাত্র দুটি শব্দ । আমার কান লাল হয়ে গেলো । আবারও সে নিচুস্বরে একই কথা বললো.. সেদিনের কথা থাক, আমরা বরং শেষের কবিতার কয়েক লাইন আবৃত্তি করি, চুমিয়া যেয়ো তুমি আমার বনভূমি দখিণ সাগরের সমীরন.. সারা রাত জার্নী করে সকালে বাড়ি গিয়ে পৌছালাম ।

না, সব কিছুই স্বাভাবিক । আমার বাবা আমার সাথে কয়েকদিন থাকার জন্য এই মিথ্যে টেলিগ্রাম করেছিলেন । আমার বাবার ভালোবাসার কোন তুলনা হয়না । চিঠি শুধু আমাদের বাস্তব জীবনেই নয়, আমাদের সাহিত্য-কবিতা আর সংগীতেও একটা বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে । কবিতার কথাই যদি বলি, প্রথমেই আনতে চাই প্রিয় কবি হেলাল হাফিজের 'প্রস্থান' থেকে কয়েক লাইন, "এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো পত্র দিও এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিও ।

ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মত খুব ব্যাথিত ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিও । কোন কথাটা অষ্ট প্রহর কেবল বাজে মনের কানে কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে পত্র দিও পত্র দিও । " চিঠি নিয়ে লেখা কবি মহাদেব সাহা'র কবিতাও খারাপ লাগবে না, "করুনা করে হলেও চিঠি দিও খামে ভরে তুলে দিও আঙুলের মিহিন সেলাই । ভূল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও একটু সামান্য দাবী চিঠি দিও । " নাজিম হিকমতের 'জেল খানার চিঠি' সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রান্জল অনুবাদে হয়ে উঠে ভালোবাসা আর দ্রোহের বিমূর্ত প্রতিক, "নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে উজ্জ্বল নীল শাখার মন্জুরীতে ফুলের দিকে আমি তাকিয়ে তুমি যে মৃন্ময়ী বসন্ত, আমার প্রিয়তমা আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ।

মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে তুমি যেন মধুমাস, তুমি আকাশ আমি তোমাকে দেখছি, প্রিয়তমা । " আর চিঠি নিয়ে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার সুবিখ্যাত মেটাফোর, যা আমাদের মাতৃভাষায় ভাষায় গাওয়া অন্যতম শ্রুত গান, ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও.. বাংলা ভাষায় চিঠি নিয়ে গান হয়েছে শত শত । নীল খামে সাদা চিঠি, চিঠি দিও প্রতিদিন, শেষ চিঠি কেন এমন চিঠি হয়, আরো কত শত । সবশেষে, সিলেটের গ্রামে গন্জে হোটেল-রেস্টরেন্টে হাল আমলের জনপ্রিয় বাউল কালা মিয়া'র চিঠি নিয়ে গাওয়া এই গান শুনতে খুব দারুন লাগে, চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাংগা ভাংগা হাতে.. ************************************************* ব্লগার প্রিয়তমেষু'র চিঠি নিয়ে লেখা একটি পোস্টে কমেন্ট করতে গিয়ে এই বিষয়ে কিছু লেখার অনুপ্রেরনা পেয়েছি ।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.