প্লাটফরমে পায়চারী করছি বহুক্ষণ ধরে। প্রতীক্ষা করছি ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিল্কসিটি ট্রেনের। অবশ্য প্রতীক্ষা করছি বললে ভুল হবে। আমার মন আকুতি মিনতি করে চাইছে ট্রেনটি যেনো আজ রাজশাহীতে না আসে। তবু অপেক্ষা করছি।
দু’টাকার বাদাম কখন যে ফুরিয়ে গেছে টেরই পাইনি। সুন্দর প্লাটফরমে অনেক বসার জায়গা আছে। কিন্তু আমার ভেতর অদ্ভূত এক অস্থিরতা কাজ করছে। গা বেয়ে দরদর করে নামছে ঘাম। এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাকে হতে হবে কখনো ভাবিনি।
রিপা এলে কিভাবে যে পরিস্থিতি যে সামলাবোÑ ভাবতেই কষ্ট লাগছে। সঙ্গে ওর মাও আসছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে আমি ভোরের কাগজে কাজ করি। নিত্যকার সংবাদ মেইল করা হয়ে গেলে প্রায় প্রতিদিনই ব্লগে ঢুকি। সেখানে নিজে লেখি আর অন্যের লেখার মন্তব্য করি।
আমি ব্লগে কোন লেখা পোস্ট করলে কপালে দু’চারটা মন্তব্য জোটে। কোন কোন পোস্টে কেউ মন্তব্যই করে না। একটা কথা বলে নেয়া ভালো, সেটা হলোÑ আমাদের ব্লগে মেয়েদের সংখ্যা খুবই কম। সব সময় দেখতাম মেয়েরা কোন লেখা পোস্ট করলে হুমরি খেয়ে পড়ে সবাই সেখানে মন্তব্য করে। জগা-খিচুরী লেখার জন্যও অনেক বড়মাপের লোকদের দেখেছি ভূয়সী প্রশংসা করতে।
অবশ্য আমি নিজেও মেয়েদের পোস্টে প্রতিদিনই মন্তব্য করি। কেন করি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ এ টান চিরন্তণ। তবে রিপা নামের একটি মেয়ের পোস্টের আমি ছিলাম রেগুলার মন্তব্যকারী। ব্লগের প্রোফাইলে ওর যে ছবি আছে সেটা দেখে ওকে আমার ভীষণ ভালো লেগে যায়।
কিভাবে ওর সাথে বন্ধুত্ব করা যায় কম্পিউটারের সামনে বসে এই ধান্ধাই করতাম। কিন্তু ওর সাথে হাই-হ্যালো, ধন্যবাদ এই শব্দগুলোর ব্যবহার ছাড়া আর কিছু হতো না।
কিন্তু অনেক কষ্ট করে একটি পোস্ট লেখার পর যখন কোন মন্তব্য পাই না তখন মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। হঠাৎ একদিন ছদ্মনামে লিখার সিদ্ধান্ত নিলাম। রিপার নামের সাথে মিল রেখে দিপা নামে একটি রেজিস্ট্রেশন করলাম।
প্রোফাইলে জুড়ে দিলাম অচেনা সুন্দরী একটি মেয়ের মুখোচ্ছবি। দিপা নামে যেদিন থেকে পোস্ট দিতে শুরু করলাম সেদিন থেকেই আমার পোস্টগুলো সুপারহিট। শত শত মন্তব্যের ছড়াছড়ি। অনেক পুরুষ ব্লগারই আমাকে পটানোর জন্য রকমারী মন্তব্য করতে লাগলো। এর মাঝে কাজের কাজটি হয়ে গেলো।
রিপার সাথে জমে উঠলো আমার বন্ধুত্ব। ও আমার ই-মেইল অ্যাড্রেস চাইলে দিপা নামে একটি এ্যাকাউন্ট খুলে ওর কােেছ পাঠিয়ে দিই। রিপা ঘন ঘন আমার কাছে মেইল করতে লাগলো। ও ওর পরিবারের কথা নিজের কথা সবকিছু আমাকে জানাতো। ওরা দুই ভাই এক বোন।
দুই ভাই-ই কানাডায় থাকে। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মায়ের সাথে ঢাকায় থেকে একটি প্রাইভেট ইউনিভর্সিটিতে বিবিএ করছে। আমিও আমার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে বলতাম। তবে আমি যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এ কথাটা সত্য বলেছি।
ও বরাবরই মোবাইল ফোনে আমার সাথে কথা বলতে চাইতো। কয়েকবার ওর সেল নম্বর পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি বরাবরই বিষয়টি এড়িয়ে গেছি। কারণ ফোনে কথা বললে তো আমি ওর কাছে ধরা পড়ে যাবো। ও আমাকে এতোটাই আপন করে নেয় যে অতি সামান্্য কোন কিছু ঘটলেও আমাকে জানাতো।
মাঝে মাঝে নিজেকে অপরাধী মনে হতো। মনে হতো রিপাকে সবকিছু খুলে বলি। কিন্তু পরক্ষণেই সে চিন্তাটা বাদ দিই। কারণ আমি ওর সাথে প্রতারণা করেছি জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে। হয়তো আমি আর ওর সাথে কথা বলতেও পারবো না।
বিপত্তিটা ঘটলো দুদিন আগে। ক্যাম্পাস থেকে রাজশাহী প্রেসক্লাবে ফিরে এ্যাকাউন্ট খুলতেই দেখলাম রিপার মেইল। মেইলটি পড়ে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। চোখে দেখতে লাগলাম সর্ষে ফুল। ও লিখেছে, ওর পঞ্চম সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ।
তাই ওর মাকে সঙ্গে করে আগামি পরশু রাজশাহীতে আসছে। আমাকে মুখোমুখি দেখার সাথে সাথে রাজশাহী ঘুরে দেখবে। রাজশাহীতে ওদের কেউ নেই। আমার এখানেই নাকি উঠবে। আর উঠবে বললেই তো হবে না, আমি তো থাকি মেসে।
সারারাত ধরে চিন্তা করলাম। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সকালে উঠে পদ্মার ধারে গিয়ে মনে মনে আরেকটি মিথ্যা পরিকল্পনা সাজালাম। একটি মিথ্যা যে হাজারটি মিথ্যার জন্ম দেয় তা আমি হারে হারে উপলব্ধি করলাম।
প্লাটফরমের পিলারে হেলান দিয়ে সাতপাঁচ ভাবছিলাম।
ট্রেনের হুইসেলে সম্বিত ফিরে পেলাম। হার্টবিট বেড়ে গেলো অসম্ভব রকম। একেএকে যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে আসছে। কিন্তু রিপাকে দেখতে পাচ্ছি না। আল্লাহ-আল্লাহ জপ করছিলামÑ ও যেন না আসে।
একটু পরেই আমার চোখজোড়া স্থীর হয়ে গেলো। একটি ব্যাগ হাতে ওর মায়ের সাথে সামনে এগিয়ে আসছে। ওর অনেক ছবি আমাকে মেইল করেছে তাই ওকে চিনতে বিন্দুমাত্রও বেগ পেতে হলো না। তবে বাস্তবের রিপা ছবির রিপার চেয়ে অনেক সুন্দর। ওয়েটিং রুম পার হয়ে এসে ও এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো।
বুঝলাম সে দিপাকে খুঁজছে।
বুকে অনেক সাহস করে মিথ্যার বেসাতি করতে এগিয়ে গেলাম ওর সামনে। আমার কেনো যেন কান্না পাচ্ছিলো। নিজেকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো এই মুহূর্তে ।
Ñ হ্যালো, আপনি কি রিপা?
রিপা একটু ইতস্তত হয়ে বললো, হ্যাঁ।
কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না।
আমি নিজেকে আরো একটু শক্ত করে বললাম, আমি দিপার খালাতো ভাই।
অসম্ভব সুন্দর একটি হাসি দিয়ে ওর মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। আমি ওনাকে সালাম দিলাম।
রিপা উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, কিন্তু দিপা কোথায়? ও ভীষণ শয়তান।
আজো আমার সাথে লুকোচুরি খেলতে চায়।
আমি কি বলবো আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। দীর্ঘদিন থিয়েটারের সাথে জড়িত আছি। অনেক অভিনয় করেছি। কিন্তু বাস্তবে অভিনয় করতে এসে নিজেকে পরাজিত এক অভিনেতা মনে হতে লাগলো।
ও আবারো দিপার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি কান্নার ভান করে ওদেরকে ওয়েটিং রুমে নিয়ে গেলাম। আমার মুখ দেখে ওরাও বয় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। রিপা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, কি হয়েছে বলুন তো।
Ñ আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। ওয়েটিং রুমের অন্যান্য লোকেরাও আমার দিকে তাকালো।
কান্না দেখে রিপার মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কি হয়েছে বাবা, বলতো। আর রিপা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ও যেন এক ঘোরের মধ্যে আছে।
আমি শুরু করলাম মিথ্যাচার। বললাম, রিপা আমার খালাতো বোন।
ছোটবেলা থেকেই ও খুব মেধাবী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের বাসা থেকেই লেখাপড়া চালাতো। ইন্টারনেট ব্রাউজ করা ছিলো ওর নেশা। ও প্রায়ই রিপার কথা আমাদের কাছে বলতো। রিপার পাঠানো মেইলগুলো পড়ে শোনাতো, ছবি দেখাতো।
ও যে রিপার সাথে বিশাল বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়েছে তা আমরা সবাই জানতাম। আমরা সবাই ওকে সবসময় হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা করতাম। আমি কথা বলতে বলতে রিপার দিকে চেয়ে দেখলাম ওর মুখমন্ডল ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
রিপার মা চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে বললো, তারপর কি হলো...
Ñ দীর্ঘদিন ধরে ও ব্রেইন ক্যান্সারে ভূগছিলো। শত অসুস্থ্যতার মধ্যেও সে কম্পিউটারে বসতো।
বলতো রিপার সাথে কথা না বললে নাকি ও মরেও শান্তি পাবে না।
বিষয়টি অনুধাবন করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রিপা। কাঁপাকাঁপা গলায় রিপা বললো দিপা এখন কোথায় সেটা বলুন।
গত পরশু রাতে আপনার মেইল পাওয়ার পর ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো। বাসার সবাইকে ডেকে আপনাদের রাজশাহী আসার কথা বললো।
হঠাৎ কি যেন ব্যথায় ছটফট করতে লাগলো সে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এ কথাগুলো বলেই চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। রিপার মা রুমাল দিয়ে চোখ মুছে আমাকে শান্ত্বনা দিতে লাগলো।
রিপা যেন নির্বাক মূর্তি হয়ে গেছে। ওয়েটিং রুমে কান্নাকাটি দেখে অনেক লোক জমে গেলো। হঠাৎ সমকালের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার মেহেরুল হাসান সুজন ওখানে হাজির। আমি মনে মনে ভাবলাম এইবার আমার সব জারিজুড়ি ফাঁস হয়ে যাবে। আমাকে কান্নাকাটি করতে দেখে ও অস্থির হয়ে বললো, সুমন তোর কি হয়েছে? ইনারাই বা কে? হুহু করে কেঁদে ওকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে ওখান থেকে চলে যেতে বললাম।
ও থতমত খেয়ে চলে গেলো। একটু পরে সুজন আমার মোবাইলে ফোন দিলো। আমি মোবাইলটা বন্ধ করে রাখলাম।
আমি চোখ মুছে রিপা ও তার মাকে বললাম, চলুন খালাম্মা, দিপা নেই তো কি হয়েছে, আমরা তো আছি।
রিপার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছিলো।
পাথরচাপা কন্ঠে বললো, ওর কবর দেয়া হয়েছে কোথায়?
এবার আমি আরেক বিপদে পড়লাম। এটাতো সিনেমার কাহিনীর মতো হয়ে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ আরেকটি মিথ্যার সৃষ্টি করলাম। রাজশাহী কেন্দ্রীয় গোরস্থানে ওদের নিয়ে গিয়ে হাতআন্দাজে নতুন একটি কবর দেখিয়ে দিলাম। কার কবর জানি না।
ওই কবরে লুটিয়ে পড়ে আধা ঘন্টা ধরে কাঁদলো রিপা। এ যেনো সত্যিই কোনো বাণিজ্যিক সিনেমার দৃশ্য। সৌজন্যতা রক্ষায় আমি ওদের রাজশাহীতে থেকে যেতে বললাম। কিন্তু রিপা থাকতে চাইলো না। যেখানে দিপা নেই সেখানে সে থাকতে পারবে না।
এবার আর অভিনয় নয়। সত্যি সত্যিই আমি কেঁদে ফেললাম। রিপাকে বলতে চাইলাম দিপা বলে কেউ নেই, ছিলো না কখনো। আমিই তোমার সাথে প্রতারণা করেছি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করার আশায়। কোন রকমেই বলতে পারলাম না।
এতে হয়তো বন্ধুত্বের প্রতি ওর আজন্মের ঘৃণার উদ্রেক হবে। এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে সেদিনই বাসে করে ও ফিরে গেলো ঢাকায়। বুঝলাম বন্ধুত্বের মায়াবী রূপের স্বরূপ। #
বি:দ্রসাপ্তাহিক উতসভূমির বন্ধু দিবসের সংখ্যায় আমার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)
আপনাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম। তবে মনে রাখবেন এটি কোন স্মৃতিচারণ নয়।
এটি একটি গল্প। স্রেফ গল্প। কতোটা গল্প হয়েছে কি হয়নি সে বিচারের ভার আপনাদের হাতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।